কাবুলিওয়ালা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম অংশ

আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না । পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল , তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না । তাহার মা অনেকসময় ধমক দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেয় , কিন্তু আমি তাহা পারি না । মিনি চুপ করিয়া থাকিলে এমনি অস্বাভাবিক দেখিতে হয় যে , সে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না । এইজন্য আমার সঙ্গে তাহার কথোপকথনটা কিছু উৎসাহের সহিত চলে ।

সকালবেলায় আমার নভেলের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে হাত দিয়াছি এমন সময় মিনি আসিয়াই আরম্ভ করিয়া দিল , “ বাবা , রামদয়াল দরোয়ান কাককে কৌয়া বলছিল , সে কিচ্ছু জানে না । না ? ”

আমি পৃথিবীতে ভাষার বিভিন্নতা সম্বন্ধে তাহাকে জ্ঞানদান করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বেই সে দ্বিতীয় প্রসঙ্গে উপনীত হইল । “ দেখো বাবা , ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শুঁড় দিয়ে জল ফেলে , তাই বৃষ্টি হয় । মা গো , ভোলা এত মিছিমিছি বকতে পারে! কেবলই বকে , দিনরাত বকে । ”

এ সম্বন্ধে আমার মতামতের জন্য কিছুমাত্র অপেক্ষা না করিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল , “ বাবা , মা তোমার কে হয় । ”

মনে মনে কহিলাম শ্যালিকা ; মুখে কহিলাম , “ মিনি , তুই ভোলার সঙ্গে খেলা কর্‌গে যা । আমার এখন কাজ আছে । ”

সে তখন আমার লিখিবার টেবিলের পার্শ্বে আমার পায়ের কাছে বসিয়া নিজের দুই হাঁটু এবং হাত লইয়া অতিদ্রুত উচ্চারণে ‘আগডুম-বাগডুম’ খেলিতে আরম্ভ করিয়া দিল । আমার সপ্তদশ পরিচ্ছেদে প্রতাপসিংহ তখন কাঞ্চনমালাকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কারাগারের উচ্চ বাতায়ন হইতে নিম্নবর্তী নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িতেছেন ।

আমার ঘর পথের ধারে । হঠাৎ মিনি আগডুম-বাগডুম খেলা রাখিয়া জানালার ধারে ছুটিয়া গেল এবং চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল , “ কাবুলিওয়ালা , ও কাবুলিওয়ালা । ”

ময়লা ঢিলা কাপড় পরা , পাগড়ি মাথায় , ঝুলি ঘাড়ে , হাতে গোটাদুই-চার আঙুরের বাক্স , এক লম্বা কাবুলিওয়ালা মৃদুমন্দ গমনে পথ দিয়া যাইতেছিল — তাহাকে দেখিয়া আমার কন্যারত্নের কিরূপ ভাবোদয় হইল বলা শক্ত , তাহাকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়া দিল । আমি ভাবিলাম , এখনই ঝুলিঘাড়ে একটা আপদ আসিয়া উপস্থিত হইবে , আমার সপ্তদশ পরিচ্ছেদ আর শেষ হইবে না ।

কিন্তু, মিনির চীৎকারে যেমনি কাবুলিওয়ালা হাসিয়া মুখ ফিরাইল এবং আমাদের বাড়ির দিকে আসিতে লাগিল , অমনি সে ঊর্ধ্বশ্বাসে অন্তঃপুরে দৌড় দিল , তাহার আর চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গেল না । তাহার মনের মধ্যে একটা অন্ধ বিশ্বাসের মতো ছিল যে , ঐ ঝুলিটার ভিতর সন্ধান করিলে তাহার মতো দুটো-চারটে জীবিত মানবসন্তান পাওয়া যাইতে পারে ।

এদিকে কাবুলিওয়ালা আসিয়া সহাস্যে আমাকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল — আমি ভাবিলাম , যদিচ প্রতাপসিংহ এবং কাঞ্চনমালার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন তথাপি লোকটাকে ঘরে ডাকিয়া আনিয়া তাহার কাছ হইতে কিছু না কেনাটা ভালো হয় না।

কিছু কেনা গেল। তাহার পর পাঁচটা কথা আসিয়া পড়িল। আবদর রহমান, রুস, ইংরাজ প্রভৃতিকে লইয়া সীমান্তরক্ষানীতি সম্বন্ধে গল্প চলিতে লাগিল।

অবশেষে উঠিয়া যাইবার সময় সে জিজ্ঞাসা করিল , “ বাবু , তোমার লড়কী কোথায় গেল । ”

