অনেককাল আগের কথা।
কতকাল জিজ্ঞেস করলে কিন্তু বলতে পারব না। তারিখ-সাল যদি জানতে হয় ইতিহাসের পণ্ডিতের কাছে যাও।
মোট কথা, তখন পরী-হুরীদের যেখানে সেখানে দেখা যেত, রাক্ষস-খোক্ষসরা বনে-জঙ্গলে ভয় দেখাত আর তেপান্তর পেলেই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী সেখানে গাছে বাসা বেঁধে রাজপুত্রদের ভালো ভালো মতলব দেবার জন্যে বসে থাকত।
রাজপুত্ররাও তখন কথায় কথায় পক্ষিরাজে চড়ে দেশ বিদেশ ঘুরতে বেরুত। কিন্তু রাজপুত্ৰ হ’লেই ত হয় না। দু’বিঘে দু’কাঠা হোক রাজ্য চাই, ছেঁড়া-খোঁড়া হোক ভারী মখমলের পোশাক চাই, মরচে-ধরা হোক ভাঙা হোক তলোয়ার চাই , আর কানা হোক খোঁড়া হোক একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া চাই-ই। তার ওপর তিন বন্ধু—মন্ত্রিপুত্র, কোটালপুত্র, সদাগরপুত্ৰ হ’লে ত কথাই নেই!
আমাদের রাজপুত্র খুদকুমীরের সে সব কিছুই নেই। রাজ্য ছিল, কিন্তু মন্ত্রীমশাই কুমতলব দিয়ে সেটাকে লাটে তুলেছেন। কোতল করবার মানুষ না পেয়ে কোটাল গেছেন ভিন রাজ্যে চাকরি খুঁজতে, আর সদাগর লোকসানের ব্যবসা গুটিয়ে, দোকানপাট তুলে নিয়ে কোথায় গেছেন, কেউ জানে না।
তারা নেই তো তাদের পুত্ররা আর থাকবে কোথায়! তাই আকাশ যেখানে দূর পাহাড়ের পেছনে নুয়ে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছলছল করে।
খুদকুমারের বড় সাধ—দেশভ্রমণে যাবে। কিন্তু সাধই আছে, সাধ্য কোথায়? তবু দুঃখিনী মার আশীৰ্বাদ নিয়ে খুদকুমার একদিন বেরিয়ে পড়ল।
রাজপোশাক নেই। ছেড়া জামা মা দিয়েছেন সেলাই করে। তলোয়ার নেই, ফলা-ভাঙা ছুরিটা আছে ট্যাঁকে সে-ই জানে। যাবার সময় মা শুধু চিড়ে-মুড়ি বেঁধে দিয়েছেন পথে খেতে, আর মনে রাখতে দিয়েছেন একটি শ্লোক—
কান পাতবে বনে,
শত্তুর মারবে মনে।
মাঠ-বন পেরিয়ে যায় খুদকুমার। খেয়ার কড়ি নেই, নদী-নালা পার হয় সাতরে। রোঁ-ওঠা কুকুরটা যায় সঙ্গে।
সূয্যি ডোবে যেখানে, সেখানে গহন অরণ্যে গিয়ে খুদকুমার থামে। গাছের ডালে নিজের জায়গা করে নেয়, কিন্তু কুকুরটা থাকবে কোথায়?
কুকুরের ভাবনা ভাবতে হয় না। দেখা যায় গাছের কোটরে শুকনো ছেড়া লতা-পাতার ফাকে বেশ অনায়াসে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে।
রাত বাড়ে! গাছপালা অন্ধকারে একাকার হয়ে যায়। ঘন ডালপালা লতাপাতার ফাঁকে একটা-দুটো তারা যেন ভয়ে এক আধবার উঁকি দেয়।
খুদকুমারের চোখে ঘুম নেই। এক প্রহর, দু প্রহর, তিন প্রহর রাত কেটে যায়। হঠাৎ খুদকমারের কান খাড়া হয়ে উঠল। গাছের মাথায় যেন হাওয়ার শিস। হাওয়ার শিস না কাদের ফিসফিস? ফিসফিসই ত বটে।
“বুক যে ফেটে গেল গো!”—কে যেন বলছে।
“ফাটুক, তবু রা না শুনি”—কার যেন ধমক।
আবার সেই ফিসফিস, “আর যে পারি না।”
তার জবাবে, “না পারিস ত মর না।”
আগেরটা যেন মেয়ে আর পরেরটা যেন পুরুষের গলা।
এরা আবার কারা ?
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী নয় ত?
হ্যা তাতে আর ভুল নেই। খানিকবাদে ডানা ঝটপট করে ব্যাঙ্গমী শুধোয় ফিসফিসয়ে, “আচ্ছা, সব না হয় একটু!”
“একটু কেন, সব-ই বল!”
ব্যাঙ্গমা এবার রেগে গলা ছেড়ে দেয়, “আর না বলেই বা করবি কি? যেমন আমাদের কপাল, কত নিশুতি রাত জেগে কাটালাম, কোথায় কোনরাজপুত্ত্বর ঝলমলে সাজে পক্ষিরাজে আসবে, আশ মিটিয়ে পেটের কথা বলব, শুলুক-সন্ধান দেব,—না, কোথাকার এই উইয়ে-খাওয়া পুঁইয়ে পাওয়া আখদে রাজপুত্ত্বর এল রোঁ-ওঠা এক ঘেয়ো কুকুর নিয়ে।”
“বল, বল, ওকেই বল।”
“বললে কি শুনবে, হয়ত ঘুমেই ন্যাতা। শুনলে কি বুঝবে, হয়ত বুদ্ধিই ভোঁতা।”
“আহা, তবু বলি। শুনে না বুঝুক; বলে তো সুখ।”
ব্যাঙ্গমী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারপর মিহি সুরে ধরে, “দিনরাত্তির দুয়ারে ঘা।”
ব্যাঙ্গমা মোটা গলায় বলে, “দুয়ার তবু খোলে না।”
ব্যাঙ্গমার মোটা গলা, “এখনো চুল বাঁধেননি।”
মিহি সুরে, “চুল বাঁধবেন কবে!”
মোটা সুরে, “কালরাক্ষস ঘায়েল যেদিন হবে।”
এবার মিহি-মোটা একসঙ্গে—
“বনের শেষে তেপান্তরে
তা ছাড়িয়ে নদীর চর,
নদীর ধারে দুধ-পাহাড়
সেখানে পুরী চার-দুয়ার;
চার-দুয়ারের একটি খিল
খুলবে তো তাল করো তিল।”
বুকের বোঝা হালকা করে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বুঝি ঘুমালো। খুদকুমারের চোখে আর কি ঘুম আসে। রাতের আঁধার ফিকে হতে-না-হতেই সে বেরিয়ে পড়ে। গহন বন ছাড়িয়ে তেপান্তর। তেপান্তর পেরিয়ে নদীর চর। নদীর পারে মেঘের রাশি। কিন্তু দুধ পাহাড় কই?
গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন,
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।