ছোট গল্প : হঠাৎ ভয়—- রাসেল আহমেদ

গ্রামের নাম বালিঝুড়ি। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার অন্তর্গত গ্রামটি। এ গ্রামেই স্ত্রী আর এক মেয়েকে নিয়ে বাস করে হতদরিদ্র সালাম মিয়া। সে একজন গরীব কৃষক। দিন আনে দিন খায়। তার নিজের বলতে কোন জায়গা জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে। তাতে যে আয় হয় তা দিয়েই নূন আর ভাতে সালাম মিয়ার সংসার কোন রকমে কেটে যায়। কিন্তু যখন অন্যের জমিতে কাজ করতে না পারে তখন তাকে মেয়ে ও বউকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। এভাবে সালাম মিয়ার সংসার চালাতে আর ভাল লাগে না।
তাই তিনি ঠিক করলেন ভ্যান চালাবেন কিন্তু ভ্যান সে কোথায় পাবে, কেইবা দিবে। তা নিয়েও সে চিন্তায় ভেঙ্গে পড়েন। অনেক ভেবে চিন্তে গঞ্জে একটি রিক্সার গ্যারেজে গিয়ে ভ্যান ভাড়া নিয়ে চালাবেন বলে ঠিক করলেন। সেদিন বিকেল হয়ে যাওয়ায় পরদিন থেকে বের হবেন বলে ভাবলেন। ঐ দিন গঞ্জের হাটে পালা বসায় তার বাড়িতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল। রাত হলেই বা কি সালাম মিয়া দেখতে যেমন জেদি তেমনি ছিলেন খুব সাহসী। বাড়িতে এসে যখন দেখে সবাই ঘুমিয়ে গেছে। ঘরে এসে দেখলেন হাড়িতে কিছুই নেই।

কি আর করার তখন তিনিও আধা জগ পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। খুব ভোরে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন তিনি পাশের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি ভাবলেন সকাল সকাল কোন শিশু হয়তো ঘুম থেকে উঠে কান্না করছে। কিন্তু না সময় যতই যাচ্ছে কান্নার আওয়াজ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। হঠাৎ তিনি কান্নার পাশাপাশি মানুষের উত্তেজনারও আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখলেন। সেই বাড়ির কবির নামের একটি ছেলে গাছের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কবির দু’মাস আগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। তার রেজাল্ট বের হওয়ার পর যখন জানতে পারলো যে সে ফেল করেছে তখন সে দিশেহারা হয়ে বাড়িতে ফিরলো।
কিন্তু বাড়িতে আসলেই তার বাবা তাকে গালাগালি শুরু করে এবং একসময় মারধরও করে। তাই সে তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। আশেপাশের আরও আট দশ গ্রামের লোক কবিরের ঝুলন্ত লাশ দেখার জন্য ছুটে আসছে। বেলা যখন দুপুর ঘনিয়ে আসল তখন ৪-৫ জন পুলিশ এসে কবিরের লাশটি গাছ থেকে নামালো। ছেলের লাশের পাশে বসে কবিরের বাবা মা অসহায় হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

একজন পুলিশ তখন এসে বললেন লাশকে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হাসাপাতালতো অনেক দূর। প্রায় ৮-১০ কিলোমিটারের পথ। এতোদূরের পথ কিভাবে যাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রামের রাস্তাটা ভাঙ্গাচোরা এবং অনেক ছোট। সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবার মতো কোন কায়দা নেই। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবতে লাগল। পুলিশগুলো অনেক চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অনেক ভ্যান চালককে যেতে বললেও কেউ এত দূরের পথ যেতে রাজি হলেন না। সবশেষে যখন সালাম মিয়াকে যাওয়ার জন্য বলা হল তখন সে তার অভাবের সংসারের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলেন। সন্ধ্যা ৬ টা বাজে তখন কয়েকজন পুলিশ এবং সালাম মিয়া মিলে লাশটিকে তার ভ্যানে উঠিয়ে নিল। একজন পুলিশ বলল আমরা জিপে যাচ্ছি তুমি কি একা যেতে পারবে? সালাম মিয়া উত্তর দিল, জি পারমু। তখন জিপটি চলে গেল। তারপর সালাম মিয়া তার ভ্যান গাড়ির প্যাডেল মারতে শুরু করলেন। গ্রামের মাটির রাস্তা। রাস্তার কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু। তাই সে আস্তে আস্তে ভ্যান চালাচ্ছিলেন। গ্রামের পরেই রয়েছে একটি শ্মসানঘাট। সেটি ঘুব ভয়ঙ্কর জায়গা। সেখান দিয়ে দিনের বেলায় মানুষ যেতে ভয় পায়। অনেক দিন আগে সেখানে একটি মাথা কাটা মানুষ পড়ে আছিল। এসব কথা মনে পড়তেই যেন সালাম মিয়ার গা ভয়ে শিউরে উঠছে। শ্মসান ঘাটের রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়তেই তিনি আর সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। চারদিক এতই অন্ধকার দেখাচ্ছিল যে সে আসলে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে নাকি শ্মসান ঘাটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারল না। কিন্তু একটু সামনে যেতেই পেছন থেকে একটি আওয়াজ তার কানে ভেসে আসল। আওয়াজটি ছিল এমন ‘তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস, তোর গাড়ি থামা, গাড়ি থামা।’