আমি মিনির অমূলক ভয় ভাঙাইয়া দিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে অন্তঃপুর হইতে ডাকাইয়া আনিলাম — সে আমার গা ঘেঁষিয়া কাবুলির মুখ এবং ঝুলির দিকে সন্দিগ্ধ নেত্রক্ষেপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল । কাবুলি ঝুলির মধ্য হইতে কিসমিস খোবানি বাহির করিয়া তাহাকে দিতে গেল , সে কিছুতেই লইল না , দ্বিগুণ সন্দেহের সহিত আমার হাঁটুর কাছে সংলগ্ন হইয়া রহিল । প্রথম পরিচয়টা এমনি ভাবে গেল ।

কিছুদিন পরে একদিন সকালবেলায় আবশ্যকবশত বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় দেখি , আমার দুহিতাটি দ্বারের সমীপস্থ বেঞ্চির উপর বসিয়া অনর্গল কথা কহিয়া যাইতেছে এবং কাবুলিওয়ালা তাহার পদতলে বসিয়া সহাস্যমুখে শুনিতেছে এবং মধ্যে মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে নিজের মতামতও দো-আঁসলা বাংলায় ব্যক্ত করিতেছে । মিনির পঞ্চবর্ষীয় জীবনের অভিজ্ঞতায় বাবা ছাড়া এমন ধৈর্যবান শ্রোতা সে কখনো পায় নাই । আবার দেখি , তাহার ক্ষুদ্র আঁচল বাদাম-কিসমিসে পরিপূর্ণ । আমি কাবুলিওয়ালাকে কহিলাম , “ উহাকে এ-সব কেন দিয়াছ । অমন আর দিয়ো না । ” বলিয়া পকেট হইতে একটা আধুলি লইয়া তাহাকে দিলাম । সে অসংকোচে আধুলি গ্রহণ করিয়া ঝুলিতে পুরিল ।

বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া দেখি , সেই আধুলিটি লইয়া ষোলো-আনা গোলযোগ বাধিয়া গেছে ।

মিনির মা একটা শ্বেত চকচকে গোলাকার পদার্থ লইয়া ভর্ৎসনার স্বরে মিনিকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন , “ তুই এ আধুলি কোথায় পেলি । ”

মিনি বলিতেছে , “ কাবুলিওয়ালা দিয়েছে । ”

তাহার মা বলিতেছেন , “ কাবুলিওয়ালার কাছ হইতে আধুলি তুই কেন নিতে গেলি । ”

মিনি ক্রন্দনের উপক্রম করিয়া কহিল , “ আমি চাই নি , সে আপনি দিলে । ”

আমি আসিয়া মিনিকে তাহার আসন্ন বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়া বাহিরে লইয়া গেলাম ।

সংবাদ পাইলাম , কাবুলিওয়ালার সহিত মিনির এই যে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ তাহা নহে , ইতিমধ্যে সে প্রায় প্রত্যহ আসিয়া পেস্তাবাদাম ঘুষ দিয়া মিনির ক্ষুদ্র লুব্ধ হৃদয়টুকু অনেকটা অধিকার করিয়া লইয়াছে ।

দেখিলাম , এই দুটি বন্ধুর মধ্যে গুটিকতক বাঁধা কথা এবং ঠাট্টা প্রচলিত আছে — যথা রহমতকে দেখিবামাত্র আমার কন্যা হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিত , “ কাবুলিওয়ালা , ও কাবুলিওয়ালা , তোমার ও ঝুলির ভিতর কী । ”

রহমত একটা অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দু যোগ করিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর করিত , “ হাঁতি । ”

অর্থাৎ, তাহার ঝুলির ভিতরে যে একটা হস্তী আছে এইটেই তাহার পরিহাসের সূক্ষ্ম মর্ম । খুব যে বেশি সূক্ষ্ম তাহা বলা যায় না , তথাপি এই পরিহাসে উভয়েই বেশ একটু কৌতুক অনুভব করিত — এবং শরৎকালের প্রভাতে একটি বয়স্ক এবং একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর সরল হাস্য দেখিয়া আমারও বেশ লাগিত ।

উহাদের মধ্যে আরো-একটা কথা প্রচলিত ছিল । রহমত মিনিকে বলিত , “ খোঁখী , তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না! ”

বাঙালির ঘরের মেয়ে আজন্মকাল ‘ শ্বশুরবাড়ি ‘ শব্দটার সহিত পরিচিত , কিন্তু আমরা কিছু একেলে ধরনের লোক হওয়াতে শিশু মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে সজ্ঞান করিয়া তোলা হয় নাই । এইজন্য রহমতের অনুরোধটা সে পরিষ্কার বুঝিতে পারিত না অথচ কথাটার একটা কোনো জবাব না দিয়া চুপ করিয়া থাকা নিতান্ত তাহার স্বভাববিরুদ্ধ , সে উলটিয়া জিজ্ঞাসা করিত , “ তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে ? ”

রহমত কাল্পনিক শ্বশুরের প্রতি প্রকাণ্ড মোটা মুষ্টি আস্ফালন করিয়া বলিত , “ হামি সসুরকে মারবে । ”

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!