চৈত্র মাসের ডিম সেদ্ধ মার্কা রোদে অস্থির হয়ে ওড়াউড়ি করছে কেরামত মিয়া। পিপাসায় বেচারার ছাই রঙা ছাতি প্রায় ফাটে ফাটে অবস্থা! তার কাকচক্ষু দিয়ে আশেপাশের ত্রি-সীমানায় কোনো কাকচক্ষু জলাধার দূরের কথা, এক ফোঁটা পানির ছিঁটেফোঁটাও নজরে আসছে না। এটা একটা কথা হল! মানুষগুলোর মনেও কি একটু দয়ামায়া নাই! তারা কি পারে না ওর মতো পিপাসার্ত কাক-পক্ষীদের জন্যে দুই-এক কলসী পানি বাইরে রেখে দিতে? কলসী না পারুক, একটা গ্লাস রেখে দিলেও তো পারে! কাক বলে কি ওরা মানুষ না! তা না, ওদের কথা কারো মনে থাকবে কেন?
রোদের চোটে এমনিতেই মাথা গরম, তার ওপরে মেজাজটাও গরম হচ্ছে কেরামত মিয়ার। দুই গরম মিলিয়ে পানি না পেয়ে প্রাণটাই আঁইঢাঁই করতে থাকে তার। একটা তালগাছের মাথায় ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে বসে ছিল সে। আধামরা অবস্থা প্রায়। এমন সময়ে হঠাৎ দেখে এক বাড়ির কোণা দিয়ে একটা কলসী মতো কী যেন দেখা যায়। দেখামাত্র সাঁ করে উড়ে যায় সে কলসীর কাছে। বুকভরা আশা নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে কলসীর তলানিতে এই একটুখানি পানি দেখা যাচ্ছে! মুখটা তেতো হয়ে যায় তার। এই বাড়ির মানুষগুলোকে দুইটা গালি দিতে ইচ্ছা করছে! এইরকম খালি কলসী রাখার কী দরকারটা! পানি ভর্তি করে রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো! যতোসব কিপ্টা মানুষজন!
কিন্তু পানি খেতে তো হবে! বহুক্ষণ ধরে কলসীর মুখ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে সে চেষ্টা করতে থাকে যদি কোনোভাবে পানি পর্যন্ত ঠোঁটটা নেয়া যায়। কিছুতেই কিছু হল না। পানি খেতে গেলে বরং ধুপ করে কলসীর ভিতর পড়ে যাবারই পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। ভিতরে পড়লে পানি তো খেতে পারবে, কিন্তু তারপর বের হবে কী করে? পানি-টানি খেয়ে শেষে জানটা খোয়ানো আর কি! কলসীর মুখেই বসে বসে অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে কেরামত মিয়া। কী করা যায়!
হঠাৎই নজরে আসে কলসীটা থেকে একটু দূরে কিছু ছোট ছোট পাথর পড়ে আছে। বাচ্চাকাচ্চা খেলতে গিয়ে ফেলে গেছে মনে হয়। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা তার মাথার ওপরে যেন হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠে একটা! আরে, ওইদিন কাজ্ঞান ক্লাসে কনিষ্ক স্যার কী জানি পড়াচ্ছিলেন! কার্কিমিডিস নামের এক কাজ্ঞানী একদিন এক বালতি পানিতে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভীষণ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতেও তার মাথায় বিরাট এক কত্ত্বের উদ্ভব হয়। তিনি বালতিতে পড়ে যাওয়ামাত্র বালতির অনেকখানি পানি পড়ে গিয়েছিল। আর কার্কিমিডিসের সূত্র অনুসারে, একটি বস্তুকে কোনো স্থির তরল বা বায়বীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণ ডুবালে বস্তুটি কিছু ওজন হারায়। এই হারানো ওজন বস্তুটি দ্বারা অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থে ওজনের সমান। তার মানে বালতির পানিতে পড়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের শরীরের কিছুটা ওজন হারিয়েছিলেন। আর বালতিতে পড়ায় যতোটুকু পানি পড়ে গেছে সেই পানির ওজন আর তার শরীরের সেই হারানো ওজন এক সমান। এই ব্যাপারটা ক্লাসে বসে কিছুতেই কেরামতের মাথায় ঢোকে নি। এখনো যে ঢুকেছে তেমন না। কিন্তু এই সূত্রের সরল মানে দাঁড়ায় যে কেরামতের সামনে রাখা কলসীর ভিতরে কতোগুলো পাথর ফেললে তলানির পানি হয়তো ওপরে উঠে আসবে। যেহেতু বালতিতে কার্কিমিডিস পড়ে যাওয়ায় বালতির অনেকখানি পানি ছলকে পড়ে গিয়েছিল! বাকি ওজন-ফোজনের ব্যাপারটা ক্লাসে গিয়ে আবার কনিষ্ক স্যারকে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। একটা একটা করে পাথর মুখে তুলে কলসীর ভিতরে ফেলতে শুরু করে কেরামত। কিন্তু কয়েকটা ফেলার পরেই বুঝতে পারে কাহিনি অতো সহজ না! একে তো আগের থেকেই প্রচন্ড ক্লান্ত ছিল, তার ওপরে পিপাসার্ত ঠোঁটে পাথর আনা-নেয়া করতে করতে তার বুক পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে প্রায়। ডানাগুলোও আর চলে না। শ্রান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে তারা। এদিকে তলানির সেই পানিও মাত্র আধাআধি উঠে এসেছে। কার্কিমিডিসের কত্ত্ব দিয়ে পানি খেতে গেলে খাওয়ার জন্যে সে যে আর বেঁচে থাকবে না এটাই মনে হতে লাগল কেরামত মিয়ার। কী করা যায়! হতাশায় বাড়িটার চালের ওপর দুই দন্ড বসে দম নেয়ার মনস্থ করল সে।
মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে। ইহজীবনে তার কি আর পানি খাওয়া হবে না? এইভাবে পানির পিপাসায় একটু একটু করে মারাই যাবে সে? মনের দুঃখে বাড়ির উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে সে উদাস নয়নে। তখনি চোখে পড়ে এক কোণায় একটা প্লাস্টিকের লম্বা স্ট্র পড়ে আছে। ওই যে, যেগুলো দিয়ে মানুষের পোলাপানদের বোতল থেকে কীসব খেতে দেখে। কাকেরাও মাঝে মাঝে একটু আধটু খেয়ে ফেলে। তারপর কতোক্ষণের জন্য তাদের কেন যেন খুব খুশি-খুশি লাগতে থাকে! ব্যাপারটা কেন হয় এখনো বোঝে নি কেউ। কাজ্ঞানী কার্কিমিডিস বেঁচে থাকলে হয়তো বুঝে ফেলতেন।
যাইহোক, স্ট্র’টা দেখেই কেরামত মিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। নতুন উদ্যমে আবার উড়ে গিয়ে স্ট্র’টা মুখে নিয়ে কলসীর দিকে এগিয়ে যায় সে। সেটার আধাআধি পর্যন্ত পাথরে আর পানিতে ভর্তি। কলসীর মুখে বসে স্ট্রয়ের একদিক ঠোঁটে ধরে রেখে অন্যদিকটা ওই আধা-ভরা কলসীর ভিতরে নামিয়ে দেয় সে। অন্য অংশটা পানিতে ডুবে যাওয়ামাত্রই স্ট্র’তে এক টান দেয় সে। উঠে আসে হিমশীতল পানি। আরামে দুই চোখ বুজে আসে কেরামত মিয়ার। আহ!