তল্লাবাঁশের ঘনবনের মাঝখান দিয়ে সরু পাহাড়ি পথ। কিছু দূর হাঁটতেই চাকুয়া কড়াই আর নাগেশ্বর গাছের জঙ্গল পড়ল। সে জঙ্গল পেরুতেই চোখে পড়ল বড় একটি টিলা। টিলার পুবপাশে ছোট একটি গুহা। অরু গতকাল বিকেলে আমাকে বলল যে ওই গুহার ভিতরে নাকি এক সন্ন্যাসী আস্তানা গেড়েছে। কথাটা শুনে আমি মোটেও অবাক হইনি। বান্দারবানের পূর্ব দিকে বার্মার বর্ডার। সেই বর্ডার পর্যন্ত গহীন জঙ্গল আর ছোট ছোট পাহাড়-টিলার অজানা রাজ্য। যাকে বলে- ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। আজও এখানে কত যে সাধুসন্ন্যাসী ঘুরে বেড়াচ্ছে। বছর পাঁচেক হল আমি বান্দরবানে আছি। বছর তিনেক আগে একবার আমি গহীন জঙ্গলের ভিতর সাঙ্গু নদীর তীরে একটা বড় হরিণা গাছে নরমন্ডু ঝুলিয়ে তার তলায় এক তান্ত্রিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে বসে থাকতে দেখেছিলাম।
তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর টিলাটি বান্দরবানের গভীর অরণ্যে আমার যে জঙ্গলবাড়িটি রয়েছে- তার বেশ কাছে। কাজেই হেঁটে যাব বলে হাতির পিঠে চড়িনি। শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটছি। শেষ বিকেল। চারিদিকে নরম হলদে আলো ছড়িয়ে আছে। বনের বাতাসে লতাপাতার মাদক- মাদক গন্ধ। তবে এ সময়টায় কাকপাখির চিৎকারে কান পাতা দায়। প্রথম প্রথম জঙ্গলে এসে কাকপাখির চিৎকার যন্ত্রণার মতন লাগত। এখন অবশ্য কর্কস কলতান অনেকটাই সহ্য হয়ে গেছে। বেশ নিশ্চিন্তেই হাঁটছি। অরণ্য-প্রকৃতি আমার ভালো লাগে। নইলে এতটা বছর কীভাবে কাটল এই ঘোর জঙ্গলে?
বাঁ পাশে একটা কামদেব গাছ। সেই গাছ থেকে সরসর শব্দে নেমে এল একটা খয়েরি রঙের বুনো খরগোশ। তারপর চোখের পলকে ওদিকের উলু ঘাসের আড়ালে সুড়ৎ করে লুকালো। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে খসখস শব্দে কি যেন একটা চলে গেল। ডান পাশে একটা বাঁদলহোলা গাছ। তারই ডালে বসেছিল একটা ছাই রঙের পাহাড়ি বাজ। চোখে পড়ামাত্রই বাজটা উড়াল দিল। বাদামি রঙের উল্টোলেজি একটা বাঁদর বসে আছে একটা উদাল গাছের ডালে । বাঁদরটা আমায় আমায় চেয়ে চেয়ে দেখছিল। তবে মুখ ভেঙচালো কিনা ঠিক বোঝা গেল না। উল্টোলেজিটাকে তেমন বখাটে মনে হল না।
শুকনো পাতা মাড়িয়ে গুহার সামনে এলাম । গুহার মুখটি বেশ বড়োসরো। আল্লা-খোদার নাম নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাতাসে কেমন বিদঘুটে গন্ধ ভাসছিল; ঠিক গন্ধক কিংবা চুনাপাথরের গন্ধ নয়, কেমন চর্বিপোড়া গন্ধ মনে হল। তান্ত্রিক সাধুসন্ন্যাসীর গুহায় এমন বিদঘুটে গন্ধ অস্বাভাবিক কিছু না। চারপাশে আবছা অন্ধকার জমে ছিল। ওপাশে আলো চোখে পড়ল। ধুনির আগুন জ্বলেছিল। তারই সামনে একজন মাঝবয়েসি জটাধারী সন্ন্যাসী বসে রয়েছেন। ভঙ্গিটা পরিচিত। বজ্রাসন। সন্ন্যাসী চোখ বুজে ধ্যানস্থ ছিলেন। শীর্ণ শরীরটি হাড্ডিসার। মাথার চুলে এন্তার জটা থাকলেও চুল চুড়া করে বাঁধা। তবে চোখ দুটি শান্তই মনে হল যখন চোখ খুলে সন্ন্যাসী তাকালেন। আমাকে কিছুক্ষণ দেখে সামনে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আশ্বস্থ হলাম। কেননা, আমায় দেখে সন্ন্যাসী যদি বিরক্ত হতেন তাহলে আসতাম না বলে ঠিক করেছিলাম।
সন্ন্যাসীর সামনে বসলাম।
আমি আর কী বলব। একটু পর সন্ন্যাসীই নিরবতা ভাঙলেন। জানালেন সন্ন্যাসীর নাম- মঙ্গল ভট্টারক। এমন কাটখোট্টা নাম শুনে অবশ্য অবাক হলাম না। কাপালিক-সন্ন্যাসীগণের নাম এমনই গুরুগম্ভীর হওয়া উচিত। কিন্তু, মঙ্গল ভট্টারক কি কাপালিক? তান্ত্রিক এবং কাপালিকের মধ্যে ঠিক কি পার্থক- আমি সেটি জানি না।
