‘এই জাহাজে ঘাপলা আছে,’ কেবিনে ঢুকে মূর্তি হয়ে বসল জেন।
‘স্পীড কম। এয়ারকন্ডিশনিং ঠিক মত কাজ করে না। আর ববি মুর জঘন্য কফি বানাত, এই বলবে তো?’
‘না।’
ওকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে অপেক্ষা করছে রানা।
‘রানা,’ বলল মেয়েটি, ‘শেপ মাইয়ার সম্পর্কে বিসিআই তোমাকে কি কি জানিয়েছে বলবে আমাকে?’
‘একসময় না একসময় জাহাজটা মাসাওয়া পৌঁছবে। এবং প্যাসেঞ্জার লিস্টে সম্ভবত কোন গন্ডগোল নেই।’
‘ক্রুদের সম্পর্কে কিছু বলেনি?’
‘ববি সাহেবের কথা জানা ছিল না,’ বলল রানা।
‘সিআইএ আমাকে বলেছে তোমাকে জানাতে। আর আমা ওপর আরও একটা দায়িত্ব চাপিয়েছে। তিনটে মিনিটমেন মিসাইল ট্র্যাক করতে হবে। খোয়া গেছে ওগুলো।’
‘কমপি−ট মিসাইল?’
‘না-অংশবিশেষ। সঙ্গে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড রয়েছে।’
‘কোথায় ওগুলো?’
‘ব্রিজের পেছনে এক নম্বর ডেকে, দড়ি বাঁধা হয়ে বসে আছে কন্টেইনারগুলোর মধ্যে।’
‘তুমি ঠিক জানো?’
‘ফেয়ারলি।’
‘মালদিনির কাছে চালান করা হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, ববি মুর বেশি বেশি মাতব্বরী ফলাচ্ছিল। আমার বিশ্বাস মাসুদ রানাকে খতম করার চাইতে ওই মিসাইলগুলো অকেজো করাটাই জিওনিস্টের জন্যে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।’
‘তার মানে আমাদের এখন ইসরাইলী সহযোগিতা ছাড়াই কাজটা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘যাকগে, রাতটা থেকে যাও এখানে।’
‘আর আমার চরিত্র ধ্বংস হোক?’
‘তখন চার্লটনদের সামনে যা বললে তারপর আর ধ্বংস হতে বাকি আছে কিছু?’
হেসে ফেলল জেন। বলল, ‘তবু আমার কেবিনেই শোবো আমি।’
এখন অবধি অল্প কিছু ক্রুর সঙ্গে দেখা হয়েছে রানার। ওদের কথাই ভাবছে। যাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করে না তারা। ডিনারে ক্যাপ্টেন জোহানসনের সঙ্গে গল্প করেছে রানা। মিস্টার ম্যাকলিন সেকেন্ড মেট, শুনেছে। ফার্স্ট মেট, মিস্টার জন কেয়ার, মাঝেমধ্যে খোঁত-খাঁত করে অভিবাদন জানিয়েছে এবং পাতে আরও আলু চেয়েছে, কিন্তু বাহ্যত একবারও মনে হয়নি যাত্রীরা বাঁচল না মরল তাতে কিছু এসে যায় তার। পার্সার, মিস্টার বর্গ, রানাদের খাওয়ানোর দায়-দায়িত্ব ববি মুরের ঘাড়ে চাপিয়ে, চুপচাপ দৈনন্দিন পাঁচ হাজার ক্যালোরি হজম করে গেছে। রেডিও অপারেটর, লম্বা, সোনালী চুলের লিকলিকে মেয়েটি সুইডিশ; মেরী এন্ডারসন। ফার্স্ট মেটের মতই চাপা স্বভাবের। এক কথায়, ওয়ার্ডরূমে সামাজিকতার কোন বালাই নেই।
রানা কান খাড়া রাখল যদি ববির খোঁজে হৈ-চৈ পড়ে জাহাজে। কোনমতে রাত কাবার করে, সকালে জেনকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যাসেজওয়েতে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত ওরা মেরী এন্ডারসনের সঙ্গে।
