কাইল্লা চোরা( পর্ব:-০৪(শেষ পর্ব))-সোহেল রানা

পরদিন গ্রামে এক সাধু বাবা ডাকা হলো গ্রাম থেকে কাইল্লা চোরার আত্মা দূর করতে। সাধু বাবা সারা গ্রামে একবার চক্কর দিয়ে এসে একটা বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। লম্বা লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-এই গ্রামে পাপ লেগেছে পাপ, ধ্বংস করে ছাড়বে…’
কিছু জনতা ভয়েভয়ে প্রশ্ন করলো,
-এখন উপায়?
-ভয় নেই, আমি তো আছি। তবে টাকা একটু বেশি খরচ হবে। এই আত্মাটা গ্রাম থেকে তাড়াতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে, তাই আমার ফিও একটু বেশি।’
সাধুবাবার কথা শোনে একজন বললো,
-বাবা, আপনি যতো টাকা চান, আমরা দেবো। তবুও এই আত্মাটাকে গ্রাম থেকে দূর করুন। আত্মাটা আমার খুব সমস্যা করতেছে।
-কেন? কী করেছে তোমাকে?
-লজ্জার কথা কী বলবো বাবা? ঘুমানোর সময় কখনও আমার লুঙ্গি খুলে যায় না। কিন্তু আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার লুঙ্গিটা গলায় চলে এসেছে। আমি নিশ্চিত বাবা, এটা কাইল্লা চোরার আত্মার কাজ।
-তুমি ঠিক ধরেছো, এটা আত্মাটার কাজ। এভাবে সে সবাইকে জালাবে।’
সাধু বাবার কথা শেষ হতেই একজন মহিলা বললো,
-হ্যাঁ বাবা, গতরাতে তো ও আমাদের বাসায় এসেছিল নাম পাল্টিয়ে, আমার স্বামী তো…’
পরের ইতিহাসটা আর বলতে দিলো না মহিলার স্বামী। কারণ এতে তার ইজ্জত জড়িয়ে আছে। স্ত্রীকে বাধা দিয়ে স্বামী বললো,
-ঐ আর কি বাবা, আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম।’
এবার সাধু বাবা বললেন,
-এবার বুঝো, এখন থেকেই আত্মাটা সবাইকে জালাতন শুরু করেছে। ওটাকে তাড়াতে ফি একটু বেশি লাগবে।’
তখন আরেকজন উঠে বললো,
-আমরা সবাই টাকা দিতে রাজি বাবা। আপনি কাজ করুন। নয়তো আমাকে আত্মাটা মেরে ফেলবে। গতরাতে আমাকে মারতে গেছিল আত্মাটা মুখে মাটি মেখে। আমি জিজ্ঞেস করায় আরও বলে কি না ওটা নাকি মাটির মেকআপ। আমি তখনই সন্দেহ করেছিলাম ওটা কাইল্লা চোরার আত্মা। কিন্তু আমার রাজা, রাজা মানে আমার বিড়ালটা ঠিকই চিনেছে ওকে। পশুপাখিরা নাকি এসব খারাপ আত্মা দেখলেই চিনে। আমার রাজাও চিনেছে, কিন্তু কীভাবে সেটা আমাকে বলবে? তাই মাঝরাতে আত্মাটার মুখে মুতে দিয়ে মাটির মেকআপটা সরিয়ে দিয়েছে। যাতে আমি চিনতে পারি। রাজার কারণেই এ যাত্রায় আমি বেঁচে গেলাম। পরেরবার কী হবে জানি না। আপনি তার আগেই আত্মাটা দূর করুন গ্রাম থেকে। আমরা সবাই টাকা তুলতেছি।
-বেশ! আমি তাহলে সাধনা করে কাইল্লা চোরার আত্মাটা ডাকতেছি।’
-বাবা, কী বলেন? ও এখানে আসলে তো আমাদের ছাড়বে না।’
সাধু বাবার কথায় জনতা ভয় পেয়ে গেল। সাধু বাবা তাদের অভয় দিয়ে বললেন,
-ভয় নেই, তোমাদের কিছুই করবে না। আমি ওর সাথে কথা বলে চলে যেতে বলবো।’
.
.
এরপর সাধুবাবা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসলেন। ওদিক থেকে ধলু সবাইকে বটগাছতলায় দেখে সব সত্যি স্বীকার করার জন্য আসছিল। যেভাবে হোক আজ সবার ভুল ভেঙে দিবে সে। তাকে আসতে দেখে জনতা কাঁপতে লাগলো। কয়েকজন ভয়েভয়ে সাধু বাবাকে বললো,
-বাবা, ও আসতেছে… বাবা ও কাছে চলে এসেছে।’
-আরে কী হয়েছে, ধ্যানের সময় ডিস্টার্ব করো কেন মশায়?’ সাধু বাবা একটু রেগে গেলেন। তখন একজন ধলুর দিকে ইশারা করে সাধু বাবাকে বললো,
-বাবা, কাইল্লা চোরার আত্মা চলে এসেছে।’
ধলুকে দেখে আত্মা ভেবে সাধু বাবাও ভয় পেয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি করে উঠে পালিয়ে যেতে চাইলেন উনি। আত্মার সামনে পড়ে এভাবে নিজের জানটা হারাতে চান না উনি। বেঁচে থাকলে এরকম অনেক টাকা আয় করা যাবে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারছে না সাধু বাবা, তার এমন ভণ্ড ধ্যানে কী করে আত্মাটা চলে এলো?
.