তবে মজার ব্যাপার হল মঙ্গল ভট্টারক কথা বলেন সাধু ভাষায় । আদিবাড়ি সিলেটের জৈন্তারপুরে । (মঙ্গল ভট্টারক পিতৃ প্রদত্ত নামটি অবশ্য বললেন না …) হৃদয়ে বাল্যবয়েস থেকেই চৈতন্যময়ী সত্তার স্বরূপ জানার উদগ্র ইচ্ছা। সুতরাং কিশোর বয়েসে তন্ত্রসাধনার উদ্দেশে আসামের কামরূপ জেলার কামাখ্যা মন্দিরে গমন করেন। কামাখ্যা মন্দিরে সুদীর্ঘ তিরিশ বছর তন্ত্রবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছেন। এখন নির্জন সাধনার উদ্দেশ্যে বান্দরবানের এই দুর্গম অরণ্যে এসেছে।
কথাগুলি শুনে সামান্য উসখুস করি। কারণ সময়টা একুশ শতক। তাই জিজ্ঞেস করলাম, কামাখ্যা মন্দিরে কথা অনেক শুনেছি। তা ওই মন্দির সম্বন্ধে যেসব কথা শুনতে পাই সেসব সত্য নাকি?
মঙ্গল ভট্টারক মাথা দুলিয়ে বললেন, অবশ্যই সত্য। কামাখ্যা মন্দির হইল শক্তিপীঠ।
মনে মনে বললাম, বুঝলাম যে কামাখ্যা মন্দির হল শক্তিপীঠ। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয় যে কামাখ্যা মন্দির অপ্রাকৃত যাদুবিদ্যারও পীঠস্থান? আমি সন্দেহের সুরে বললাম, কামাখ্যা মন্দিরটা আসামের ঠিক কোথায় বলেন তো?
মঙ্গল ভট্টারক আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী সব দেখতে লাগলেন। আমার অস্বস্তি হতে লাগল। আমি যে সংশয়বাদী তা সম্ভবত তিনি টের পেয়েছেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মঙ্গল ভট্টারক গম্ভীর কন্ঠে বললেন, শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দির হইল প্রাগজ্যোতিষপুরের পশ্চিমে নীলাচল নামক একটি পর্বতের উপরে।
কথাটা মঙ্গল ভট্টারক এমনভাবে বললেন যেন ভারি এক গুপ্তকথা বলেছেন।
তবে মঙ্গল ভট্টারক পুরনো নাম বললেন। ইচ্ছে করেই কিনা কে জানে। প্রাগজ্যোতিষপুর এখন গোহাটি শহর। তিনি প্রাগজ্যোতিষপুর না বলে গোহাটিও বলতে পারতেন। তাতে অবশ্য তন্ত্রবিদ্যার মাহাত্ম ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা ষোলআনা।
জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক কি আছে কামাখ্যা মন্দিরে?
মঙ্গল ভট্টারক এবার খানিকটা প্রগলভ হয়ে উঠলেন যেন। প্রসন্ন কন্ঠে বললেন, শক্তির পীঠস্থানে রহিয়াছে দেবী কামাখ্যার সুপ্রাচীন প্রতিমা। বড় জাগ্রত দেবী কামাখ্যা । তিনখানা প্রাচীন প্রকোষ্ঠ লইয়া মন্দির গঠিত হইয়াছে। পশ্চিমের আয়তক্ষেত্রকার প্রকোষ্ঠখানাই বৃহদাকার। সাধারন পূণ্যার্থীগণ পশ্চিমের এই বৃহদাকার প্রকোষ্ঠখানায় বসিয়া দেবী উপাসনা করিয়া থাকে। মধ্যবর্তী প্রকোষ্ঠখানা আকারে চতুস্কোন। ইহাতে শক্তিদেবীর ছোট্ট একখানা প্রতিমা রহিয়াছে। দেওয়ালের পাষানে নারায়ণের এবং অন্যান্য দেব-দেবীর প্রস্তর-চিত্রাবলী অঙ্কিত রহিয়াছে। মধ্যবর্তী প্রকোষ্ঠটিই কামাখ্যা শক্তিপীঠের অতিশয় পবিত্রতম স্থান। প্রকৃতপক্ষে এই পবিত্রতম স্থানটি একটি ভূগর্ভস্থ গুহা। ইহাতে যোনিসদৃশ্য একখানি প্রস্তরখন্ড হইতে প্রবাহিত হইতেছে ঝরনাধারা। প্রত্যেক বৎসর গ্রীষ্মে শক্তিপীঠে অম্বুবাচী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেই অম্বুবাচী উৎসবে দেবী কামাখ্যার ঋতু উদযাপিত হয়। এই সময়ে মন্দিরের জলসমূহ রক্তবর্ণ ধারণ করিতে দেখা যায়।
হুমম। কামাখ্যা মন্দির বেশ রহস্যময় আর বিচিত্র স্থান বলেই তো মনে হচ্ছে। আমি মনে মনে ভাবলাম। এই ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম মঙ্গল ভট্টারক না-আবার আমার মনের কথা পড়ে ফেলেন। হাজার হলেও সিদ্ধযোগী। চারিদিকে একবার আমতা- আমতা করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, সারা জীবন আপনি এত যে কষ্ঠ করলেন। কিন্তু আপনি কি কোনও ধরণের অলৌকিক শক্তি হাসিল … মানে … অর্জন করেছেন?
