কাঁপতে শেখা–জার্মানের রূপকথাঃশেষ পর্ব

তাকে দেখে রাজার ভালো লাগল । তিনি বললেন, “বেশ । দুর্গে তিনটে জিনিস নিয়ে যেতে পার তুমি। কিন্তু কোনো জীবন্ত জিনিস নয় ।”

ছেলেটা বলল, “মহারাজ ! আমাকে তা হলে এই তিনটে জিনিস দিন—প্রথমটা একটা আগুন । দ্বিতীয়টা ছুতোরের বেঞ্চি । তৃতীয়টা ছুরি লাগানো একটা লেদমেশিন ।”

ছেলেটার কথামতো জিনিসগুলো সেদিনেই রাজা পাঠালেন দুর্গে । রাত হতে ছেলেটা সেখানে গিয়ে একটা ঘরে আগুন জ্বালিয়ে ছুতোরের বেঞ্চি আর ছুরিটা পাশে রেখে লেদমেশিনের কাছে গিয়ে বসল। বলল, “যদি কাঁপতে পারতুম । কিন্তু মনে হচ্ছে—কী করে কাঁপতে হয়, এখানেও শিখব না ।”

মাঝ রাত নাগাদ আগুন জ্বালাবার জন্য বাতাস করতে গিয়ে এক কোণ থেকে হঠাৎ নানা স্বরে তার কানে এলঃ “মি-ও, মি-ও, ঠাণ্ডায় যে জমে গেলুম ” *

ছেলেটা বলল, “বোকার ঝাড় । কেন মিউ-মিউ করছিস ? শীত করে তো আগুন-তাতে বসে নিজেদের সেকে নে-না ?”

তার মুখ থেকে কথাগুলো খসবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড দুটো কালেট বেড়াল হুড় মুড়িয়ে লাফাতে-লাফাতে এসে দু পাশে বসে লাল টকটকে চোখ মেলে তার দিকে ভয়ংকর দৃস্টিতে তাকাল। খানিক আগুন পুইয়ে তাকে তারা বলল, “দোস্ত । আমাদের সঙ্গে এক হাত তাস খেলবে ?

সে বলল, “নিশ্চয়ই । কিন্তু আগে তোমাদের থাবাগুজো দেখাও।” বেড়াল দুটো তার দিকে থাবা বাড়িয়ে দিল । সে বলল, “ও মা । কী কাণ্ড ৷ কী বড়ো-বড়ো নথ । একটু সবুর কর । এক্ষুনি কেটে দিচ্ছি ।”

বলে ঘাড় খামচে ধরে তুলে ছুতোরের বেঞ্চিতে বসিয়ে সেখানে তাদের থাবাগুলো স্ক্রুপ দিয়ে এঁটে সে বলল, “এই আঙুলগুলো দেখার পর তোমাদের সঙ্গে তাস খেলার আর ইচ্ছে নেই ।”

তাই-না বলে তাদের মেরে ফেলে জলে তাদের সে ছুড়ে ফেলল । কিন্তু তার পর আগুনের পাশে সে বসতে না বসতেই সেখানকার সব গর্ত আর কোণ-টোন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল লাল কালো বেড়াল আর কালো কুকুরের দল । প্রত্যেকেই টেনে আনছিল গন গনে লালচে শেকল ৷ গুণে তাদের শেষ করা যায় না ।

সবাই তারা ভয়ংকর স্বরে চীৎকার করতে লাগল । তার পর চেস্টা করতে লাগল সে-যে আগুনের পাশে বসেছিল সেটা তছনছ করে নিভিয়ে ফেলতে । খানিক চুপচাপ সে সইল । শেষটায় অসহ্য হয়ে উঠলে লেদ মেশিনের সেই ছুরিটা বার করে কচকচ করে তাদের কাটতে কাটতে সে চেঁচিয়ে উঠল, “দুর হ হতচ্ছাড়ার দল ।” সেগুলোর কতক পালাল, বেশির ভাগই মরল । যেগুলো মরল সেগুলোকে সে ছুড়ে ফেলল বাইরের পুকুরে ।

ফিরে এসে নিজের শরীরকে গরম করার জন্য আগুনের আঁচ ফুঁ দিয়ে সে গনগনে করে তুলল। তার পর সেখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমে জড়িয়ে এল তার দু চোখ । চারি দিকে তাকিয়ে সে দেথল এক কোণে মত্ত বড়ো একটা খাটে বিছানা পাতা। “আঃ, কী আরাম।” বলে সেই বিছানায় শুয়ে সে চোখ বন্ধ করতে না করতেই দুর্গময় চলতে শুরু করল খাটসুদ্ধ বিছানাটা ।

চেঁচিয়ে বলল সে, “ঠিক আছে । যত পার জোরে দৌড়োও।” সঙ্গে সঙ্গে সেই খাটটাও পাগলের মতো ছুটে চলল নানা ঘরের চৌকাঠ আর সিঁড়ি দিয়ে । যেন আধ-ডজন ঘোড়া সেটাকে টেনে নিয়ে চলেছে । হঠাৎ দুম-দুম, করে একটা শব্দ হল আর বিরাট একটা পাহাড়ের মতো খাটসুদ্ধ বিছানাটা পড়ল তার উপর উপুড় হয়ে । লেপতোষক-বালিশ ছুড়ে সরিয়ে সে বলল, “যার খুশি সে এবার এটায় চড়ে বসুক।” এই-না বলে নিজের আগুনের পাশে গিয়ে শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

 

পরদিন সকালে রাজা এসে তাকে মাটির উপর পড়ে থাকতে দেখে ভাবলেন ভূতেরা তাকে মেরে ফেলেছে । বললেন, “আহা বেচারা : ছেলেটার চেহারা ভারি সুন্দর ছিল ।”

রাজার কথাগুলো শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছেলেটা বলল, “রাজামশাই ! এখনো আমি মরি নি ।” রাজা অবাক হলেন, খুশিও হলেন । তার পর জিজ্ঞেস করলেন কেমন সে আছে ।

ছেলেটা বলল, “খুব ভালো আছি, রাজামশাই ! একটা রাত কেটেছে । অন্য দুটো রাতও কাটবে ।”

সরাইখানায় ছেলেটা ফিরতে অবাক হয়ে চোখ গোল-গোল করে – তার দিকে তাকিয়ে সরাইখানার মালিক বলল, “ভাবি নি তোমাকে বেঁচে ফিরতে দেখব । কী করে কাঁপতে হয় শিখেছ কি ?”

ছেলেটা বলল, “না— একেবারে পণ্ডশ্রম । কাঁপুনি ব্যাপারটা কী— কেউ যদি আমায় বলতে পারত ।”

দ্বিতীয় রাতে সেই পুরনো ঠাণ্ডা কেল্লায় গিয়ে আগুনের পাশে বসে, আবার সে বিড় বিড় করতে শুরু করল, “যদি কাঁপতে পারতাম । যদি কাঁপতে পারতাম ! যখন মাঝ রাত তখন প্রথমে দুরে শোনা গেল দারুণ হৈচৈ । শব্দটা ক্রমশ বাড়তে-বাড়তে মুহুর্তের জন্য থামল, আর তার পর চিমনির ভিতর দিয়ে আধখানা মানুষ পড়ল তার কাছে গড়িয়ে । ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল, “আরে । কী কাণ্ড । আর আধখানা গেলে কোথায় ?”

তার পর আবার শুরু হল দারুণ হৈ-হল্লা আর বাকি অর্ধেক শরীরটাও পড়ল গড়িয়ে । —

ছেলেটা বলল, “একটু সবুর কর । আগুনটা খানিক উস্কে দি ।” আগুন উসকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে ছেলেটা দেখে সেই আধখানা শরীর দুটো জোড়া লেগেছে আর তার বসার জায়গায় গিয়ে বসেছে ভয়ংকর বীভৎস চেহারার একটা লোক ।

ছেলেটা বলল, “আরে । বেঞ্চিটা যে আমার ” লোকটা তাকে ঠেলে সরাতে গেল। কিন্তু ছেলেটা তাকে জোর কারে ঠেলে সরিয়ে বেঞ্চিতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। তারপর আরো নানা লোক এল গড়িয়ে গড়িয়ে । তাদের সঙ্গে বড়ো-বড়ো নটা হাড় আর দুটো মানুষের মাথার খুলি । ভাটা খেলার জন্য হাড়গুলো তারা সাজাল । ছেলেটারও ইচ্ছে হল খেলতে । তাই সে বলল, “আমি খেলতে পারি ?”

তারা বলল, “টাকা থাকলে খেলতে পার ।” ছেলেটা বলল, “টাকাকড়ি যথেস্টই আছে । কিন্তু এই খুলিগুলো মোটেই গোল নয়।” নিজের লেদমেশিনে খুলিগুলো চড়িয়ে সেগুলো গোল করে সে বলল, “এগুলো এখন অনেক ভালো গড়াবে ৷ এসো, খেলা শুরু করা যাক ৷”

তাদের সঙ্গে খেলা শুরু করে কিছু পয়সাকড়ি সে হারল । কিন্তু যেই-না তং তং করে বারোটা বাজা অমনি হঠাৎ সব-কিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটা তখন চুপচাপ শুয়ে পড়ল ঘুমিয়ে ।

তৃতীয় রাতে আবার নিজের বেঞ্চিতে বসে দারুণ বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠল, “যদি শুধু কাঁপতে পারতাম।”

হঠাৎ সেখানে হাজির হল একটা লোক । সেরকম লম্বা মানুষ আগে কখনো সে দেখে নি । চেহারাটাও তার ভয়ংকর। লোকটা বুড়ো । লম্বা তার সাদা দাড়ি ।

বুড়োটা চেঁচিয়ে বলল, “হতচ্ছাড়া । শিগগিরই কাঁপতে শিখবি । কারণ মরতে তোর আর দেরি নেই।”

ছেলেটা উত্তর দিল, “অত তড় বড়, কোরো না । মরতে হলে প্রথমে আমার অনুমতির দরকার ।”

ভূতটা গর্জে উঠল, “এক্ষুনি তোকে নিকেশ করে ফেলছি।” ছেলেটা বলল, “গলা ফাটিয়ে বড়াই কোরো না । আমার তো মনে হয় তোমার চেয়ে আমার গায়ের জোর অনেক বেশি ।”

বুড়োটা চেঁচিয়ে উঠল, “সেটা দেখা যাবে। আমার চেয়ে তোর গায়ের জোর বেশি হলে তোকে ছেড়ে দেব । আয়, লড়ে যাওয়া যাক ৷”

নানা অন্ধকার বারান্দা দিয়ে একটা জায়গায় তাকে সে নিয়ে এল । সেখানে ছিল একটা কামারশালা। একটা কুড়ুল তুলে এক কোপে বুড়োটা কামারের দুটো নেহাইয়ের একটাকে মাটিতে গেঁথে ফেলল ।

“ওটার চেয়েও বেশি আমি করতে পারি” বলে ছেলেটা গেল অন্য নেহাইয়ের কাছে । বুড়োটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল।

জুলে পড়ল তার লম্বা সাদা দাড়ি । ছেলেটা সেই কুড়ল তুলে অন্য নেহাইটাকে শুধু দু টুকরোই করে ফেলল না, সেইসঙ্গে নেহাইয়ের মাঝখানে শক্ত করে গেঁথে দিল বুড়োর দাঁড়ি ।

 

সে চেঁচিয়ে উঠল, “এইবার তোমায় পাকড়েছি । এবার মরবার পালা তোমার ”

তার পর লোহার একটা ভাণ্ডা তুলে সে পেটাতে শুরু করল বুড়োটাকে । বুড়ো কাতরাতে-কাতরাতে ছেড়ে দেবার জন্যে তাকে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল । বলল, মার থামালে তাকে দেবে অনেক ধনদৌলত । ছেলেটা তাই কুড়লটা টেনে তুলে বুড়োর দাড়ি খুলে দিল।

বুড়ো তখন তাকে আবার দুর্গের মধ্যে নিয়ে এসে দেখিয়ে দিল মোহর ভর্তি বিরাট তিনটে সিন্দুক । বলল, “এর একটা গরিবদের, একটা রাজার আর তৃতীয়টা তোমার ।”

তার কথা শেষ হতে-না-হতেই ঘড়িতে তং ঢং করে বারোটা বাজল আর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হল বুড়ো ভূত । অন্ধকারে একলা ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল ।

সে বলল, “এখান থেকে বেরুনো শক্ত হবে না।” হাতড়ে-হাতড়ে নিজের ঘরে ফিরে তার আগুনের কাছে সে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।

পরদিন সকালে আবার রাজা এসে বললেন, “মনে হচ্ছে কাঁপতে তুমি শিখেছ ।”

ছেলেটা উত্তর দিল, “মোটেই না, রাজামশাই । কাঁপুনি জিনিসটা কি ?

এক দাড়িওলা বুড়ো এসে অনেক মোহর দেখিয়েছিল, কিন্তু কি করে যে কাঁপতে হয় সে কথা বলে নি ।”

রাজা বললেন, “দুর্গটাকে তুমি জাদুমুক্ত করেছ । তাই আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে ।”

ছেলেটা বলল, “সে তো খুব ভালো কথা । কিন্তু এখনো যে শিখলাম না কাঁপুনিটা কী জিনিস ”

তার পর সেই-সব মোহর আনা হল আর খুব ধুমধাম করে হয়ে গেল বিয়ে । সেই তরুণ রাজা খুব সুখী, বউকেও খুব ভালোবাসে । কিন্তু থেকে থেকেই বলে ওঠে, “যদি কাঁপতে পারতাম.। যদি কাঁপতে পারতাম।” কথাগুলো শুনতে শুনতে শেষটায় তার বউয়ের ভারিরাগ ধরে গেল। তাই দেখে তার দাসী বলল, “আমি এর বিহিত করছি । কী করে কাঁপতে হয় শিখিয়ে দেব ।”

বাগানের মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত ছোটো একটা নদী । সেখান থেকে এক বালতি ছোটো-ছোটো মাছ সে নিয়ে এল । রাজকন্যেকে সে বলল রাতে তার বর ঘুমিয়ে পড়লে বিছানা-ঢাকা তুলে মাছ ভর্তি বালতির জল তার গায়ে ঢেলে দিতে, মাছগুলো যাতে তিড়িংবিড়িং করে তার গা-ময় লাফাতে থাকে ।

রাজকন্যে তাই করল আর জেগে উঠে তরুণ রাজা চীৎকার করতে লাগল, “আমি কঁপিছি—উঃ—উঃ—কেন আমি কাঁপছি ? বউ, এখন জানলাম কাঁপনি কাকে বলে ।”

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!