
২০০৩ সালের এপ্রিল মাসের ১২ তারিখ।। চট্রগ্রামের বিশাল সরকারি বাংলো বাড়িতে শুধু আমরা ৪ জন মানুষ।। আমি, ভাইয়া, আমার ছোট ভাগনে এবং বাবুর্চি।।
বাকি মানুষজন, মা, বড় বোন, বাবা, এবং দুলাভাই আমার আরেকটা নতুন ভাগ্নির আগমন কে কেন্দ্র করে হসপিটালে ছিল।।
বলা বাহুল্য, আমার আপুর একটি ছেলে হওয়ার প্রায় এক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন।।
সেই সময়ে আপু যতদিন হসপিটালে ছিল তখন আমি এইচ, এস, ছি এক্সামের প্রস্তুতি নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও একমাত্র খালা হিসেবে ছোট্ট ১১ মাসের ভাগনে ফাহিমকে দেখাশোনা করছিলাম।।
প্রথম দিকে ছোট বাবু দেখাশোনার ব্যাপারে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করতাম।। এর প্রধান কারণগুলো ছিল- ১। এত বড় বাড়িতে আমরা ৩ জন মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম।।
এক প্রান্তে কোনও বিপদ হলে অন্য প্রান্তের মানুষ টের পাবেনা এমন একটা অবস্থা।।
২। আমি কখনো এর আগে এতো ছোট বাচ্চাকে সাথে নিয়ে একা ঘুমাইনি।। তাই কিছুটা অস্বস্তি কাজ করছিল।।
যেহেতু আমার ভাগনে ফাহিম তখন অনেক ছোট, যে কিনা শুধু মাত্র কোনোমতে কোনও কিছু অথবা কারো হাতের সাহায্য নিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াতে পারে।।
তাই প্রথম রাতে আমি ওকে বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে জানালার সাথে লাগানো বিছানার দেওয়ালের দিকে আমার ও দেওয়ালের মাঝে শোয়াবো ঠিক করলাম।।
কিন্তু এরপর সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড় বজ্রসহ বৃষ্টি এবং ঝড় হওয়াতে আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম।।
কারণ এইভাবে যে ওকে জানালার পাশে শোওয়ানোতে রাতে ঝড়ের সময় বৃষ্টি এসে পড়তে পারে ওর গায়ে।।
যাই হোক, সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আমি মশারি টানিয়ে ভালো মতন গুঁজে দিয়ে ওকে নিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।।
ঘরে কিছুটা বাইরের সিকিউরিটি লাইটের আলো এসে রুমে বিভিন্ন দেয়ালে আলো ছায়ার আভা ফেলল।।
আমার চোখের রড এবং কোণ সেলগুলো আস্তে আস্তে সেই অন্ধকারের মৃদু আলোয় নিজেদের মানিয়ে নিলো।।
তাই কিছু সময় পর আমি প্রায় প্রতিটা জিনিসই স্পষ্ট দেখতে শুরু করলাম।।
আমি আমার পাশে উঁকি দিয়ে ফাহিমকে দেখলাম।। ও ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে নিশ্চিত হলাম।।
এরপর আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।। হঠাৎ রাত ৩ টার দিকে প্রচণ্ড বজ্রপাতের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।।
স্বাভাবিক ভাবেই আমি আমার ঘুমন্ত ভাগ্নের দিকে হাত বাড়ালাম এবং ও ঠিক আছে কিনা বা ভয় পেলো কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম।।
কিছুটা ঘুম ঘুম চোখেই অনুভব করলাম ও আমার পাশে আছে।। আমি তখন অস্থির হয়ে আরও সচেতন হয়ে ওকে খুঁজতে শুরু করলাম।।
ওর বালিশ ফাঁকা।। ওয়াল ছিল, কাঁথা সব ঠিক থাক মতন পড়ে আছে, কিন্তু ও বিছানার কোথাও নেই।।
আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পেরে পাগলের মত বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালানোর জন্য প্রস্তুত হলাম।।
যেই বাম পাশে ফিরলাম মাটিতে নামার জন্য অমনি আমার চোখ বিছানার পায়ার দিকে গেলো।।
দেখলাম, ফাহিম ঠিক আমার পায়ের দিকে খাটের কিনারা ধারে মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।। অথচ মশারি আগের মতই গুঁজানো।।
বাইরের সিকিউরিটি লাইটের আলো জানালা দিয়ে ওর মুখে এসে পড়ছিল।।
তাতে দেখলাম, ও স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।।
বরফের মত অদ্ভুত শীতল দৃষ্টি।। এই অবস্থা দেখে আমি কয়েক সেকেন্ড ভয়ে এবং ঠাণ্ডায় জমে গেলাম কিন্তু আল্লাহ আমাকে হঠাৎ শক্তি দিলেন এবং আমি কোনও কিছু তোয়াক্কা না করেই প্রানেপ্রনে মশারি তুলে মেঝেতে নেমে ওকে জড়িয়ে ধারে কোলে তুলে ফেললাম।।