মঙ্গল ভট্টারক মৃদু হাসলেন। তারপর হাসি থামিয়ে খানিকটা পরিহাসের স্বরে বললেন, আমি দিব্যশক্তি অর্জন করিয়াছি কিনা তাহা তুমি সময় হইলেই টের পাইবে বৎস।
মানে? এই মুহূর্তে আমার মুখটা নিশ্চয় বেকুবের মতন দেখাচ্ছে।
মঙ্গল ভট্টারক অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন, জঙ্গলবাড়িতে অত্যন্ত সাবধানে থাকিবে বৎস।
আমি চমকে উঠলাম।মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ক্য ক্য কেন … কেন আমাকে সাবধানে থাকতে বলছেন?
মঙ্গল ভট্টারক বললেন, তুমি যে জঙ্গলবাড়িতে বাস কর তাহা অভিশপ্ত।
আশ্চর্য! আমি যে জঙ্গলবাড়িতে থাকি সে খবর মঙ্গল ভট্টারক কী ভাবে জানলেন? অরু বলেছে কি? গতকাল তো অরু মঙ্গল ভট্টারক কে দেখেছিল। আমি বললাম, অভিশপ্ত? কই আমি তো কিছু টের পাইনি।
জঙ্গলবাড়ি অভিশপ্ত কি অভিশপ্ত নহে তাহা অবিলম্বেই টের পাইবে বৎস। কথাটা বলে চোখ বুজলেন মঙ্গল ভট্টারক। যেন গভীর ধ্যানে ডুবে গেছেন।
মনের মধ্যে ভীষণ অস্বস্তি টের পাচ্ছি। এখানে বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাছাড়া এখন এই আসন্ন সন্ধ্যায় গুহায় ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় ঢুকবে। তাতে ধ্যানস্থ সন্ন্যাসীর ধ্যানের ব্যঘাত ঘটবে কিনা জানি না-আমি আহত হলেও হতে পারি। একবার চারিদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখনই ক্ষীন জলধারা শুনতে পেলাম। কাছেই কোথাও ঝরনা আছে। হাঁটতে-হাঁটতে গুহামুখের কাছে চলে এলাম। ভাবলাম আজ এখানে না এলেই বুঝি ভালো হত। প্রতিটি মানুষই জানে যে তার চলার পথে বিপদ-আপদ ওত পেতে থাকে। কিন্তু ওত পেতে থাকা বিপদটা কেউ নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দিলে অস্বস্তি তো হবেই।
যখন জঙ্গলবাড়ি ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠেছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট জায়গা । শক্ত গামার কাঠের তৈরি সদর দরজাটি বেশ বড়। গেটের পাশে বিশাল একটা শিল কড়ই গাছ। ভিতরে ঢুকলে দু’পাশে কাঠের স্তূপ চোখে পড়বে; ডান পাশে কাঁটাতারের ওধারে চোখে পড়বে চাপালিশ, শমী আর বনকাপাস গাছের ঘন জঙ্গল; চোখে পড়বে লালচে কামদেব কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ি। দোতলায় ছোট একটি বারান্দা। বারান্দার দু’পাশে নীচ থেকে মাটি ফুঁড়ে উঠে গেছে শ্যামলতা, অনন্ত কান্তা ও মিঠাবিষ লতা । বাড়ির পিছনে ছাঁচি বেতের ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের পিছনে বেশ বড় একটি টিলা। টিলায় গুহাও আছে।
মাস দুয়েক হল আমি এই জঙ্গলবাড়িতে এসেছি । আগে থাকতাম থানচির কাছাকাছি একটা টংঘরে। ওখানেই আমার কাঠের আড়ত। আমার বাবা শেষ জীবনে কাঠের ব্যবসায় নেমেছিলেন। মৃত্যুর আগে ব্যবসা আমাকে বুঝিয়ে দেন। ব্যবসায় নামার আগে আমি কক্সবাজার শহরে লেখাপড়া করতাম।