‘ববি মুরকে তোমরা কেউ দেখেছ?’ প্রশ্ন করল ও।
‘ডিনারের সময় দেখেছি,’ বলল রানা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল জেন, সে-ও তখনই শেষবার দেখেছে।
মেরী এন্ডারসন ওদের ওপর সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার ওরা।
‘দশ মিনিট পর আমার কেবিনে এসো,’ বলল জেন। ‘একসাথে নাস্তা করব আমরা।’ সানন্দে রাজি হলো রানা।
কেবিনে ফিরে এসে তৈরি হয়ে নিল রানা। অস্ত্র সঙ্গে রাখার বিষয়ে আরেকবার মাথা ঘামাল। এই জাহাজে করে তিনটে মিনিটম্যান আইসিবিএম তৈরির মাল-মশলা চলেছে, জেনের এ থিয়োরি বলছে ঠিকই করেছে রানা। কোডেড মেসেজ পাঠানোর জন্যে রেডিও ব্যবহার না করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। ক্রুরা হয়তো জানে না কি বহন করছে তারা, কারণ কার্গো শিপে কন্টেইনার খোলার কোন নিয়ম নেই। কিন্তু যদি জানা থাকে ওদের? তবে কি এখন থেকে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করবে রানা?
খানিকটা অনুতাপের সঙ্গে লুগার আর স্টিলেটো সুটকেসের গোপন কুঠুরীতে রেখে দিল রানা, খুদে গ্যাস বোমাটা আর ট্র্যান্সিভারও রয়েছে ওখানে। এ জাহাজ ঠিকঠাকমত ইথিওপিয়া গেলে তো ভালই, নইলে একটামাত্র লুগার নিয়ে এতবড় ঝামেলা এড়ানো যাবে না। জাহাজের এঞ্জিনিয়ারদের কারও দেখা পায়নি ভেবে মনে মনে উদ্বিগড়ব হয়ে উঠছে রানা। ববি মুর জানিয়েছিল মিসেস চার্লটনের প্রশেড়বর জবাবে, তারা নাকি নিচে থাকতে ভালবাসে, যাত্রীদের দেখা দেয় না। ওর ব্যাখ্যা তখন মেনে নিয়েছিল রানা। কিন্তু এখন কেমন যেন খুঁত-খুঁত করছে মনটা।
তালা বন্ধ সুটকেসটার দিকে আবারও চাইল রানা। জ্যাকেট পরে ঢাকা দেয়া যায় লুগার। এরচাইতে ছোটখাটো কিছু পরে লুগার গোপন করার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু এই পচা গরমে জ্যাকেট পরলে জাহাজের সবচাইতে সরল সাদাসিধে ক্রুটিও সন্দিহান হয়ে উঠবে। এবং জাহাজে সরল মনের ক্রু আদৌ কেউ আছে কিনা ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে ওর।
প্যাসেজওয়েতে পা রাখল নিরস্ত্র রানা, দরজা লক করে ক’গজ দূরে জেনের কেবিনের উদ্দেশে এগোল। আলতো টোকা দিল ও। জেন ভেতর থেকে ডাকতে ঢুকে পড়ল।
মেয়েলি অগোছাল দৃশ্য চোখে পড়বে ভেবেছিল রানা, কিন্তু তার বদলে দেখতে পেল ছিমছাম এক কেবিন। বাঙ্কের নিচে জেন সযতেড়ব ঢুকিয়ে রেখেছে লাগেজ, ওপেন ক্লজিটে নিরাপদ ওর গ্যাজেট ব্যাগ। রানা ভেবে পেল না ওর ক্যামেরা .২২ সিঙ্গল শট ধারণ করছে কিনা, কোন একটা লেন্সে।
জেন পরে রয়েছে ব্লু হল্টার আর ডেনিম কাটঅফ। পায়ে আজ স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, অস্ত্র বহন করছে না যুবতী। ব্রেকফাস্টের জন্যে ওয়ার্ডরূমে গেল ওরা একটু পরে।
পুরোটা সময় ধরে ববি মুরের অনুপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা চলল। মিসেস চার্লটনের ধারণা সাগরে পড়ে গেছে লোকটা। কিন্তু প্রতিবাদ করল রানা, বলল তাহলে কেউ না কেউ শুনতে পেত। কিন্তু ওর কথা কানে তুললেন না ভদ্রমহিলা। পাল্টা বললেন লুকআউট কাজ ফেলে ঘুমালে শুনবে কিভাবে? এবার আপত্তি করে উঠল পার্সার। মিস্টার কেয়ার ও মিস্টার ম্যাকলিন থাকতে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির নাকি প্রশ্নই ওঠে না। বিস্বাদ কফি, পোড়া টোস্ট আর সঙঊ্যাম্বল্ড্ এগ দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। আজ ওদের প্রতি কেমন শীতল আচরণ করলেন চার্লটন দম্পতি। ওদের বন্ধুত্ব সম্ভবত সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না ওঁরা। একদিক দিয়ে ভালই হলো রানাদের জন্যে। ববি মুরের জন্যে পর্যাপ্ত হা-হুতাশ করে জেনের কেবিনের দিকে পা বাড়াল ওরা।
‘জার্নালিস্টের ভান যখন ধরেছি তখন ববির সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নিতে হয়,’ রানাকে বলল জেন। ‘তুমি কি করবে ভাবছ?’
‘কি আর, পোর্ট ডেকে গিয়ে আরেকটা জেমস হেডলি চেজ ধরব।’
‘এই,’ আদুরে কণ্ঠে বলল জেন। ‘আমার কিছু ছবি তুলে দাও।’
আঁতকে ওঠার ভান করল রানা। ‘মানে জন্মদিনের পোশাকে?’
‘তা নয় তো কি?’
‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?’ বলল রানা। ‘এমনিতেই আমাদের মেলামেশা লোকে ভাল চোখে দেখছে না। তার ওপর আবার যখন তখন কেবিনে ঢোকা, কেমন দেখায় না?’ মেয়েটার মনোভাবের হঠাৎ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়েছে ও।
মাথা নেড়ে স্বীকার করল জেন। ওকে সান্ত্বনা দিল রানা, বলল, ‘পরে সুযোগ মত তুলে দেব। এখন চলি।’ জেনকে ওর কেবিনে পৌঁছে দিয়ে চলে এল ও।
একটু পরে, ডেক চেয়ারে আয়েশ করে বসে তখন রানা, মুখটা ছায়ায় রাখার ব্যবস্থা করে সবে চোখের সামনে তুলতে যাবে বইটা, পায়ের শব্দ ও তারপর এক পুরুষকণ্ঠ কানে এল ওর। ‘মিস্টার রানা, নড়বেন না।’
রানা উপেক্ষা করার ভান করল। রানা আবার কে, অন্য কাউকে বলছে হয়তো।
‘মিস্টার আকবর, নড়াচড়া করবেন না।’
এবার আর গায়ে না মেখে উপায় কি? সেকেন্ড মেট ম্যাকলিনের গলা। দু’জন নাবিক, সশস্ত্র, রানার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার দেখা দিল ম্যাকলিন। তার হাতেও অস্ত্র।
‘জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান,’ বলল সে।
‘এই জেনারেল মালদিনিটা কে?’
