কাক উপাখ্যান –সেলিম সাহাদাত

 

তখনো সূর্য ওঠেনি।

চারিদিকে ভোরের ঘন কুয়াশা। দূরের কিছুই দেখা যায় না।

বাড়ির চারপাশে সবুজ গাছপালাগুলো কুয়াশায় আড়াল হলেও ঘরের উঠোন গোবরে মাটি লেপায় হাতের রেখা স্পষ্ট।

ঘরের দাওয়ায় বসা সমিরনের সবুজ শাড়ির লাল পাড়ের আঁচলের নিচে বুকে ঝুলে থাকা গাছে পাকা পেঁপের মত স্তনে গাভীর ওলানে মাথা দিয়ে ডুশা মারা বাছুরের মত শিশুটি দুধপানে তার মাকে অস্থির করে তুলে।

মা সমিরন কোলে থাকা সন্তানকে সামলে ওঠার ফাঁকে-ফাঁকে অদূরে কাকটিকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

পরিশীলিত তন্বী মডেলের মত পাতিকাকটি উঠনে ঝাড়ুটির ওপর উপর্যুপরি হামলা চালায়। ওটি কোনো রসগোল্লা নয়। কিংবা অন্যকোনো সুস্বাদু খাদ্যও নয়। সেটি নিতান্তই নিরস শক্ত শলার ঝাড়ু, তাহলে কেন এর ওপর এত আক্রমণ-লুণ্ঠন?

চারিদিকে যখন পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ভাঙছে, তখন বাবুই পাখির মত মহান শিল্পী হয়ে নয়; কিংবা চড়ুই পাখির মত রাজ প্রাসাদে পরবাসী হয়েও নয়; নিতান্তই অস্তিত্বের প্রশ্নে, নিজের বাসা বানাবার প্রয়োজনে কালো কাকটি ঝাড়ুর শলা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি থেকে লোকজন বের হয়ে কাকের মত কা-কা সোরগোল তুলে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকে “বিদুøৎ নাই, জল নাই, মনুষের মনে শান্তি নাই, চারিদিকে শুধু হাহাকার”। অতিষ্ঠ গ্রামবাসী বিদুøতের দাবিতে আঞ্চলিক পল্লী বিদুøৎ অফিস ঘেরাও করলে নির্বাহী কর্মকর্তা ঘোষণা করেন ন্ধ “একটি কাক ট্রান্সমিটারের তারে বসতে যাওয়ার ফলে সেটি বাস্ট হয়ে যায়। এখন নতুন ট্রান্সমিটার না আসা পর্যন্ত আমরা আপনাদের গ্রামের বিদুøতের ব্যবস্থা করতে পারছি না।” উত্তেজিত গ্রামবাসী তরুণ-যুবকেরা অফিসে ইটের ঢিল ছুঁড়ে, হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে হামলা চালায়। অফিসের জানালার গ্লাস ভাঙে, দরজা ভাঙে, বারান্দায় আগুন জ্বালায়। এই হামলাগুলোতে অংশ নিতে না পেরে কেউ বা অফিসারের মা-বোনকে ভালবাসার চূড়ান্ত পরিণতির কথা জানায়। শুধু গ্রামের স্কুলের মাস্টার বলেন ন্ধ “কেবল বিদুøতের লোডশেডিং নয়, আজ দেশ ও জাতির মননে আলোহীনতা, পশ্চাৎপদতা, বন্ধ্যত্ব, অন্ধকারাচ্ছন্নতা; তার জন্য দায়ী কোন কাকেরা”? অফিসারদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছঁুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন ন্ধ “বলেন কোন কাকেরা?”

সেই অপরাধের অপমানে গ্রামের কাকগুলো ভোর ফজরে ঘরের পিছনের গাছে গাছে ক্ষোভে কা-কা চিৎকার করে ন্ধ ফেটে পড়ে। চাপা উত্তেজনায় গ্রামবাসীরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে, বাড়ির আঙিনায় বেরিয়ে আসে এবং কাকদের লক্ষ্য করে অবিরাম কাঁদানো গ্যাস, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। কাকগুলো উড়ে যাওয়ার আগে গ্রামের প্রতিটি গাছে-গাছে সন্ধ্যায় বিক্ষোভ-সমাবেশের ডাক দেয়।