আর রুমের সমস্ত লাইট জ্বালিয়ে দিলাম।। সাথে সাথেই দেখলাম ও স্বাভাবিক বাচ্চার মত চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।।
আমি জোরে জোরে দোয়া পড়া শুরু করলাম আর ওকে বুকে জড়িয়ে ধারে রাখলাম শক্ত করে।।
এখানে একটু বলে নিই, যে আমার উচ্চতা খাটের উচ্চতার প্রায় সমান।।
তাই যখন আমি খাটে শুয়েছিলাম তখন আমাকে না ডিঙ্গিয়ে এতটুকুন বাচ্চার পক্ষে নিচে নামা সম্ভব না।।
আর তাছাড়া, মশারি উঠিয়ে নিচে নেমে আবার মশারি গুঁজে দেয়াড় মতন উপযুক্ত তখন সে ছিল না।।
সেই রাত্রিতে আমি আর ঘুমুতে পারিনি।। সারারাত লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলাম।।
ওকে পাহারা দিচ্ছিলাম কিছুটা অস্থির চিত্তে।। ওর বাবা মাকে ব্যাপারটা বলেছিলাম কিন্তু এর মাঝে আর কোনোদিন এমন ওর সাথে হয়নি।।
এরপর প্রায় ৫ বছর আগের ঘটনা।। আমি আর্কিটেকচারের স্টুডেন্ট তখন।।
অনেক রাতে কমন রুম থেকে প্রোজেক্ট শেষ করে ঘুমুতে এসে দেখলাম ও আমার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে।।
ছোট্ট বাবুর এতো আদরের ঘুম আর ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হল না।। তাই আমি ঘরের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে, ডিম লাইট জ্বালিয়ে, এবং মূলবাতি নিভিয়ে ক্লান্ত হয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লাম।।
ওহ, বলে রাখা দরকার, ঐ রুমের দরজাটা দুই পাল্লার ছিল এবং ছিটকিনিটা দরজার উপরের অংশে ছিল।।
মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।। সেই রাতেও ভয়ংকর বৃষ্টি হচ্ছিল।। একদম সন্ধ্যা থেকে সকাল।। আমি পেছন ফিরে তাকালাম।।
আজও সেই একই কাহিনি।। ফাহিম আমার পাশে নেই।। মুহূর্তেই আমি দরজার দিকে চোখ দিলাম দেখার জন্য যে সেটা খোলা কিনা।।
ফাহিম হয়ত টয়লেটে গিয়েছে।। কিন্তু না।। দরজাটা লাগানো।। আমি ওপরে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দরজার ছিটকিনিতে হাত রাখলাম।।
সেটা আগের মতই বন্ধ।। খেয়াল করলাম, এতটুকুন ছেলে কখনই তার উপরের ছিটকিনি নাগাল পাবে না।।
আসে পাশে কিছু নেই যার উপর দাঁড়িয়ে ধরতে পারে।। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসলো।। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখলাম।।
বিছানার পাশের ফ্লোরে দেখলাম, যদি আবার পড়ে-টরে যায় বিছানার পাশের ফাঁকা দিয়ে।। কিন্তু না, তাকে কোথাও দেখতে পেলাম না।।
আমি এবার ভয় পেয়ে ওকে জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলাম।। রুম প্রায় ফাঁকা।। দরজা লাগানো।। আমি আর বেশি অস্থির হয়ে গেলাম এবং তন্ন তন্ন করে ওকে খুঁজতে লাগলাম।। মাথা ঠিকমতন কাজ করছিল না হয়ত।। নইলে এতো বড় একটা ছেলে রুমে নেই দেখে নিশ্চয়ই পরে আর নাম ধারে ডাকতাম না।। অবশেষে আমি পাগলের মত শেষ সম্ভাব্য স্থান সোফার উপর রাখা বারান্দায় বৃষ্টিতে আধাভেজা একগাদা জমা করে রাখা কাপড়গুলো হাতড়ানো শুরু করলাম।। একটার পর একটা কাপড় মাটিতে ছুড়ে ফেলছি।। বিছানার চাদর, শাড়ি, অনেকগুলো বড় বড় কাপড় মাটিতে ফেলার পর কাপড়ের গোছার নীচ থেকে হঠাৎ খুঁজে পেলাম ফাহিমকে।। তখনো ওর চোখ খোলা এবং সেদিনের মত আজও স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। ভয়ংকর সেই দৃষ্টি।। আমি ভয় পেলাম।। কিন্তু ওকে বুঝতে না দিয়ে সোফা থেকে ওকে টেনে তুলে নিলাম।। একটা কথাও বললাম না।। বিছানায় শুইয়ে দিলাম।। ও শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে পড়লো।। আমি আজও এই ঘটনা দুটো ভুলতে পারিনি।। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করিনি কারণ এটা বেশি জানাজানি হলে হয়ত মানুষ ওকে নিয়ে বা ওর নামে খারাপ কিছু ছড়াবে।। ও এখন আরেকটু বড় হয়েছে।। খুব শান্ত, সহজ সরল ছেলে।। আমার বাসায় এলেই আমার সাথে থাকার জন্য ভীষণ আবদার করে।। কিন্তু এরপর থেকে আমি ওর সাথে কখনো একা ঘুমানোর সাহস করিনি।।