‘যাঁকে ইথিওপিয়ান সরকারের হয়ে খুঁজছেন আপনি।’
‘ম্যাকলিন, জেনারেল মালদিনি না কি, তাকে চাকরি দিতে ঠেকা পড়েনি ইথিওপিয়ান সরকারের।’
‘অনেক হয়েছে, মিস্টার রানা। ববি মুরকে খুন করেছেন আপনি। গাধা বেচারা-ইসরাইলীরা নিশ্চয়ই খুব সস্তায় কিনেছিল ওকে।’
‘মানুষকে বেহুদা অপবাদ দেয়া ঠিক নয়,’ বলল রানা। ‘খুঁজে দেখোগে, কোথাও হয়তো মাল টেনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।’
কথার পিঠে কথা বলার সুরে জবাব দিল ম্যাকলিন। ‘ভেবে অবাক লাগে, বাচাল বুড়িরাও মাঝেমধ্যে ফস করে কেমন সত্যি কথা বলে বসে। কাল রাতে লুকআউট ঘুমাচ্ছিল। বেশিরভাগ রাতেই ঘুমায়। কিন্তু আমি জেগে ছিলাম। ববির জন্যে জাহাজ ঘুরাতে চাইনি। জিওনিস্ট এজেন্ট পানিতে পড়লে আমার কি?’
‘ইসরাইলের অনেক কিছু।’
‘স্বীকার করছি আপনার নার্ভ খুব শক্ত। কিন্তু আমরা সশস্ত্র, আপনি তা নন। এ জাহাজের সমস্ত ক্রু মহান নেতা মালদিনির লোক-শুধু ববি মুর, যাকে ফেলে দিয়েছেন আপনি জাহাজ থেকে এবং ওই এঞ্জিনিয়ারগুলো ছাড়া, এঞ্জিন রূমে এখন বন্দী হয়ে আছে ওরা। আপনার ছোরাটা কই, মিস্টার রানা?’
‘ববির শরীরে।’
‘আমি দেখেছি ওটা ব্যবহার করেননি আপনি।’
‘তুমি রাতকানা মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘কি দেখতে কি দেখেছ।’
‘যাকগে। ওটা এখন আপনার সাথে নেই। আপনি অতুলনীয়, মিস্টার রানা। কিন্তু অস্ত্রধারী তিনজনের বিরুদ্ধে অসহায়। কাজেই আস্তে করে উঠে পড়ে সামনে হাঁটা দিন। ঘুরবেন না। কোন ফন্দিফিকির করতে যাবেন না। জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান যদিও, তবে মারা পড়লেও খুব একটা দুঃখ পাবেন বলে মনে হয় না।’
রানার দায়িত্ব মালদিনির পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হওয়া। এখন সেধে যখন তার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, আপত্তি কিসের? তাছাড়া সশস্ত্র তিনজনের বিপক্ষে কিইবা করার আছে ওর। বিশেষ করে রানার দক্ষতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিগুণ সতর্ক রয়েছে যখন ওরা।
পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে তপ্ত সূর্যটা। সামনে হেঁটে গেল ওরা, পাশ কাটাল দড়িবদ্ধ কন্টেইনারগুলোর। শেষবারের মত মহাসাগরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। তারপর একটা দরজা পার হয়ে ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারে পা রাখল।
‘থামুন!’ আদেশ করল ম্যাকলিন।
রেডিও শ্যাকের দশ ফিটের মধ্যে এখন রানা। বেরিয়ে এল মেরী এন্ডারসন, রানার তলপেট বরাবর ধরে রয়েছে একটা কাটা শট-গান।
‘ক্যাপ্টেন বলেছেন, বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়া ব্যবহার করতে,’ বলল মেরী।
‘সে তো একদম নাক বরাবর,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তো?’
‘ইংরেজ দম্পতি দেখে ফেলতে পারে আমাদের। হাজার হলেও মিস্টার রানা এখন অসুস্থ রোগী। ভয়ঙ্কর ট্রপিকাল ফিভারে ধরেছে তাঁকে।’
‘অসুস্থ রোগীদের বয়ে নিয়ে যেতে হয়,’ বলল মেরী।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে মাথা খাটাতে হলো না রানার। পেছনে পদশব্দ হলো ওর। পরমুহূর্তে সাতটা সূর্য দপ করে জ্বলে উঠল রানার মাথার মধ্যে। এখন ঘনঘোর অন্ধকার।
‘স্পীড কম। এয়ারকন্ডিশনিং ঠিক মত কাজ করে না। আর ববি মুর জঘন্য কফি বানাত, এই বলবে তো?’
