কানপুরের খেলার মাঠে

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে সাবু বুঝতেই পারেনি কোথায় আছে। আশপাশে তাকাতেই দেখল কেউ চিৎ, কেউ কাৎ আবার কেউ উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। চেহারাগুলো তার চেনা চেনা মনে হয়। ভালো করে আশপাশে তাকাতেই মনে পড়ল গতকালের কথা।

গতকাল তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে কানপুরে ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছে। তাদেরকে কানপুর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। একদিনেই আট দলের খেলা হবে। আধা ঘণ্টা করে চলবে খেলা। তারপর আরেকটা খেলা। এভাবে দিন শেষেই পুরষ্কার বিতরণীও হয়ে যাবে। বেশ মজা হবে মনে হচ্ছে।

কাল রাতে সেলিম তেমন ভাত খেতে পারেনি। ভুল করে পানি ভেবে কানপুর স্পোর্টিং ক্লাবের রাধুনী জগপতির চোলাই মদ খেয়ে কেমন ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। মৃদু নাক ডাকার আওয়াজও আসছে। সেলিম দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড। সে ফিট না থাকলে অসুবিধা হয়ে যাবে। সেটা বেশ বুঝতে পারছে সাবু।

ঘড়ি দেখে সাবু। ছয়টা বাজে। এখনই ওঠা দরকার। একটু প্রাকটিস না করলে হচ্ছে না। কাল সারাদিন ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষে রাতে পেটপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছে সবাই। এখনও শরীর ভারি ভারি মনে হচ্ছে। একটু হালকা করা দরকার। সবাইকে ডেকে তোলে সাবু। সেলিম একটু গড়িমসি করতে থাকে। বলে, ‘তোরা যা, আমি আসছি।’ সবাই খেলার মাঠেই যায়। কাল রাতেই জেনে নিয়েছে মাঠটা কতদূরে এবং কোনদিকে।

মাঠে গিয়ে দেখে মাঠটি তেমন বড় না। ছোট মাঠ। এই মাঠে সারাদিন দৌড়া দৌড়ি করলেও হাঁপ ধরবে না বলে মনে হয়। তবে খেলার সময়ই বোঝা যাবে আসল ঘটনা। ওরা ঘণ্টা খানেক প্রাকটিস করে। মাঠের মাপ এবং ভালোমন্দ বুঝে নেয়। তবে তখনো সেলিমের চাঁদ মুখ কারো নজরে আসেনি। ক্লাবে ফিরে সবাই দেখে সে সেরকমই ঘুমে বিভোর হয় আছে।

খানিক পরে নাস্তা দেওয়া হলো। সে সময় ক্লাবের সভ্যরা সবাই চলে এসেছে। সবাই কেমন ড্যাব ড্যাব করে ওদের দিকে তাকাচ্ছে। রাতেই পরিচয় পর্ব শেষ হয়েছে তাদের। তবু কেমন অচেনা এবং সমীহের একটা ভাব সবার চোখে মুখে। ওদের প্রত্যেকের সামান্য নড়াচড়াও খুব খেয়াল করে দেখছে তারা। এতে ওদের একটু অস্বস্তি লাগলেও একেবারে মন্দ লাগছে না। নিজেদের কেমন যেনো হোমরা চোমরা গোছের লাগছে। সে সময় অন্য দলের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে কে কি খোঁজ নিয়ে এসেছে তা জানাতে লাগল। শুনে মনে হচ্ছে একেকজন বিরাট কিছু হবে।

মাঠের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। খেলোয়াড়রা মাঠে নামতেই করতালি আর চিৎকারে মাঠে কান পাতা দায়। মাঠের চারপাশে তো লোকজন বসে এবং দাঁড়িয়ে আছেই। এ ছাড়াও আশপাশের গাছের ডালে লটকনের মতো সাজিয়ে বসেছে দর্শকরা। খেলা শুরু হলো। ছোট ছোট পাসে বল এপায়ে ওপায়ে গড়াচ্ছে। বল গেলো সেলিমের পায়ে। সেলিম বল পেয়েই খেলোয়াড়দের কাটিয়ে ছুটল গোলের দিকে। দর্শকদের চিৎকারে তার উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো। ধাই করে এক কিক নিলো সে ক্রস বারের কোনা লক্ষ্য করে। গো…ও…ল!!

আনন্দে ভেসে গিয়ে কোথায় সবাই তাকে মাথায় নিয়ে নাচবে তা না কেমন যেনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই তার দিকে। পরে দর্শক এবং মাঠে খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে সে বুঝল গোলটি নিজেদের পোস্টেই ঢুকেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে খুব লজ্জা পেলো। এবার সে খেলায় মন দিলো। প্রথম ম্যাচটা ওরা হেসে খেলে জিতে গেলো। তবে সেলিম হলো ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

দ্বিতীয় ম্যাচে পায়ে চোট পেলো ছবুর। সেলিম এখনো সামান্য ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তবে বেশ কয়েকটি গোলও করেছে। জিততে কষ্ট হয়নি। পরের ম্যাচটাই হলো ফাইনাল। ফাইনালের আগে এক ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হলো। এর মধ্যে সবাই খাবে। ফাইনালে খুব লড়াই হলো। কোনো পক্ষই কম যায় না। গোল হয় না মোটেও। টান টান উত্তেজনা। শেষে খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে। সে সময়ও গোল হলো না। পরে টাইব্রেকারে জিতে গেলো কানপুর স্পোর্টিং ক্লাব।

ম্যাচ শেষে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো দর্শকরা মাঠে নেমে এলো। সাবুদের একেকজনকে মাথায় নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা গ্রাম ঘোরানো হলো। সেলিমকে সবাই খুব তোয়াজ করছে। ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছে সে। বিকেলে ক্লাবের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আজ রাতে সাবুদের রেখে দিবে। রাতে খাশি জবাই করে খাওয়ানো হবে।

সন্ধ্যায় টিপ টিপ বৃষ্টি নামল। ওরা কেউ রাতে থাকতে রাজি হয়নি। ওদের জেদের কাছে হার মেনেছে কানপুরের লোকজন। তাই চটজলদি খেয়ে দেয়ে রওনা দিয়েছে। মাঠের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে সবাই। সবার সামনে খোকন। সঙ্গে আরো অনেকেই আছে। একটা বিল পাড়ি দিতে হবে। তারপর একটু ঘুর পথ হলেও বাস পাওয়া যাবে। এজন্যই এ পথে আসা। ধান খেতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে চাঁদের আর মেঘের লুকোচুরি দেখে ওরা। মাঝে মাঝে টিপ টিপ বৃষ্টিও হচ্ছে।

বিলের গিয়ে কয়েকজন মিলে বিলের পানির নিচ থেকে একটা ছোট নৌকা টেনে তুলল। পানি সেচে সবাই উঠে পড়ল তাতে। আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে বড় একটা থালার মতো চাঁদ উঠেছে। জোসনার বানভাসি আলোয় বিলও ভেসে যাচ্ছে। অন্য এক জগতে যেনো পৌঁছে গেছে ওরা। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আকাশ কালো করে ঝপাঝপ বৃষ্টি নামল।

দেখতে দেখেতে সবাই ভিজে একাকার। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে নৌকা গেলো উল্টে। ব্যাস, প্রাণ যায় যায় আরকি। বহু কষ্টে সে যাত্রা রেহাই পেলো সাবুরা। সে রাতে অবশ্য আর তাদের বাড়ি ফেরা হলো না। আবার ফিরে যেতে হলো কানপুরে। রাতে আপ্যায়ন আর ভোজের কথা অনেকদিন মনে থাকবে সাবুদের।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!