তো, হাজারও সমস্য সত্ত্বেও ব্যবসা ভালোই চলছে। বছর দুয়েক আগে ড্রাইভারসহ (মাহুত) একটা সেকেন্ড হ্যান্ড হাতিও কিনেছি। হাতি নাম: রুস্তম। মাহুতের নাম অরু। অরুই তো গতকাল রুস্তমকে ঝরনায় গোছল করাতে গিয়ে মঙ্গল ভট্টারক কে দেখল। অরু বেশ বিশ্বস্ত। অরুর গায়ের রং তামাটে। তবে বয়স বোঝা যায় না। অরুরা নাকি বংশানুক্রমিকভাবে মাহুতের কাজ করে আসছে।
তবে এই নির্জন জঙ্গুলে পরিবেশে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী অরু নয়। রামু। একুশ/বাইশ বছর বয়েসি এই স্থানীয় ছেলেটি আমার ভীষণ ভক্ত। রামুই জঙ্গলবাড়ি দেখাশোনা করে। রান্নাবান্নাও রামুই করে। রামু বেশ হাসিখুশি ছেলে। হলদে মঙ্গোলয়েড মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে। ভারি ঝকঝকে দাঁত। রামু রোজ দু-বেলা কাঞ্জল গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজে। এটাই রামুর ঝকঝকে দাঁতের রহস্য কিনা কে জানে।
আমরা বাড়ি টেকনাফ শহরে । টেকনাফ শহরে আমাদের বেশ কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে। সেসবের দেখাশোনা করতেই মাঝে-মাঝে আমাকে বান্দরবান থেকে টেকনাফ যেতে হয়। আমার মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। ছোট এক বোন ছিল। আফরোজার শ্বশুরবাড়ি কক্সবাজার শহরে । ছোটবোন সুখেই ঘরসংসার করছে। বলতে গেলে আমার কোনও পিছুটানই নেই । তার ওপর আমার আবার ভবঘুরে স্বভাব। জঙ্গলে ভালো না লাগলে আবার হয়তো টেকনাফ শহরেই ফিরে আসব।
বহুদিন পর বাড়ি গেলাম।
মাজেদা ফুপু আমায় ফোন করে ডেকে পাঠালেন। মাজেদা ফুপু বাবার চাচাতো বোন। থাকেন টেকনাফ শহরের পুরনো বার্মিজ মার্কেটের কাছে। মাজেদা ফুপু বিধবা। তবে বেশ ধনী। আফজাল ফুপার চিংড়ির ব্যবসা ছিল। কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে বাসও ছিল। আরাকানের সঙ্গেও নাকি কী সব গোপন ব্যবসাও ছিল শোনা যায়।
আমার নাম কামরুল হলেও মাজেদা ফুপু আমাকে ছেলেবেলা থেকেই আদর করে ‘তোতা’ নামে ডাকেন। আমাকে দেখে মাজেদা ফুপু বললেন, কি রে তোতা? তুই বিয়ে করবি না? বিয়ের বয়স হল।
আমি কি আর বলব। চুপ করে রইলাম। মাজেদা ফুপু সবই জানেন। ব্যবসার কাজে গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই । তার ওপর মা-বাবা নেই। বিয়ের কথা কে তুলবে? এদিকে আমার বয়সও ত্রিশের কোঠায় ঠেকল। তাই ভাবলাম, জঙ্গলবাড়িতে আমার পাশে একটা উষ্ণ-কোমল আর মমতাময়ী বউ থাকলে মন্দ কি।
পাত্রী মাজেদা ফুপুই ঠিক করে রেখেছেন। পাত্রী মাজেদা ফুপুর ননদের মেয়ে- থাকে উখিয়া। পাত্রীর মা-বাবা নেই। পাত্রীর নাম: পিয়ালী। (কি সুন্দর নাম) উখিয়া গিয়ে পাত্রী দেখে এলাম। গায়ের রং শ্যামলাই বলা যায়। তবে চোখ দুটি এতই গভীর যে আমার হবু বউয়ের মনে হয় না চোখে কাজল লাগানোর দরকার হয়। তবে পিয়ালীকে কিছুটা দুঃখী বলে মনে হল। হয়তো নতুন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মা-বাবার কথা ভাবছে। মনে মনে ভাবলাম আমি আর পিয়ালী যখন রুস্তমের পিঠে চড়ে বনের ভিতরে বেড়াব তখন ওর সব দুঃখ ঘুচে যাবে।