‘না।’
ওকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে অপেক্ষা করছে রানা।
‘রানা,’ বলল মেয়েটি, ‘শেপ মাইয়ার সম্পর্কে বিসিআই তোমাকে কি কি জানিয়েছে বলবে আমাকে?’
‘একসময় না একসময় জাহাজটা মাসাওয়া পৌঁছবে। এবং প্যাসেঞ্জার লিস্টে সম্ভবত কোন গন্ডগোল নেই।’
‘ক্রুদের সম্পর্কে কিছু বলেনি?’
‘ববি সাহেবের কথা জানা ছিল না,’ বলল রানা।
‘সিআইএ আমাকে বলেছে তোমাকে জানাতে। আর আমা ওপর আরও একটা দায়িত্ব চাপিয়েছে। তিনটে মিনিটমেন মিসাইল ট্র্যাক করতে হবে। খোয়া গেছে ওগুলো।’
‘কমপি−ট মিসাইল?’
‘না-অংশবিশেষ। সঙ্গে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড রয়েছে।’
‘কোথায় ওগুলো?’
‘ব্রিজের পেছনে এক নম্বর ডেকে, দড়ি বাঁধা হয়ে বসে আছে কন্টেইনারগুলোর মধ্যে।’
‘তুমি ঠিক জানো?’
‘ফেয়ারলি।’
‘মালদিনির কাছে চালান করা হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, ববি মুর বেশি বেশি মাতব্বরী ফলাচ্ছিল। আমার বিশ্বাস মাসুদ রানাকে খতম করার চাইতে ওই মিসাইলগুলো অকেজো করাটাই জিওনিস্টের জন্যে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।’
‘তার মানে আমাদের এখন ইসরাইলী সহযোগিতা ছাড়াই কাজটা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘যাকগে, রাতটা থেকে যাও এখানে।’
‘আর আমার চরিত্র ধ্বংস হোক?’
‘তখন চার্লটনদের সামনে যা বললে তারপর আর ধ্বংস হতে বাকি আছে কিছু?’
হেসে ফেলল জেন। বলল, ‘তবু আমার কেবিনেই শোবো আমি।’
এখন অবধি অল্প কিছু ক্রুর সঙ্গে দেখা হয়েছে রানার। ওদের কথাই ভাবছে। যাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করে না তারা। ডিনারে ক্যাপ্টেন জোহানসনের সঙ্গে গল্প করেছে রানা। মিস্টার ম্যাকলিন সেকেন্ড মেট, শুনেছে। ফার্স্ট মেট, মিস্টার জন কেয়ার, মাঝেমধ্যে খোঁত-খাঁত করে অভিবাদন জানিয়েছে এবং পাতে আরও আলু চেয়েছে, কিন্তু বাহ্যত একবারও মনে হয়নি যাত্রীরা বাঁচল না মরল তাতে কিছু এসে যায় তার। পার্সার, মিস্টার বর্গ, রানাদের খাওয়ানোর দায়-দায়িত্ব ববি মুরের ঘাড়ে চাপিয়ে, চুপচাপ দৈনন্দিন পাঁচ হাজার ক্যালোরি হজম করে গেছে। রেডিও অপারেটর, লম্বা, সোনালী চুলের লিকলিকে মেয়েটি সুইডিশ; মেরী এন্ডারসন। ফার্স্ট মেটের মতই চাপা স্বভাবের। এক কথায়, ওয়ার্ডরূমে সামাজিকতার কোন বালাই নেই।
রানা কান খাড়া রাখল যদি ববির খোঁজে হৈ-চৈ পড়ে জাহাজে। কোনমতে রাত কাবার করে, সকালে জেনকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যাসেজওয়েতে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত ওরা মেরী এন্ডারসনের সঙ্গে।
