গত দুই ঘণ্টা রাশাদ ‘গরুর’ রচনা লেখার চেষ্টা করছে। বাংলা বাড়ির কাজে বত্রিশটি বানান ভুল আবিষ্কার করার পর রাশাদের বাবা আফতাব সাহেব ছেলেকে ডেকে বলেছেন, ‘বত্রিশটা বানান ভুলের জন্য থাপড়ায়ে তোর বত্রিশ দাঁত ফেলে দেওয়া উচিত। আফসোস তোর দাঁত বত্রিশটা না। মানুষ ইংরেজি, অঙ্কে দুর্বল হয় বলে শুনেছি। বাংলায় দুর্বল হয় কখনো শুনিনি। গরু কোথাকার!’ রাশাদ দাঁড়িয়ে রইল। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোর শাস্তি হলো, নির্ভুল বানানে গরুর রচনা লেখা। আমি হাটে যাচ্ছি গরু কিনতে। ফিরে এসে দেখব।’ রাশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘গরুটা নিয়ে আসো, তারপর দেখে দেখে না হয় বর্ণনা লিখি?’ বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেখার দরকার হলে আয়না দেখিস!’ কাজেই রাশাদ রচনা লেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু লেখা এগোচ্ছে না।
তার সামনে অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ বসে আছে। সে নিজেকে দাবি করছে ‘গরু’ বলে। ‘দেখেন, আব্বু আম্মু একটু পরই বাসায় ফিরে আসবে। উনারা আসার আগেই চলে যান।’ সাফ সাফ বলে রাশাদ। তার একটু ভয় ভয় করছে। কাজের খালা গেছেন ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে। এখনো কেন আসছেন না, এটা এক রহস্য। লোকটা হেসে বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ? এককালে গরু ছিলাম। মাথায় শিং ছিল। তখন ভয় পেলে একটা না হয় কথা ছিল…’ রাশাদ ঠিক বুঝতে পারছে না এই লোকটা বাসায় ঢুকল কীভাবে! বাপ-দাদার আমলের দারোয়ান ইদ্রিস মিয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে মশাও ঢুকতে পারে না। আর এই লোক তার রুমে বসে অবিকল গরুর মতো জাবর কাটছে! সে অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, ‘আপনি তাহলে কাউম্যান?’ লোকটা দুঃখ দুঃখ মুখে জবাব দিল, ‘এক গরু আরেক গরুকে বিশ্বাস করে। গরুরাই ভালো।’ রাশাদ লক্ষ করল, লোকটা পকেট থেকে ঘাসের মতো কী যেন বের করে খাওয়া শুরু করেছে।
সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনি মানুষ হলেন কীভাবে?’ লোকটা ঘাস খাওয়া বন্ধ করে উত্তর দিল, ‘সে এক বিরাট ইতিহাস। আমি ছিলাম অতি দুষ্টু গরু। প্রায়ই অন্যের জমি নষ্ট করে রাখালদের শিং দিয়ে গুঁতো মারতাম। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘বিদেয় হ। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। মানুষ হ গে যা।” গরুদের অভিশাপ খুব লেগে যায়। আর অমনি আমি মানুষ হয়ে গেলাম।’ রাশাদ সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষ হলে তো আপনার খুশি হবার কথা, দুঃখ পাচ্ছেন কেন?’ লোকটা জাবর কাটা বন্ধ করে বলল, ‘পিঠ চুলকাতে খুব কষ্ট হয়। আগে লেজ ছিল আরামে মশা-মাছি তাড়াতাম। এখন খুব অসুবিধে। দুই পায়ে হাঁটাও কষ্টের।’ রাশাদ একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়। লোকটা পাগল না সত্যিই গরু? হঠাৎ লোকটা অবিকল গরুর মতো ‘হাম্বা’ বলে ডাকতে শুরু করল। রাশাদ আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘জানেন বাবা প্রায়ই বলেন আমি নাকি গরুর চেয়েও অধম। গরুর চেয়ে অধম ব্যাপারটা কী জিজ্ঞেস করতেই বাবা বললেন, তুই হলি গরু আর তোর ছোট চাচা হলো গরুর চেয়েও অধম।’ লোকটার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।
সে গরুর মতো হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। রাশাদ খাতির জমানোর চেষ্টা করল, ‘ছোট চাচাকে আমি কখনো দেখিনি। জন্মের দুই বছরের মাথায় উনি বাইরে চলে গেছেন। আম্মু বলেন উনার মতো মজার আর আজব মানুষ নাকি দুনিয়ায় নাই। আমার সব জন্মদিনে গিফট পাঠান, অথচ তাঁর চেহারাটাও আমার মনে নেই। বাসায় উনার অনেক পুরাতন কিছু ছবি আছে…’ লোকটা আবার হাম্বা ডাকা শুরু করল। আচ্ছা, লোকটাকে কি সে তার ক্লাস টিচারের গল্পটা বলবে? অবশ্য একটা গরুকে মানুষের ব্যাপার বোঝানো কষ্টের। কলিংবেলের শব্দে রাশাদ দৌড়ে যায় দরজা খুলতে, তার পেছনে যায় গরু মানব। রাশাদের বাবা-মা দুজনই হাজির। রাশাদ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আব্বু, এই দেখ একটা গরু…’ বাবা একটা কঠিন ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়, ‘বেয়াদব! চাচাকে গরু বলছিস?’ আম্মু পাল্টা ঝাড়ি দিলেন, ‘তোমার থেকেই তো শিখেছে।
আবরারকে সব সময় গরু বলো।’ আবরারের দিকে তাকিয়ে হড়বড়িয়ে বললেন, ‘তুমি সারা জীবন এত আজবই রয়ে গেলে। কোনো খবর নাই, হুট করে উপস্থিত। ইদ্রিস মিয়া ফোন করে তোমার কথা বলতেই আমি মার্কেট থেকে দৌড়ে এলাম। এসে দেখি তোমার ভাইও গরু নিয়ে উপস্থিত। আচ্ছা, সাথির মা কোথায়? তুমি কিছু খেয়েছ?’ আবরার তাকে থামালেন, ‘ভাবি, তুমি অস্থির হয়ো না। সাথির মাকে বললাম, আপনার হাতের ডিম রান্না সেই কবে খেয়েছি এখনো মুখে লেগে আছে। শুনেই ছুটল দোকানে। ঘরে নাকি ডিম নেই। তা ভাইজান, গরুটা কত নিল? খুশির খবর হলো আমি ঈদ তো করবই, সেই সাথে বাংলাদেশে পুরোপুরি চলে এসেছি!’ রাশাদ এতক্ষণ শুধু শুনছিল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এটাই তার ছোট চাচা! এতক্ষণ গরুর অভিনয় করে তাকে বোকা বানাল! ছোট চাচার দিকে তাকাতেই তিনি হাসিমুখে একটা চোখ টিপ দিলেন!