কিন্তু সালাম মিয়া কিছু না ভেবে তার মতো গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সে একই আওয়াজ আবার শুনতে পেলো। এবার সালাম মিয়া সাহস করে পেছনে ফিরলেন। আর পেছনে ফিরেই সে দেখলেন ভ্যান গাড়িতে রাখা লাশটি দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল। তিনি চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হল না। সালাম মিয়া তড়িঘড়ি করে সামনের দিকে মুখ ফিরালেন এবং আবার ভ্যান চালাতে লাগলেন। সে মনেমনে দোয়া পড়ছেন এবং ভ্যান চালাচ্ছিলেন। তিনি উড়ন্ত গতিতে ভ্যান চালাতে শুরু করলেন। এক সময় সে শ্মসান ঘাটের শেষপ্রান্তে এসে সামান্য আলো দেখতে পেলেন। তিনি সেই আলোর কাছে এসে বুঝতে পারলেন সেটি ছিল আগুনের আলো। শ্মসান ঘাটে একটি মৃতদেহ পুড়ানো হচ্ছিল। সেখানে সে তখন কিছু মানুষ দেখতে পেলেন। মানুষ দেখে তার মনে সাহস হল।

যেতে যেতে এক সময় সে শহরের হাসপাতালে পৌঁছে গেল। রাত তখন ২ টা বাজে। হাসপাতালে তখন ২/১ জন কর্মচারী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাদের সাথে নিয়েই কবিরের লাশটিকে হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হল। সেদিন রাতে আর সালাম মিয়া বাড়ি ফিরলেন না। তারপর দিন সে বাড়িতে ফিরেই ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এভাবে তিনি কিছুদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার পর একদিন সে স্বপ্নে দেখতে পেলের কবিরের সেই রূপটি তাকে এসে ডাকছেন। সালাম মিয়ার ভয় যেন আরও বেড়ে গেল। সে ঘুমের মধ্যেই চিৎকার শুনে তার স্ত্রী ঘুম থেকে জেগে উঠে তাকে বলল, কি হইছে তোমার, এর ম করতাছ কে, খারাপ কিছু দেখছো নাকি। সালাম মিয়া কোন কথা বলল না।
কিন্তু সালাম মিয়া কিছু না বললেও তার স্ত্রী ঠিকই বুঝতে পারলো। তাই সে সালাম মিয়াকে বলল, এখন ঘুমাও সকাল বেলা কবিরের কাছে যাইয়া তোমার শরীর ঝাইরা আমুনে। কিন্তু পরদিন সকাল আর সালাম মিয়া দেখতে পেলেন না। সেই রাতেই সালাম স্ত্রী কন্যাকে রেখে আল্লাহ্র কাছে চলে যান।

আরো পড়তে পারেন...

পাখির কাছে শেখা

প্রতিদিন সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি দেখি একটা ছোট্ট সুন্দর নীল-হলুদ রঙের নাম না…

নেকড়ে, শেয়াল আর ভেড়ার গল্প (দক্ষিণ আফ্রিকার উপকথা)

এক নেকড়ে একদিন তার শিকার থেকে ফেরার সময় সামনে দেখে এক খামার বাড়ি আর সেখানে…

সদর ও অন্দর-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিপিনকিশোর ধনীগৃহে জন্মিয়াছিলেন, সেইজন্যে ধন যে পরিমাণে ব্যয় করিতে জানিতেন তাহার অর্ধেক পরিমাণেও উপার্জন করিতে…