‘ববি মুরকে তোমরা কেউ দেখেছ?’ প্রশ্ন করল ও।
‘ডিনারের সময় দেখেছি,’ বলল রানা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল জেন, সে-ও তখনই শেষবার দেখেছে।
মেরী এন্ডারসন ওদের ওপর সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার ওরা।
‘দশ মিনিট পর আমার কেবিনে এসো,’ বলল জেন। ‘একসাথে নাস্তা করব আমরা।’ সানন্দে রাজি হলো রানা।
কেবিনে ফিরে এসে তৈরি হয়ে নিল রানা। অস্ত্র সঙ্গে রাখার বিষয়ে আরেকবার মাথা ঘামাল। এই জাহাজে করে তিনটে মিনিটম্যান আইসিবিএম তৈরির মাল-মশলা চলেছে, জেনের এ থিয়োরি বলছে ঠিকই করেছে রানা। কোডেড মেসেজ পাঠানোর জন্যে রেডিও ব্যবহার না করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। ক্রুরা হয়তো জানে না কি বহন করছে তারা, কারণ কার্গো শিপে কন্টেইনার খোলার কোন নিয়ম নেই। কিন্তু যদি জানা থাকে ওদের? তবে কি এখন থেকে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করবে রানা?
খানিকটা অনুতাপের সঙ্গে লুগার আর স্টিলেটো সুটকেসের গোপন কুঠুরীতে রেখে দিল রানা, খুদে গ্যাস বোমাটা আর ট্র্যান্সিভারও রয়েছে ওখানে। এ জাহাজ ঠিকঠাকমত ইথিওপিয়া গেলে তো ভালই, নইলে একটামাত্র লুগার নিয়ে এতবড় ঝামেলা এড়ানো যাবে না। জাহাজের এঞ্জিনিয়ারদের কারও দেখা পায়নি ভেবে মনে মনে উদ্বিগড়ব হয়ে উঠছে রানা। ববি মুর জানিয়েছিল মিসেস চার্লটনের প্রশেড়বর জবাবে, তারা নাকি নিচে থাকতে ভালবাসে, যাত্রীদের দেখা দেয় না। ওর ব্যাখ্যা তখন মেনে নিয়েছিল রানা। কিন্তু এখন কেমন যেন খুঁত-খুঁত করছে মনটা।
তালা বন্ধ সুটকেসটার দিকে আবারও চাইল রানা। জ্যাকেট পরে ঢাকা দেয়া যায় লুগার। এরচাইতে ছোটখাটো কিছু পরে লুগার গোপন করার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু এই পচা গরমে জ্যাকেট পরলে জাহাজের সবচাইতে সরল সাদাসিধে ক্রুটিও সন্দিহান হয়ে উঠবে। এবং জাহাজে সরল মনের ক্রু আদৌ কেউ আছে কিনা ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে ওর।
প্যাসেজওয়েতে পা রাখল নিরস্ত্র রানা, দরজা লক করে ক’গজ দূরে জেনের কেবিনের উদ্দেশে এগোল। আলতো টোকা দিল ও। জেন ভেতর থেকে ডাকতে ঢুকে পড়ল।
মেয়েলি অগোছাল দৃশ্য চোখে পড়বে ভেবেছিল রানা, কিন্তু তার বদলে দেখতে পেল ছিমছাম এক কেবিন। বাঙ্কের নিচে জেন সযতেড়ব ঢুকিয়ে রেখেছে লাগেজ, ওপেন ক্লজিটে নিরাপদ ওর গ্যাজেট ব্যাগ। রানা ভেবে পেল না ওর ক্যামেরা .২২ সিঙ্গল শট ধারণ করছে কিনা, কোন একটা লেন্সে।