সাধু বাবা আর পালাতে পারলেন না, তার আগেই ধলু এসে তার পা ধরে বললো,
-বাবা, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন বাবা, এখানে সবচেয়ে আপনাকে ভালো লোক মনে হচ্ছে, দাড়িগোঁফ আছে। সবাইকে একটু বলুন আমাকে না মারতে।’
দাড়ির কথা শুনেই সাধু বাবা তার নকল দাড়িটা ঠিকঠাক করে নিলো। পালিয়ে যেতে চাওয়ার সময়, তার নকল দাড়িটা ডানপাশে একটু উঠে গিয়েছিল। সেটা ঠিক করে ধলুকে বললেন,
-বেশ! তার আগে বলো তুমি এই গ্রাম থেকে চলে যাবে। আমি এই গ্রামে এসেছি আত্মা দূর করতে। তোমার মতো অনেক আত্মাকে বশ করেছি। প্রয়োজনে মেরেছি। তুমি যদি এই গ্রাম থেকে না যাও, তাহলে তোমার অবস্থাও ওসব আত্মাদের মতো হবে।’
সাধু বাবা এখন আর ভয় পাচ্ছেন না। কেন ভয় পাবেন? আত্মা স্বয়ং তার পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছে, এটা তো গর্বের বিষয়। সাধু বাবা বুক ফুলিয়ে সবার দিকে তাকালেন, যেন বলতে চাইলেন, ‘দেখলে তো আমার কেরামতি! যেই সেই বাবা না আমি। স্বয়ং আত্মা পর্যন্ত ভয় পায় আমাকে।’
কিন্তু ধলুর পরের কথায় সাধু বাবা হতাশ হলেন। ধলু বললো,
-বাবা, আমি তো আত্মা না।’
-কী বললা তুমি? তুমি আত্মা না? আমার সামনে মিথ্যে কথা?’
-হ্যাঁ, বাবা ও মিথ্যে বলছে। ও আত্মা। ওকে আমরা মেরে গতকাল কবর দিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে দেখি, ও আবার কবর থেকে উঠে বসেছে।’
জনতার কথায় ধলু বুঝলো কেন ওরা তাকে আত্মা মনে করছে। কালুর মৃত্যুর কথা শুনে সে খুশি হলো, কিন্তু কষ্টও পেল। ভাই বলে কথা। সবার মিথ্যে ধারণাটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য ধলু হেসে বললো,
-আপনারা ভুল করছেন, আপনারা যাকে মেরেছেন ও আমার ভাই কালু, আর আমি ধলু।’
জনতা এবার ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে গিয়ে বললো,
-দেখলেন সাধু বাবা, ও কতবড় মিথ্যেবাদী চোর! মরার পরও খারাপ রয়ে গেল। ও যদি ধলু হয়, তাহলে দেখতে এমন কালো কেন? ও আসলে কালুর আত্মা। আপনার সামনে বাঁচার জন্য এরকম করতেছে।’
জনতার কথা শোনে সাধু বাবার বুকটা আরেকটু ফুলে উঠলো। তিনি বললেন,
-হ্যাঁ, তাই তো দেখতেছি। আমি না থাকলে যে আজ কী হতো! যাইহোক, ও যতক্ষণ মিথ্যে বলবে, ততক্ষণ ওকে ধরে সবাই মারতে থাকো। আর তোমরা যে টাকাগুলো তুলেছো, ওগুলো আমাকে দিয়ে দাও, আমার আবার একটু তাড়া আছে, চলে যেতে হবে।’
-কিন্তু বাবা, আপনি চলে যাওয়ার পর যদি ও আবার আমাদের মারে?
-আরে মারবে না। আমি দূর থেকেই কন্ট্রোল করবো আত্মাটাকে।
-আচ্ছা বাবা…’
.
.
সাধু বাবা টাকা নিয়ে চলে যেতেই জনতা ধলুকে মারতে শুরু করলো, আর বলতে লাগলো।
-শালার আত্মা, যতক্ষণ গ্রাম ছেড়ে যাবি না, ততক্ষণ তোকে মারতে থাকবো।’
বেচারা ধলুর আর মার খাওয়ার শক্তি নাই। যে শক্তিটুকু তার গায়ে অবশিষ্ট ছিল, সেই শক্তি দিয়েই সে বললো,
-ভাইরে, আমাকে আর মেরো না। আমি এখনই চলে যাচ্ছি এই গ্রাম ছেড়ে।’
ধলুর কথায় জনতা মার থামিয়ে বললো,
-তাহলে চলে যাও।’
-যাচ্ছি, তোমরা দুইমিনিট চোখ বন্ধ করো। এরই মধ্যে আমি চলে যাবো।
-কেন? চোখ বন্ধ করবো কেন?
-আমি তো আত্মা। আর আত্মা তো সবার সামনে উধাও হতে পারে না…
-ঠিক আছে, আমরা চোখ বন্ধ করলাম।’ বলেই সবাই চোখ বন্ধ করলো। একজন চোখ বন্ধ করে নিজের লুঙ্গিটা শক্ত করে ধরে থাকলো, যাতে কাইল্লা চোরার আত্মা উধাও হওয়ার সময় তার লুঙ্গিসহ উধাও না হয়।
সবাইকে চোখ বন্ধ করতে দেখে ধলু যেন আবার সব শক্তি ফিরে পেয়েছে। এমন এক দৌড় দিলো, জনতা চোখ খুলে আর তাকে দেখলো না।
দৌড়াতে দৌড়াতে ধলু তার ভাইয়ের কবরের পাশে এসে থামলো। তারপর কবরের দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বললো,
-ভাইরে, তুই মরে গিয়েও আমায় শান্তি দিলি না….
.
.
(সমাপ্ত)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!