প্রথম কাকটা বলল, “দেখছিস না, বেচারার ঘুড়ি নেই, লাটাই নেই, জুলজুল আকাশের পানে তাকিয়ে?
‘বাঁচিয়েছে। দ্বিতীয় কাক বলল, ঘুড়ির উৎপাতে আজ আমাদের যা নাকাল দশা! ছাদগুলো পর্যন্ত ভর্তি, কোথাও একটু বসার জো নেই!’
কিন্তু ছেলেটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে রে!
কী করবি? ঘুড়ি-লাটাই এনে দিবি?’ দিলে হয়। দেখি কোথাও থেকে ম্যানেজ করা যায় কি না ?
ব্যস, দুজনে উড়তে উড়তে কোথায় যে উধাও হল! টুকান স্তম্ভিত। ছিছি, এই কাকদের সে ঘেন্নাই করে এসেছে এতদিন! ঝাড়ুদার পাখি বলে অবজ্ঞাও তো কম করেনি। কিন্তু তারা যে আদতে এত সহৃদয়, টুকানদের মনখারাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, এই গুণের কথা কে জানত!
টুকান আশায় আশায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়েই আছে। দুমিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট…। নাহ, দুই পরভৃতের আর দর্শন নেই। নিজেকে এবার কেমন বোকা বোকা লাগতে শুরু করেছে টুকনের। সত্যি কি কাকের ভাষা বুঝতে পারে নাকি মানুষ? টুকান ভাবলই বা কী করে, কাক মানুষের কথা বুঝবে? ব্যাটারা চশমা, আংটি, ঘড়ি, টুকুরটাকুর তুলে নিয়ে যায় বটে, তবে তা নিশ্চয়ই কাউকে উপহার দিতে নয়? অতএব অন্যের ঘুড়ি-লাটাই টুকানকে এনে দেবে, এমন এক উদ্ভট ধারণাও তো মূখামি।
আস্তে আস্তে মেজাজ চড়ছিল টুকানের। কাক দুটো তাকে উপহাস করে গেল না তো? টুকানকে ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো ছাদে দাঁড় করিয়ে রাখাটাই হয়তো কাকদের একটা খেলা। না, এবার আর ছাড়ানছোড়ন নেই, যেখানেই কাক দেখবে ঠাঁইঠাঁই ইট ছুড়বে।
ছাদ থেকে একখানা ঢালা কুড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাল টুকান। কী আজব কাণ্ড, ধারে কাছে এখন একটাও কাক নেই!
কাক দেখা যায় না। কোনও মন্ত্রবলে পাড়ার কাকগুলো সব অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি?
টুকানের আর দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না। অপমানে গা রিরি করছে। বিস্বাদ মুখে সিঁড়ির দরজায় গেল। নামছে দোতলায়।
তিনটে ধাপও পেরোয়নি, ঘটাং শব্দ। তড়িঘড়ি ফিরে টুকান হা। আরে, এ যে সত্যি একটা সুতোভর্তি লাটাই গড়াগড়ি খাচ্ছে ছাদে! ডজনখানেক ঘুড়ির আস্ত বান্ডিলও। এবং কানিশে, জলের ট্যাংকের মাথায় সার সার কাক। তাদের মধ্যে কোনটা যে সেই প্রথম কাক, চেনা দায়।
একটা কাক ফটাস ফটাস ডানা ঝাপটাল, কী হে, চলবে তো? সবাই মিলে বহুৎ কসরত করে রতনবাবুর কারখানা থেকে তুলে আনলাম।”
পাশেরটি বলে উঠল, ওফ, কম কষ্ট! ঠোঁট দুটো টনটন করছে।’
টুকান আহ্বাদে গদগদ। দন্ত বিকশিত করে বলল, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ অল।
হয়েছে, হয়েছে। এবার মনের সুখে ঘুড়ি ওড়াও। শুধু আমাদের কথাটা একটু স্মরণে রেখো, এই যা।’
বলেই টুপটাপ উড়ে যাচ্ছে বায়সকুল। মিনিটখানেকের মধ্যে ছাদ বিলকুল ফাঁকা। টুকানও ঝটপট বেঁধে ফেলল কলকাটি। মেপেজুপে। ধরাই দেওয়ার কেউ নেই, একাই টংকা দিয়ে দিয়ে ওঠাচ্ছে ঘুড়ি। নিপুন হাতে সুতো ছেড়ে বাড়ল খানিকটা। একখানা চাঁদিয়াল আকাশ দাপাচ্ছিল এতক্ষণ, টুকনের চৌখুপ্পিকে দেখে সে যেন নড়েচড়ে উঠল। এগোচ্ছে গুটিগুটি। এক্ষুনি পাঁচ লড়বে টুকান ? চচ্চড়িয়ে টেনে হাওয়া করে দেবে ব্যাটাকে ।
সতর্কভাবে চাঁদিয়ালের পাশে চৌখুপ্পিকে নিয়ে গেল টুকান। গোঁৎ খেল একটু। চাঁদিয়াল মহা সেয়ানা, কিছুতেই তলায় ঢুকতে দিচ্ছে না চৌখুপ্পিকে। কাছাকাছি এসেও পিছলে গেল চৌখুপ্পির সীমানা থেকে। টুকান মরিয়া হয়ে আরও কিছুটা সুতো ছাড়ল। খাড়া উঠে গেছে চাঁদিয়ালের মাথায়। এবার হয় এসপার, নয় ওসপার। আক্রমণ সে হানবেই।
তোড়জোড় সমাধা করে সবে টুকান চৌখুপ্পিকে আড়াআড়ি টেনেছে, পিঠে হঠাৎ ধাক্কা, কী রে, অঙ্ক কষতে কষতে ঘুমিয়ে পড়েছিস যে বড় ?
টুকান ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। মা!
কী কাণ্ড, এতক্ষণ কি তাহলে স্বপ্নে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল?
মা পিঠ থেকে হাতটা সরাননি। আবার একটা ঠেলা দিয়ে বললেন ‘ওঠ, চান-খাওয়া সেরে নে।’
টুকান চোখ রগড়ে বলল, কটা বাজে ? ‘সাড়ে এগারোটা। খেয়ে ফের অঙ্ক নিয়ে বসবে। যদি দুপুরের মধ্যে পুরো এক্সারসাইজ শেষ না হয়, তাহলে…’
‘কী তাহলে ?’
‘কাল বিশ্বকৰ্মা পুজোর দিন তোমার ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ। তোমার বাবা ঘুড়ি-লাটাই আনলেও তুমি হাতে পাবে না।’
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফিক করে হেসে ফেলল টুকান। কাল বিশ্বকৰ্মা পুজোর দিন মা ঘুড়ি ওড়াতে দেবেন না, এই দুর্ভাবনা থেকেই কি এমন আজগুবি স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ? ইশ, আর একটু দেরিতে ডাকলে দিব্যি চাঁদিয়ালটাকে কেটে দিত সে। থাক, কাল নয় ব্যাটাকে ধরবে।
উঠে দাঁড়িয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙল টুকান। প্রফুল্ল মেজাজে মানে যাচ্ছে, হঠাৎই দৃষ্টি আটকেছে জানলায়। বাইরে একটা কাক বসে, গ্রিলের ঠিক ওপারটায়। কেমন যেন মিচকে চোখে হাসছে না কাকটা ?
ভুরু নাচিয়ে টুকান বলল, কী রে, কিছু বলবি?
কাক ঠোঁট খুলল, ক ক কা?
‘হ্যাঁ রে বাবা, হ্যা। তোদের কথা মনে আছে।’
‘খা খা খক্।
‘ঘুড়ির বদলে রোজ একটু করে ভাত? বেশ, তাই পাবি৷
বলেই টুকান থমকেছে। এবং চমকেছেও কম নয়। এ সে পরিষ্কার কাকের ভাষা বুঝতে পারছে। জেগে উঠেও! এ কী করে সম্ভব ?
কে জানে, হয়তো বা স্বপ্লেই কাকের ভাষা শিখে ফেলল টুকান!