পিয়ালীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
আমরা জঙ্গলবাড়িতে ফিরে এলাম।
জঙ্গলবাড়ি পৌঁছতে-পৌঁছতে আমার নববধূকে দূর্গমপথের যে ধকল সইতে হল তা জঙ্গলের আদিম সৌন্দর্য দেখে পুষিয়ে নিল মনে হয়। মুগ্ধ হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। জঙ্গলবাড়ি দেখেও পিয়ালী মুগ্ধ হল।
আমিও পিয়ালীর স্নিগ্ধ-মধুর সান্নিধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।তাছাড়া পিয়ালীর রান্নার হাত চমৎকার। ঠিক আমার মায়ের হাতের রান্নার মত।স্থানীয় আদিবাসী রান্না আমার ভালো লাগে। তবে সব সময় না। রামুর রান্নায় রয়েছে আদিবাসী ছেঁওয়া। তা ছাড়া পিয়ালী ফল-ফুল গাছ পছন্দ করে। নাগেশ্বর গাছের ফুল দিয়ে মিষ্টি পারফিউম তৈরি করে আমায় তাক লাগিয়ে দিল। তবে পিয়ালী কথা কম বলে। অবশ্য হাতির পিঠে চড়ে বেড়ানোর সময় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
যেমনটা আশঙ্কা করেছিলাম। সেটা অমূলক করে দিয়ে রামুর সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিল পিয়ালী। এই সমঝোতার ভিত্তি হয়ে উঠল রান্না। পিয়ালী রামুর কাছে আদিবাসী রান্না শিখছে, আর রামু পিয়ালীর কাছে শিখছে বাঙালি রান্না ।
নির্জন অরণ্যে আমার সংসার গভীর সুখশান্তিতে ভরে উঠেছে। এই অভাবনীয় সুখশান্তির জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানালাম।
তবে সে সুখ যেন মঙ্গল ভট্টারক- এর অশুভ ভবিষ্যৎবাণী সত্য করে দিতেই বেশি দিন রইল না।
একদিন সকালবেলা। দোতলার পিছনের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ভাদ্র মাস। আকাশের রং গভীর নীল। শুভ্র মেঘখন্ড ভেসে বেড়াচ্ছিল। নীল আকাশের নীচে বনতলে শরতের ঝরঝরে সাদা রোদ ছড়িয়ে ছিল। কাঞ্জল গাছে ফুল ফুটেছে। কাঞ্জল ফুলের রং হলদে সবুজ। মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম। ছাঁচি বেতে জঙ্গলটা রোদের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল। বিসোয়াল ঝোঁপের ওপর উড়ে এসে বসল একটা সবজে ধূসর রঙের পাহাড়ি তিতির। লতানে বিসোয়াল ঝোঁপের পাশেই একটা চিকড়াসী গাছে। তার তলায় রুস্তম দাঁড়িয়ে। চিকড়াসী গাছের পাশেই অরু-র চালাঘর।
পায়েলী আমার পাশে এসে দাঁড়াল। নীল রঙের শাড়ি পরেছিল। সাদা ব্লাউজ। গোছল সেরে এসেছে।ছড়ানো চুল ভিজে। লাক্স সাবানের গন্ধ পাচ্ছিলাম। পায়েলীকে কি সুন্দর যে লাগছিল। সাধারণ এই সময়ে আমি পিয়ালীর চুলে মুখ গুঁজে গন্ধ নিই। আজ ওর ভিজে চুলের গন্ধ নিতে যাব- হাত তুলে রোদ ঝলমলে ছাঁচি বেতে জঙ্গলটা দেখিয়ে পিয়ালী বলল, ওই জায়গাটা ভালো না।
আমি অবাক হলাম। বিস্ময়ের ধাক্কায় কাটিয়ে উঠে বললাম, জায়গাটা ভালো না মানে?
রুক্ষ কন্ঠে পিয়ালী বলল, আমি অত মানে-টানে জানি না। আমার মনে হয় তাই বললাম। আশ্চর্য! পিয়ালীর এত মধুর স্বভাব। কখনও মাথাব্যথা হলেও আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে। আজ কি হল ওর?
যাগ গে। আমার অত ভাবার সময় নেই এখন। জরুরি কাজে আমাকে বাইরে বেরুতে হবে।
তবে আমার যাওয়া হল না। কেননা ক্ষানিক বাদে পিয়ালীর ভীষণ জ্বর এল। জ্বর ধাপে ধাপে বাড়তে লাগল। আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এইসব বিরান জঙ্গলে অসুখ- বিসুখ হলেই সর্বনাশ। সহজে ডাক্তার-বৈদ্য পাওয়া যায় না। তবে সব সময় হাতের কাছে কিছু জরুরি অষুধ রাখি। রামু -অরুরা দেখিছি অসুস্থ হলে কীসব পাহাড়ি লতাপাতা চিবিয়ে খায়। দিব্যি সেরেও ওঠে। আমার আবার ওসব জঙ্গুলে ট্রিটমেন্টে বিশ্বাস কম।
পিয়ালীকে দুটো প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম। ঠিক করলাম বিকেলের মধ্যে জ্বর না সারলে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করব। আমি ভারি উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। রামু পিয়ালীর মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে। রামুর মুখ কালো। আমার দেরি অরুও দোতলায় উঠে এসেছে। দরজার কাছে মাটিতে বসে আছে।
আশ্চর্য! ঘন্টা খানেকের মধ্যে পিয়ালীর জ্বর একেবারে সেরে গেল। তবে পিয়ালীর কথাবার্তা আর আচরণ কেমন বদলে গেছে বলে মনে হল। চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। ভাবলাম জ্বরের জন্য এমন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে। রামুর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল পিয়ালী। এই তাকানোটা আমার কাছে অসহ্য ঠেকল । আজ আমার এক উর্ধ্বতন ফরেষ্ট অফিসারের সঙ্গে জরুরি মিটিং ছিল। পিয়ালীকে রামুর জিম্মায় রেখে নীচে নেমে এলাম।
মিটিং সেরে জঙ্গলবাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়াল।
দূর থেকে দেখলাম সদর দরজা হা করে খোলা। কি ব্যাপার? হাতির পিঠ থেকে নামার সময় রামুর ওপর রাগ হল আমার। কতবার ওকে বলেছি সদর দরজা বন্ধ রাখতে। নইলে বুনো শুয়োর ঢুকে পড়তে পারে। সময় কাটানোর জন্য শখ করে শশা আর কলাচাষ শুরু করেছি। বুনো শুয়োরের দল মিছেমিছি শশা আর কলার চারাগুলো উপড়ে ফেলবে।
অরু আমায় সদর দরজার কাছে নামিয়ে দিল। তারপর রুস্তমকে গোছল করাতে ঝর্নার দিকে চলে গেল ।
পিয়ালীর আবার জ্বর আসেনি তে। ভাবতে ভাবতে আমি চাতাল পেরিয়ে একতলার বারান্দায় উঠে এলাম। বারান্দার ওপাশে ঘরটাই অফিসঘর। অফিসঘরে একটা সিন্ধুক, আলমারী আর চেয়ার- টেবিল আছে। অফিসঘর পেরোলে ছোট একটা করিডোর। করিডোরের শেষ মাথায় সিঁড়ি। সিঁড়ির বাঁ পাশে রান্নাঘর। রামুর এখন রান্নাঘরেই থাকার কথা।
রান্নাঘরে ঢুকতে যাব-সামলে নিলাম। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভয়ানক চমকে উঠলাম। রান্নাঘরের বড় জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে । মেঝের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে রামু । পিয়ালী রামুর ঘাড়ের কাছে উবু হয়ে বসে আছে। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। এ কী! পিয়ালী রামুর ঘাড়ের কাছে উবু হয়ে বসে কি করছে? পিয়ালী কি করছে প্রথমে বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারার পর আমার মাথা বোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল। আমি ভীষণ শিউরে উঠলাম। কিন্তু … কিন্তু পিয়ালী … রামুর ঘাড় কামড়ে আছে কেন? রক্ত খাচ্ছে কি? তাই তো মনে হল। কিন্তু …কিন্তু পিয়ালী রামুর রক্ত খাচ্ছে কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ভাবতেও পারছি না।
পিয়ালী হঠাৎ মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর ঠোঁটের কিনার থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছিল। চোখের দৃষ্টিতে আদিম হিংস্রতা। কাঁধের দু’পাশে চুল অবিন্যস্ত। আমাকে দেখে পিয়ালী হাসল। কী কুৎসিত হাসি! আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। যেন জঙ্গলবাড়িতে ভূমিকম্প হচ্ছে।
অবচেতন মনে টের পেলাম আমার পালানো উচিত।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। করিডোরে দৌড়াচ্ছি। পা দুটো অবশ মনে হল। মাথার ভিতরে শীতল হিমস্রোত বইছে। পিছনে মনে হল পিছনে কিছু ভয়ঙ্কর শব্দে বিস্ফোরিত হল। রান্নাঘরের দরজা ভেঙে গেছে মনে হল। অবশ্য আমি পিছনে ফিরে তাকালাম না। যে করেই হোক মঙ্গল ভট্টারক= এর গুহায় পৌঁছতে হবে। কিন্তু … কিন্তু তিনি কি এখনও গুহায় আছেন ?