জেন পরে রয়েছে ব্লু হল্টার আর ডেনিম কাটঅফ। পায়ে আজ স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, অস্ত্র বহন করছে না যুবতী। ব্রেকফাস্টের জন্যে ওয়ার্ডরূমে গেল ওরা একটু পরে।
পুরোটা সময় ধরে ববি মুরের অনুপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা চলল। মিসেস চার্লটনের ধারণা সাগরে পড়ে গেছে লোকটা। কিন্তু প্রতিবাদ করল রানা, বলল তাহলে কেউ না কেউ শুনতে পেত। কিন্তু ওর কথা কানে তুললেন না ভদ্রমহিলা। পাল্টা বললেন লুকআউট কাজ ফেলে ঘুমালে শুনবে কিভাবে? এবার আপত্তি করে উঠল পার্সার। মিস্টার কেয়ার ও মিস্টার ম্যাকলিন থাকতে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির নাকি প্রশ্নই ওঠে না। বিস্বাদ কফি, পোড়া টোস্ট আর সঙঊ্যাম্বল্ড্ এগ দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। আজ ওদের প্রতি কেমন শীতল আচরণ করলেন চার্লটন দম্পতি। ওদের বন্ধুত্ব সম্ভবত সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না ওঁরা। একদিক দিয়ে ভালই হলো রানাদের জন্যে। ববি মুরের জন্যে পর্যাপ্ত হা-হুতাশ করে জেনের কেবিনের দিকে পা বাড়াল ওরা।
‘জার্নালিস্টের ভান যখন ধরেছি তখন ববির সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নিতে হয়,’ রানাকে বলল জেন। ‘তুমি কি করবে ভাবছ?’
‘কি আর, পোর্ট ডেকে গিয়ে আরেকটা জেমস হেডলি চেজ ধরব।’
‘এই,’ আদুরে কণ্ঠে বলল জেন। ‘আমার কিছু ছবি তুলে দাও।’
আঁতকে ওঠার ভান করল রানা। ‘মানে জন্মদিনের পোশাকে?’
‘তা নয় তো কি?’
‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?’ বলল রানা। ‘এমনিতেই আমাদের মেলামেশা লোকে ভাল চোখে দেখছে না। তার ওপর আবার যখন তখন কেবিনে ঢোকা, কেমন দেখায় না?’ মেয়েটার মনোভাবের হঠাৎ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়েছে ও।
মাথা নেড়ে স্বীকার করল জেন। ওকে সান্ত্বনা দিল রানা, বলল, ‘পরে সুযোগ মত তুলে দেব। এখন চলি।’ জেনকে ওর কেবিনে পৌঁছে দিয়ে চলে এল ও।
একটু পরে, ডেক চেয়ারে আয়েশ করে বসে তখন রানা, মুখটা ছায়ায় রাখার ব্যবস্থা করে সবে চোখের সামনে তুলতে যাবে বইটা, পায়ের শব্দ ও তারপর এক পুরুষকণ্ঠ কানে এল ওর। ‘মিস্টার রানা, নড়বেন না।’
রানা উপেক্ষা করার ভান করল। রানা আবার কে, অন্য কাউকে বলছে হয়তো।
‘মিস্টার আকবর, নড়াচড়া করবেন না।’
এবার আর গায়ে না মেখে উপায় কি? সেকেন্ড মেট ম্যাকলিনের গলা। দু’জন নাবিক, সশস্ত্র, রানার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার দেখা দিল ম্যাকলিন। তার হাতেও অস্ত্র।
‘জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান,’ বলল সে।
‘এই জেনারেল মালদিনিটা কে?’