এলাকায় দেখা দেয় টান-টান উত্তেজনা। গ্রামবাসীরা লাঠি-সোটা নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু দুপুর বেলায়ই দেখা যায়, পাড়ার যুবক ছেলেরা আমগাছের উঁচু ডালে কাকের বাসা থেকে ছোট ছোট কাকের বাচ্ছা নিয়ে এসে মাঠির ওপর আছাড় মারে, পায়ের নিচে পিষে ফেলে। তখন বাচ্চাগুলোর কা-কা চিৎকারে আশেপাশের কাকেরা কা-কা চিৎকারে ভীড় জমায়। তাদের সন্তানদের উদ্ধারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলে। তারা ঘোষণা করে ন্ধ “তাদের সন্তানদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে এবং সেই লক্ষ্যে আজই বিকাল ৪টায় গ্রামের খেলায় মাঠে এক বিরাট কাকসভার ডাক দেয়।”

বেলা ৪টার পর ৫টা হয়ে যায়, ক্রমে বেলা বিকেলে গড়ায়; কিন্তু কোথায় কাকসভা? গ্রামের মসজিদের পাশে ফুটবল খেলার মাঠে খোলা আকাশের নিচে সবুজ বিস্তীর্ণ দুর্বাঘাসে যে ঐতিহাসিক কাকসভা হওয়ায় কথা, যেখানে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ নাম না জানা অগণিত কালো-কালো কাকের সভা হওয়ার কথা। ভাষণ দিবে একের পর এক বক্তা। অগ্নিঝরা সেই ভাষণে তাদের ওপর নিপীড়ন-শোষণ আর বঞ্চনার কথা বলবে, বলবে আজন্ম লালিত স্বপ্ন-মুক্তির কথা। কিন্তু একি! পাতিকাক থেকে আপেক্ষাকৃত বড় মাথা, উঁচু ডানা, সুঠাম দেহী কয়েকটি দাঁড়কাক, সিনা ফুলিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, গর্জন করে হুঙ্কার ছঁুয়ে গোটা মাঠ কাঁপিয়ে বলে ন্ধ “আজ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর শান্তির লক্ষ্যে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। গ্রামে সকল প্রকার বিশৃংখলা-নৈরাজ্য রুখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হাতে দমন করা হবে। কোনো প্রকার নৈরাজ্য বর্দাস্ত করা হবে না।”

কিন্তু সেই কাকরা আজ কোথায়? যাদের এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে আসার কথা ছিল। কথা ছিল ঝাঁকে-ঝাঁকে আসবে, দলে-দলে আসবে। ডানার ঝাপটায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে আসবে। খাল থেকে আসবে, বিল থেকে আসবে। ক্ষেত ফেলে আসবে, গাছ ফেলে আসবে, মিছিলে মহাসমাবেশ কাকসমুদ্রে রূপ নিবে। কিন্তু আজ কোথায় তারা?

সমিরনের একচালা টিনের ঘরের পিছনে আমগাছটির ডালে দু’টি কাক নিবিড়ভাবে কাছে আসে। সোহার্দেø পরস্পর ঠোঁট ঘষে। তখন কেবল সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশে। চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। দক্ষিণা হাওয়ায় সবুজ পাতা নড়াচড়া করে। শিহরিত মনে প্রশ্ন জাগে, ওরাও কি যায় অভিসারে? কৌতূহল নিয়ে দেখা যায় ন্ধ একটি কাক মুখ হাঁ করে তার লকলকে লাল জিব বের করে ব্যাকুল হয়ে আছে, অপরটি তারই মুখের ভিতর খাবা তুলে দিচ্ছে।

হাল ফ্যাশানের বাউণ্ডেুলে ছেলের মাথায় হেয়ার জেল দেয়া খাড়া-খাড়া এলোমেলো চুলের মত বাসায় কাক বাস করে। আমগাছের উঁচু ডালে সেই বাসায় খড়কুটোর ওপর দেশী মুরগির ছোট ছোট ডিমের মত কাকের ডিমগুলোর সারা গায়ে সাদার মাঝে ছোপ ছোপ, কালো কালো দাগ। সেই ডিমগুলিকে কাকেরা ঝড়-বৃষ্টি থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। পাখার আড়ালে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। পরম মমতায় পালকের উষ্ণতায় ডিমগুলিকে ওম দেয়। স্বপ্ন দেখে, ওরাই একদিন অসমাপ্ত কাজ করবে। মনে পড়ে যায় হারানো সেই বাচ্চাকে। পাড়ার যুবকেরা যখন বাসা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। বুক খালি হওয়া জননীর মতোই কাকের দু’চোখ তখন জলে ভরে যায়।