অফিসঘর পেরিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। অফিঘরের আসবাবপত্র ভীষণ শব্দে ভেঙে ফেলছে। এক দৌড়ে সদর দরজা পেরিয়ে গেলাম। জঙ্গলের ভিতরে প্রাণপন দৌড়াচ্ছি। পিছনে দু’পাশের গাছে দুদ্দার শব্দে । যেন ভয়ানক ঝড় উঠেছে।
তারপর কখন যে তল্লা বাঁশের ঘন বন পেরিয়ে গুহার মুখে এসে পৌঁছলাম। তবে দৌড়ের গতি কমালাম না। একেবারে মঙ্গল ভট্টারক- এর সামনে এসে থামলাম। ভীষন হাঁপাচ্ছিলাম। মেঝের ওপর বসে পড়লাম। দরদর করে ঘামছিলাম সম্ভত। কান পাতলে নির্জন গুহায় আমার হৃৎস্পন্দন শোনা যাবে।
মঙ্গল ভট্টারক ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এখন চোখ খুলে তাকালেন। তারপর প্রসন্নকন্ঠে বললেন, ভীত হইও বৎস। এক্ষণে তুমি নিরাপদ বলয়ে অবস্থান করিতেছ।
আমি কিছু বলতে গেলাম। মঙ্গল ভট্টারক হাত তুললেন। অর্থাৎ সব আমি জানি।
আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিল। মঙ্গল ভট্টারক কীভাবে যেন টের পেলেন। আমার দিকে একটি কলো রঙের মাটির পাত্র এগিয়ে দিলেন। কি আছে পাত্রে? অত ভাববার সময় নেই। এক চুমুকে শেষ করলাম। মিষ্টি পানীয়। অপরিচিত স্বাদ। তবে মুহূর্তেই আমার সমস্ত শরীর জুড়িয়ে গেল।
গুহার বাইরে বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দ হল। আমি চমকে উঠলাম। মঙ্গল ভট্টারক বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, বৎস, এক্ষণে আমি তোমার কৌতূহল মিটাইব। মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর।
আমি শুনতে লাগলাম।
মঙ্গল ভট্টারক বলতে লাগলেন-মানবজগতে আদিকাল হইতেই এক দূরাত্মা সম্প্রদায়ের যোগীগণ ডাকিনীবিদ্যা সাধনা করিত। পক্ষান্তরে পূণ্যাত্মা সম্প্রদায়ের যোগীগণ চৈতন্যময়ী সত্তার সাধনা করিত। যোগীগণ আপন আপন স্বভাব বশত ডাকিনীবিদ্যা কিংবা চৈতন্যময়ী সত্তার সাধনা করিত। তবে আদিকাল হইতেই চৈতন্যময়ী সত্তার সাধকগণ মহেশ্বরের আর্শীবাদ লাভ করিয়া আসিতেছেন। গোপনে ডাকিনীবিদ্যার সাধনা করে এইরূপ দূরাত্মা যোগী কামাখ্যা শক্তিপীঠে দূলর্ভ নয়। প্রাচীন নিগূঢ়শাস্ত্রে লিখিত আছে যে- ডাকিনীবিদ্যার সাধনা সার্থক হইলে কিংবা ব্যর্থকাম হইলে জগতে ঘোর তমসা নামিয়া আসে। তেমনই এক ডাকিনীবিদ্যার সাধক হইল দূরাত্মা জগন্ধর।
দূরাত্মা জগন্ধর? আমি জিজ্ঞেস করি।
হাঁ। দূরাত্মা জগন্ধর। প্রাগজ্যোতিষপুর নিবাসী দূরাত্মা জগন্ধর স্বভাবে খল, ধূর্ত এবং প্রতারক। তাহার গুরু ছিল কামাখ্যা মন্দিদের ঋষি সত্যবর্মন। হা, ঋষি সত্যবর্মনকে আমরা সত্যদ্রষ্ট্রা ঋষি জ্ঞান করিতাম। তিনি অতি উচ্চস্তরের যোগী ছিলেন। ঋষি সত্যবর্মন চৈতন্যময়ী সত্তার সাধক হইলেও ডাকিনীবিদ্যার সম্বন্ধে গভীর বুৎপত্তি অর্জন করিয়াছিলেন। সত্যবর্মন বৃদ্ধ হইয়াছিল। যুবা বয়েসে জগন্ধর ঋষি সত্যবর্মন- এর নিকট হইতে ডাকিনীবিদ্যার গূহ্যজ্ঞান কৌশলে আত্বসাৎ করে এবং সত্যবর্মন কে হত্যা করে। ইহার পর জগন্ধর কামরূপ হইতে আসামের গভীর অরণ্যে পালাইয়া যায় এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে ডাকিনীবিদ্যা সাধনা করিতে থাকে । কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধনঞ্জয় জগন্ধর- এর উপর অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া উঠিলেন। জগন্ধর এর সাধনা চরিতার্থ হইলে জগতে অশেষ অকল্যাণ সাধিত হইবে এই ভাবিয়া তিনি জগন্ধর কে হত্যার সিদ্ধান্ত লন। এই উদ্দেশ্যে কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধনঞ্জয় অষ্টাদশ সন্ন্যাসীকে মন্ত্রপূত ত্রিশূল প্রদান করিয়া জগন্ধর হত্যার দায়িত্ব অর্পন করে। আমি হইলাম অষ্টাদশ সন্ন্যাসীর একজন।
আমি চমকে উঠে বললাম, আপনি?