‘যাঁকে ইথিওপিয়ান সরকারের হয়ে খুঁজছেন আপনি।’
‘ম্যাকলিন, জেনারেল মালদিনি না কি, তাকে চাকরি দিতে ঠেকা পড়েনি ইথিওপিয়ান সরকারের।’
‘অনেক হয়েছে, মিস্টার রানা। ববি মুরকে খুন করেছেন আপনি। গাধা বেচারা-ইসরাইলীরা নিশ্চয়ই খুব সস্তায় কিনেছিল ওকে।’
‘মানুষকে বেহুদা অপবাদ দেয়া ঠিক নয়,’ বলল রানা। ‘খুঁজে দেখোগে, কোথাও হয়তো মাল টেনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।’
কথার পিঠে কথা বলার সুরে জবাব দিল ম্যাকলিন। ‘ভেবে অবাক লাগে, বাচাল বুড়িরাও মাঝেমধ্যে ফস করে কেমন সত্যি কথা বলে বসে। কাল রাতে লুকআউট ঘুমাচ্ছিল। বেশিরভাগ রাতেই ঘুমায়। কিন্তু আমি জেগে ছিলাম। ববির জন্যে জাহাজ ঘুরাতে চাইনি। জিওনিস্ট এজেন্ট পানিতে পড়লে আমার কি?’
‘ইসরাইলের অনেক কিছু।’
‘স্বীকার করছি আপনার নার্ভ খুব শক্ত। কিন্তু আমরা সশস্ত্র, আপনি তা নন। এ জাহাজের সমস্ত ক্রু মহান নেতা মালদিনির লোক-শুধু ববি মুর, যাকে ফেলে দিয়েছেন আপনি জাহাজ থেকে এবং ওই এঞ্জিনিয়ারগুলো ছাড়া, এঞ্জিন রূমে এখন বন্দী হয়ে আছে ওরা। আপনার ছোরাটা কই, মিস্টার রানা?’
‘ববির শরীরে।’
‘আমি দেখেছি ওটা ব্যবহার করেননি আপনি।’
‘তুমি রাতকানা মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘কি দেখতে কি দেখেছ।’
‘যাকগে। ওটা এখন আপনার সাথে নেই। আপনি অতুলনীয়, মিস্টার রানা। কিন্তু অস্ত্রধারী তিনজনের বিরুদ্ধে অসহায়। কাজেই আস্তে করে উঠে পড়ে সামনে হাঁটা দিন। ঘুরবেন না। কোন ফন্দিফিকির করতে যাবেন না। জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান যদিও, তবে মারা পড়লেও খুব একটা দুঃখ পাবেন বলে মনে হয় না।’
রানার দায়িত্ব মালদিনির পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হওয়া। এখন সেধে যখন তার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, আপত্তি কিসের? তাছাড়া সশস্ত্র তিনজনের বিপক্ষে কিইবা করার আছে ওর। বিশেষ করে রানার দক্ষতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিগুণ সতর্ক রয়েছে যখন ওরা।
পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে তপ্ত সূর্যটা। সামনে হেঁটে গেল ওরা, পাশ কাটাল দড়িবদ্ধ কন্টেইনারগুলোর। শেষবারের মত মহাসাগরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। তারপর একটা দরজা পার হয়ে ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারে পা রাখল।
‘থামুন!’ আদেশ করল ম্যাকলিন।
রেডিও শ্যাকের দশ ফিটের মধ্যে এখন রানা। বেরিয়ে এল মেরী এন্ডারসন, রানার তলপেট বরাবর ধরে রয়েছে একটা কাটা শট-গান।
‘ক্যাপ্টেন বলেছেন, বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়া ব্যবহার করতে,’ বলল মেরী।
‘সে তো একদম নাক বরাবর,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তো?’
‘ইংরেজ দম্পতি দেখে ফেলতে পারে আমাদের। হাজার হলেও মিস্টার রানা এখন অসুস্থ রোগী। ভয়ঙ্কর ট্রপিকাল ফিভারে ধরেছে তাঁকে।’
‘অসুস্থ রোগীদের বয়ে নিয়ে যেতে হয়,’ বলল মেরী।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে মাথা খাটাতে হলো না রানার। পেছনে পদশব্দ হলো ওর। পরমুহূর্তে সাতটা সূর্য দপ করে জ্বলে উঠল রানার মাথার মধ্যে। এখন ঘনঘোর অন্ধকার।