আবার যদি ট্রান্সমিটার বাস্ট করার অপরাধে তাদের বাসায় হামলা চালায়, লুট করে নিয়ে ডিমগুলিকে যদি ভেঙে-চুরে দেয় সেই আশঙ্কায় কাকেরা আকাশে শূন্যের দিকে মুখ তুলে কা-কা প্রতিবাদ জানায়।

বৃষ্টিতে আকাশের গায়ে বিজলি বাতি চমকানোর মতো আঁকা-বাঁকা হয়ে কাকের ডিমগুলি মচ্‌-মচ্‌ করে ভেঙে যায়। সেই ডিম ফুটে যাওয়ার আওয়াজে কাকেরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আনন্দ-উৎসাহে দেখে ডিমের খোসার ভিতর থেকে ছোটছোট তুলতুলে বাচ্চা বের হয়। মাথায় তার ফুরফুরে হালকা পাতলা লোম। ডানায় তার পেন্সিলে আঁকা রেখার মতো কালো পালক।

কাকের রক্ত মাথায় উঠে যায়। রাগে-ক্ষোভে চোখ দু’টো লাল হয়ে যায়। চিৎকারে কণ্ঠনালী ফুলে যায়। বাচ্চাগুলোর ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীক্ষ্ন ফলার মতো ঠোঁটের ছোবলে বাচ্চাগুলির দেহ রক্তে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।

তখন চারিদিক থেকে ফজরের ভেসে আসা আজান শোনা যায়। রাতের অন্ধকার কেটে ভাতের ফেনের মতো গ্রাম-প্রান্তর কেবল ফর্সা হয়ে ওঠে। অনবরত ঠোঁটের ঠোকরে ঠোকরে বাচ্চাগুলিকে টেনে হিঁচড়ে গাছের ওপর থেকে মাটির নিচে ফেলে দেয়।

সেসময় গাছের উঁচু মগডালে কুহু-কুহু একটানা আর্তনাদ শোনা যায়।

অনলাইনঃ ৬ জুলাই, ২০০৯

 

তখনো সূর্য ওঠেনি।

চারিদিকে ভোরের ঘন কুয়াশা। দূরের কিছুই দেখা যায় না।

বাড়ির চারপাশে সবুজ গাছপালাগুলো কুয়াশায় আড়াল হলেও ঘরের উঠোন গোবরে মাটি লেপায় হাতের রেখা স্পষ্ট।

ঘরের দাওয়ায় বসা সমিরনের সবুজ শাড়ির লাল পাড়ের আঁচলের নিচে বুকে ঝুলে থাকা গাছে পাকা পেঁপের মত স্তনে গাভীর ওলানে মাথা দিয়ে ডুশা মারা বাছুরের মত শিশুটি দুধপানে তার মাকে অস্থির করে তুলে।

মা সমিরন কোলে থাকা সন্তানকে সামলে ওঠার ফাঁকে-ফাঁকে অদূরে কাকটিকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

পরিশীলিত তন্বী মডেলের মত পাতিকাকটি উঠনে ঝাড়ুটির ওপর উপর্যুপরি হামলা চালায়। ওটি কোনো রসগোল্লা নয়। কিংবা অন্যকোনো সুস্বাদু খাদ্যও নয়। সেটি নিতান্তই নিরস শক্ত শলার ঝাড়ু, তাহলে কেন এর ওপর এত আক্রমণ-লুণ্ঠন?

চারিদিকে যখন পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ভাঙছে, তখন বাবুই পাখির মত মহান শিল্পী হয়ে নয়; কিংবা চড়ুই পাখির মত রাজ প্রাসাদে পরবাসী হয়েও নয়; নিতান্তই অস্তিত্বের প্রশ্নে, নিজের বাসা বানাবার প্রয়োজনে কালো কাকটি ঝাড়ুর শলা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি থেকে লোকজন বের হয়ে কাকের মত কা-কা সোরগোল তুলে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকে “বিদুøৎ নাই, জল নাই, মনুষের মনে শান্তি নাই, চারিদিকে শুধু হাহাকার”। অতিষ্ঠ গ্রামবাসী বিদুøতের দাবিতে আঞ্চলিক পল্লী বিদুøৎ অফিস ঘেরাও করলে নির্বাহী কর্মকর্তা ঘোষণা করেন ন্ধ “একটি কাক ট্রান্সমিটারের তারে বসতে যাওয়ার ফলে সেটি বাস্ট হয়ে যায়। এখন নতুন ট্রান্সমিটার না আসা পর্যন্ত আমরা আপনাদের গ্রামের বিদুøতের ব্যবস্থা করতে পারছি না।” উত্তেজিত গ্রামবাসী তরুণ-যুবকেরা অফিসে ইটের ঢিল ছুঁড়ে, হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে হামলা চালায়। অফিসের জানালার গ্লাস ভাঙে, দরজা ভাঙে, বারান্দায় আগুন জ্বালায়। এই হামলাগুলোতে অংশ নিতে না পেরে কেউ বা অফিসারের মা-বোনকে ভালবাসার চূড়ান্ত পরিণতির কথা জানায়। শুধু গ্রামের স্কুলের মাস্টার বলেন ন্ধ “কেবল বিদুøতের লোডশেডিং নয়, আজ দেশ ও জাতির মননে আলোহীনতা, পশ্চাৎপদতা, বন্ধ্যত্ব, অন্ধকারাচ্ছন্নতা; তার জন্য দায়ী কোন কাকেরা”? অফিসারদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছঁুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন ন্ধ “বলেন কোন কাকেরা?”

সেই অপরাধের অপমানে গ্রামের কাকগুলো ভোর ফজরে ঘরের পিছনের গাছে গাছে ক্ষোভে কা-কা চিৎকার করে ন্ধ ফেটে পড়ে। চাপা উত্তেজনায় গ্রামবাসীরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে, বাড়ির আঙিনায় বেরিয়ে আসে এবং কাকদের লক্ষ্য করে অবিরাম কাঁদানো গ্যাস, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। কাকগুলো উড়ে যাওয়ার আগে গ্রামের প্রতিটি গাছে-গাছে সন্ধ্যায় বিক্ষোভ-সমাবেশের ডাক দেয়।

এলাকায় দেখা দেয় টান-টান উত্তেজনা। গ্রামবাসীরা লাঠি-সোটা নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু দুপুর বেলায়ই দেখা যায়, পাড়ার যুবক ছেলেরা আমগাছের উঁচু ডালে কাকের বাসা থেকে ছোট ছোট কাকের বাচ্ছা নিয়ে এসে মাঠির ওপর আছাড় মারে, পায়ের নিচে পিষে ফেলে। তখন বাচ্চাগুলোর কা-কা চিৎকারে আশেপাশের কাকেরা কা-কা চিৎকারে ভীড় জমায়। তাদের সন্তানদের উদ্ধারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলে। তারা ঘোষণা করে ন্ধ “তাদের সন্তানদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে এবং সেই লক্ষ্যে আজই বিকাল ৪টায় গ্রামের খেলায় মাঠে এক বিরাট কাকসভার ডাক দেয়।”

বেলা ৪টার পর ৫টা হয়ে যায়, ক্রমে বেলা বিকেলে গড়ায়; কিন্তু কোথায় কাকসভা? গ্রামের মসজিদের পাশে ফুটবল খেলার মাঠে খোলা আকাশের নিচে সবুজ বিস্তীর্ণ দুর্বাঘাসে যে ঐতিহাসিক কাকসভা হওয়ায় কথা, যেখানে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ নাম না জানা অগণিত কালো-কালো কাকের সভা হওয়ার কথা। ভাষণ দিবে একের পর এক বক্তা। অগ্নিঝরা সেই ভাষণে তাদের ওপর নিপীড়ন-শোষণ আর বঞ্চনার কথা বলবে, বলবে আজন্ম লালিত স্বপ্ন-মুক্তির কথা। কিন্তু একি! পাতিকাক থেকে আপেক্ষাকৃত বড় মাথা, উঁচু ডানা, সুঠাম দেহী কয়েকটি দাঁড়কাক, সিনা ফুলিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, গর্জন করে হুঙ্কার ছঁুয়ে গোটা মাঠ কাঁপিয়ে বলে ন্ধ “আজ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর শান্তির লক্ষ্যে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। গ্রামে সকল প্রকার বিশৃংখলা-নৈরাজ্য রুখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হাতে দমন করা হবে। কোনো প্রকার নৈরাজ্য বর্দাস্ত করা হবে না।”

কিন্তু সেই কাকরা আজ কোথায়? যাদের এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে আসার কথা ছিল। কথা ছিল ঝাঁকে-ঝাঁকে আসবে, দলে-দলে আসবে। ডানার ঝাপটায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে আসবে। খাল থেকে আসবে, বিল থেকে আসবে। ক্ষেত ফেলে আসবে, গাছ ফেলে আসবে, মিছিলে মহাসমাবেশ কাকসমুদ্রে রূপ নিবে। কিন্তু আজ কোথায় তারা?

সমিরনের একচালা টিনের ঘরের পিছনে আমগাছটির ডালে দু’টি কাক নিবিড়ভাবে কাছে আসে। সোহার্দেø পরস্পর ঠোঁট ঘষে। তখন কেবল সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশে। চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। দক্ষিণা হাওয়ায় সবুজ পাতা নড়াচড়া করে। শিহরিত মনে প্রশ্ন জাগে, ওরাও কি যায় অভিসারে? কৌতূহল নিয়ে দেখা যায় ন্ধ একটি কাক মুখ হাঁ করে তার লকলকে লাল জিব বের করে ব্যাকুল হয়ে আছে, অপরটি তারই মুখের ভিতর খাবা তুলে দিচ্ছে।

হাল ফ্যাশানের বাউণ্ডেুলে ছেলের মাথায় হেয়ার জেল দেয়া খাড়া-খাড়া এলোমেলো চুলের মত বাসায় কাক বাস করে। আমগাছের উঁচু ডালে সেই বাসায় খড়কুটোর ওপর দেশী মুরগির ছোট ছোট ডিমের মত কাকের ডিমগুলোর সারা গায়ে সাদার মাঝে ছোপ ছোপ, কালো কালো দাগ। সেই ডিমগুলিকে কাকেরা ঝড়-বৃষ্টি থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। পাখার আড়ালে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। পরম মমতায় পালকের উষ্ণতায় ডিমগুলিকে ওম দেয়। স্বপ্ন দেখে, ওরাই একদিন অসমাপ্ত কাজ করবে। মনে পড়ে যায় হারানো সেই বাচ্চাকে। পাড়ার যুবকেরা যখন বাসা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। বুক খালি হওয়া জননীর মতোই কাকের দু’চোখ তখন জলে ভরে যায়।

আবার যদি ট্রান্সমিটার বাস্ট করার অপরাধে তাদের বাসায় হামলা চালায়, লুট করে নিয়ে ডিমগুলিকে যদি ভেঙে-চুরে দেয় সেই আশঙ্কায় কাকেরা আকাশে শূন্যের দিকে মুখ তুলে কা-কা প্রতিবাদ জানায়।

বৃষ্টিতে আকাশের গায়ে বিজলি বাতি চমকানোর মতো আঁকা-বাঁকা হয়ে কাকের ডিমগুলি মচ্‌-মচ্‌ করে ভেঙে যায়। সেই ডিম ফুটে যাওয়ার আওয়াজে কাকেরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আনন্দ-উৎসাহে দেখে ডিমের খোসার ভিতর থেকে ছোটছোট তুলতুলে বাচ্চা বের হয়। মাথায় তার ফুরফুরে হালকা পাতলা লোম। ডানায় তার পেন্সিলে আঁকা রেখার মতো কালো পালক।

কাকের রক্ত মাথায় উঠে যায়। রাগে-ক্ষোভে চোখ দু’টো লাল হয়ে যায়। চিৎকারে কণ্ঠনালী ফুলে যায়। বাচ্চাগুলোর ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীক্ষ্ন ফলার মতো ঠোঁটের ছোবলে বাচ্চাগুলির দেহ রক্তে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।

তখন চারিদিক থেকে ফজরের ভেসে আসা আজান শোনা যায়। রাতের অন্ধকার কেটে ভাতের ফেনের মতো গ্রাম-প্রান্তর কেবল ফর্সা হয়ে ওঠে। অনবরত ঠোঁটের ঠোকরে ঠোকরে বাচ্চাগুলিকে টেনে হিঁচড়ে গাছের ওপর থেকে মাটির নিচে ফেলে দেয়।

সেসময় গাছের উঁচু মগডালে কুহু-কুহু একটানা আর্তনাদ শোনা যায়।

অনলাইনঃ ৬ জুলাই, ২০০৯

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!