হাঁ। আমি। আমি ধ্যানযোগে জগন্ধর- এর অবস্থান জানিতে পারি। জঙ্গলবাড়ির পিছনে ছাঁচি বেতের ঘোর অরণ্যের পশ্চাতে যে পার্বত্য টিলা রহিয়াছে তাহারই এক নিভৃত গুহায় বসিয়া দূরাত্মা জগন্ধর সাধনা করিত।
আশ্চর্য!
ঋষি সত্যবর্মন-এর অভিশাপে জগন্ধর ডাকিনীবিদ্যায় সিদ্ধি লাভ করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। জগন্ধর এখন মূর্তিমান ডাকিনী হইয়া উঠিয়াছে। সে স্ত্রীলোকের মূর্তি ধরিয়া তরুণ যুবকের রক্ত পান। স্ত্রীলোকের মূর্তি করিতে জগন্ধর তোমার স্ত্রীর উপর ভর করিয়াছে।
আমি শিউরে উঠলাম। মনে পড়ল আজ জ্বর থেকে উঠে রামুর দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল পিয়ালী। তারপর রান্নাঘরে রামুর রক্ত খাচ্ছিল।
গুহামুখে ঝড় আর বজ্রপাতের শব্দ ততক্ষণে থেমে গেছে। এবার ক্রদ্ধ বাঘের রাগী গর্জন শোনা গেল। মঙ্গল ভট্টারক সেদিকে একবার তাকালেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। একটা কিছু আশঙ্কা করছিলাম। মঙ্গল ভট্টারক আমাকে অভিভূত করে চোখের নিমিষে জটাধারী শিবমূতি ধারণ করলেন। ডান হাতে চকচকে ত্রিশূল। বিদ্যুৎগতিতে ‘রে’ ‘রে’ শব্দে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে ত্রিশূল উঁচিয়ে গুহামুখের দিকে ছুটে গেলেন মঙ্গল ভট্টারক । আমিও পিছন পিছন ছুটলাম। গুহামুখে ঝলমলে রোদ। সেই রোদের আলোয় একটা বিশালকায় ডোরাকাটা প্রাণি দেখতে পেলাম । অনেকটা বাঘের মতন দেখতে। তবে আকারে অনেক বড়। প্রায় হাতির সমান। প্রাণিটা মঙ্গল ভট্টারক- এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু তার আগেই ক্ষিপ্র গতিদে প্রাণিটাকে লক্ষ করে সুতীক্ষ্ম ত্রিশূল ছুঁড়ে মারলেন মঙ্গল ভট্টারক। ত্রিশূল হলদে ডোরাকাট প্রাণির দেহে বিদ্ধ হল। মর্মদন্ত চিৎকারে গুহা কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল বনভূমি। প্রাণিটা সশব্দে আছড়ে পড়ল। তারপরই চারধার ঘন ধোঁওয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমি কটূ গন্ধ পেলাম । একটু পর ধোঁওয়া সরে গেলে মঙ্গল ভট্টারক কিংবা কোনও বিশালকায় ডোরাকাটা প্রাণির প্রাণহীন দেহ দেখতে পেলাম না।
দ্রুত জঙ্গলবাড়িতে ফিরে এলাম। রামুর লাশটা তখনও একতলার রান্নাঘরে পড়েছিল। আমার কান্না পেল। কিন্তু, পিয়ালী কে পেলাম না। বুকটা ভীষণ কাঁপছে। দ্রুত দোতলায় উঠে এলাম। পিয়ালী বিছানার ওপর শুয়ে ছিল। ভঙিটা বিধস্ত। যেন অনেক ঝড় বয়ে গেছে। শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। শ্যামলা মুখটা কেমন ফ্যাকাশে। ফিসফিস করে বলল, আমার কি হয়েছে?
ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, কিছু হয়নি।
পিয়ালীর চিকিৎসা দরকার। দ্রুত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। তারপর আমি আর পিয়ালী নীচে নেমে এলাম। অরুকে দেখলাম সদর দরজার কাছে ।
রুস্তমের পিঠে চড়ে থানচি রওনা হলাম। থানচি পৌঁছে রামুর লাশ সৎকারের জন্য অরুকে টাকা দেব। আজ রাতটা থানচির রেস্টহাউজে থাকব। কাল সকালে বান্দারবানের বাস ধরব।
এই জীবনে আর জঙ্গলমুখো হচ্ছি না।
টেকনাফ শহরে বাপদাদার ভিটেয় পিয়ালীকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধব …