কাক যখন বুঝতে পারল যে তার বউ-এর ডিম পাড়বার সময় এগিয়ে এসেছে, তখন সে ‘ কাকের বাসা’ বানানোর জন্য মহা তোড়জোড় শুরু করে দিল। প্রথমে ও একটা গাছ পছন্দ করে নিল। গাছটা একটু সরু এবং লম্বাটে। বেশ উপর দিকে গিয়ে সুন্দর ভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়েছে এবং প্রচুর শাখা-প্রশাখা দিয়ে পাতা-ভর্তি, ঘন একটা জায়গা তার মধ্যে তৈরি হয়ে এমন ভাবে আছে, যেখানে কিছু রাখলে চট করে নীচে পড়ে যাবে না। আবার, জায়গাটা বাইরে থেকে খুব দৃশ্যমানও নয়। তাছাড়া, গাছটা হল পুলিশ-ব্যারাকের পিছন দিকে। তার পরে, পিছনে শিমুল, আম আর কৃষ্ণচূড়া গাছও দু-তিনটে আছে।
কাক-বাবাজি কিছুদিন ধরে ছোট ছোট ডাল-পালা আর তারের টুকরো সংগ্রহ করে একটা বাসা মত বানিয়ে ফেলল বটে, কিন্তু একটু খুঁতখুঁতানি থেকে যাচ্ছিল। অবশেষে যেদিন সে বেশ রিস্ক নিয়ে ঝট করে বারান্দা দিয়ে ঢুকে সন্তুদের খাওয়ার টেবিলের উপর থেকে গোল স্টিলের বেড়ি-মতো জিনিসটা তুলে এনে বাসায় ফেলতে পারল সেদিন ও মাথাটা আকাশের দিকে করে দুই চোখ একসাথে বন্ধ করে কাক-দেবতাকে প্রণাম জানাল। কাকের কানে এখনও যেন ভাসে সন্তুর মায়ের চিত্কার—হায়, হায়, এ কী সব্বোনাশ ! মর, মর আপদ! আমি এখন গরম হাড়ি বসাব কীসের উপর রে, হতভাগা? সেকথা মনে এলেই কাকের হাসি পায়, তবে ওই বেড়িটা কিন্তু দারুন কাজে এসেছে। বাসাটার ভিতটা তো এখন দারুন মজবুত। অবশ্য তার জন্য কাক তার বউ-এর কাছ থেকে কোনও প্রশংসা আশা করেনি, পায়ওনি।
পিছনে, কৃষ্ণচূড়া গাছে এক কোকিল আর কোকিলা ( স্ত্রী-কোকিল) একসাথে থাকত। এক সন্ধ্যায় কোকিলা কোকিলকে ডেকে বলল, “আমার পেটে ডিম এসেছে। ডিম পাড়বার সময়ও তো হয়ে এল। এবার কিছু ব্যবস্থা তো নিতে হয়।”
কোকিল বলল, সে কি! আরেকটু আগে বলবে তো!
কোকিলা রাগ করে বলল, কাকে বলব, শুনি? তুমি তো দিনরাত পাখিদের গানের পাঠশালা নিয়ে পড়ে আছ। কোন কথা তুমি কানে তোল?
কোকিল বলল, শোনো, বাসা বাঁধা খুব নীচু কাজ। আমাদের খানদানে এসব চলে না। আমরা গুরু জাতি, গান হল আমাদের জগৎ। তুমি কি মনে করতে পারো, তোমার বাবা কোনও দিন একাজ করেছিলেন কিনা?
বাবা-র কথা উঠতেই কোকিলার চোখে জল এল। বাবা নেই, সে যে কত দিন হয়ে গেল!
কোকিল আবার বলল, ওই সামনের গাছটা খেয়াল করো। ওখানে এক কাক, তার বউ ডিম পাড়বে বলে, বাসা বেঁধেছে। মনে হয়, তোমাদের দুজনেরই ডিম পাড়বার সময়টা বোধ হয় একই। ওই কাক-বউ ডিম পেড়ে উড়ে যাবে। কাক একটু পরে এসে বসবে, ডিমে তা দেওয়ার জন্য। সেই ফাঁকে, তুমি ওদের বাসায় ডিম পেড়ে এস।
এবার কোকিলা বলল, এক হতচ্ছাড়া কাকও তার স্ত্রীর জন্য যা করে তুমি সেটাও করো না।
কোকিল বলল, আমার পাঠশালায় তালিম নিতে নিতে ময়নাটা ভালোই গান শিখেছে। ও সেদিন আমাদের এক বিখ্যাত শিল্পীর একটা গান শোনাল। গানের শুরুটা এই রকম, “ও কোকিলা, তোরে শুধাই রে। সকলেরই বাসা আছে, তোর কেন কোনও বাসা নাই রে।”
কোকিলা বলে উঠল, প্লিজ, গুল-গপ্প থামাও। আমার শরীরটা ভালো নেই।
কাকের এবং কোকিলের বউ একই সময় ডিম পাড়ল।
কোকিলা মাত্র একটা বড় ডিমই পাড়ল এবং সেটা ওকে কাকের বাসাতেই পাড়তে হল। কোকিলা তার গাছ থেকে ওই দিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি চালিয়ে যেতে লাগল।
দু-দিন পর কাক তার বউকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বায়সী, তুমি কটা ডিম পেড়েছিলে?
সে বলল, দুটো নাকি তিনটে বোধ হয়। কিন্তু কেন ?
কাক বলল, এখানে তিনটে ডিম দেখছি আর তার মধ্যে একটা একটু বড়ো সাইজের। এবার তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে বড়ো ডিম পাড়বে। কিন্তু, পুকুরের কচ্ছপ বলল যে অনেক সময় কোকিলা নাকি কাকের বাসায় ডিম পেড়ে পালায়। আমি অন্যের ডিমে তা দেব না। এই বড়ো ডিমটা দেখে কেমন সন্দেহ হচ্ছে। আবার ভাবছি, এটা যদি পরে একটা দাঁড় কাক হয়ে জন্মায়, তাহলে সমাজে আমাদের কত খাতির বাড়বে বল তো?
কাক-বউ বলল, তুমি যা পারো করো। আমি একটু বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। বাড়িতে আজ আমার জন্য বাবা ইলিশ মাছের মুড়ো এনেছে।
বউ চলে যাওয়ার পর কাক ঠিক করল যে একটা ডিম ও আজ ঠুকরে ভেঙ্গে ফেলে দেবে। পরে বউকে বোঝানোর জন্য অনেক বাজে কথা বলা যাবে।
কাকের রকম-সকম দেখে দূর থেকে কোকিলার মাথা তো খারাপ হবার জোগাড়। ও তার জীবনে এত অসহায় বোধ আর কখনও করেনি। সে কপালের উপরে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে শেষে কী হয়, সেটা দেখতে লাগল।
কাক বুদ্ধিমান জীব। সে অঙ্কের হিসাব করে, দুটো ছোট ডিমের মধ্যে একটা নষ্ট করে, বাকি দুটোকে তা দিতে লাগল। কোকিলার বুক থেকে যেন পাষাণভার নেমে গেল।
সময়মতো ডিম ফুটে দুটো বাচ্চাও বেরোল আর কাক ওদের খাওয়াতে লাগল।
তার তিন দিন পরে ক্ষিদের জ্বালায় দুটো বাচ্চাই চিৎকার করতে লাগল। একটা কর্কশ সুরে আর একটা মিহি গলায়। কাক অন্ধ-রাগে সুরেলা গলার বাচ্চা পাখিটাকে ঠোকরাতে লাগল।
সে তখন ডানা মেলে উড়ে গিয়ে বসল পিছনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে !