কাঁপতে শেখা–জার্মানের রূপকথাঃ ২য় পর্ব

নয়তো সিঁড়ির নীচে তোমায় ছুঁড়ে ফেলব।” পুরুতমশাই ভাবলেন, ‘সত্যিই কি আর ছুঁড়ে ফেলবে । তাই তিনি পাথরের মূতির মতো চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ।

ছেলেটা তৃতীয়বার হাঁক ছাড়ল । কিন্তু তাতেও কোনো ফল হল না দেখে ছুটে গিয়ে সেই ভুতকে এমন জোরে সে ঠেলা মারল যে, দশটা সিঁড়ি গড়িয়ে এক কোণে ভূত পড়ে রইল স্থির হয়ে । ছেলেটা তার পর খানিক ঘণ্টা বাজিয়ে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ল । কাউকে কোনো কথা বলল না। এদিকে পুরুতমশাইয়ের বউ অপেক্ষা করে বসে রয়েছে । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও স্বামীকে ফিরতে না দেখে ভয় পেয়ে ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে প্রশ্ন করল, “আমার স্বামী কোথায় জানো? তোমার আগেই তিনি ঘণ্টাঘরে গিয়েছিলেন ।”

ছেলেটা বলল, “জানি না তো ! কিন্তু জানলার উলটো দিকের সিঁড়িতে কে একজন দাঁড়িয়েছিল । আমার ডাকে সে না দিল সাড়া, না গেল চলে । তাই ভাবলাম লোকটা হয়তো বদমাশগোছের কেউ । তাকে সিঁড়ির নীচে ঠেলে ফেলে দিয়েছি। গিয়ে দেখুন লোকটি আপনার স্বামী কি না । পুরুতমশাই হলে সত্যিই আমি খুব দুঃখিত।”

 

পুরুতমশাইয়ের বউ ছুটে গিয়ে দেখে এক কোণে পড়ে তার স্বামী গোঁ-গোঁ করছে । কারণ পড়ার ফলে তার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল।

পুরুতমশাইকে ধরে ধরে বাড়ি এনে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে ছেলেটার বাবাকে পুরুতমশাইয়ের বউ বলল, “তোমার ছেলে আমার সর্বনাশ করেছে । এমন জোরে সিঁড়ি দিয়ে আমার স্বামীকে ঠেলে ফেলেছে যে, তার একটা পা গেছে ভেঙে ৷ হতচ্ছাড়াটাকে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাও ।”

খবর শুনে আঁতকে উঠল ছেলের বাবা । পুরুতমশাইয়ের বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে দারুণ গালমন্দ করে বলল, “এ-সব শয়তানীর মানে কী ? নিশ্চয়ই তোকে দানোয় ভর করেছে ।”

তার ছেলে বলল, “বাবা । বিশ্বাস কর আমার কোনো দোষ নেই । আমার কথাটা শোনো । রাতে উনি দাঁড়িয়েছিলেন যেন কোনো কু-মতলব নিয়ে । আমি জানতাম না উনি কে । তিনবার তাকে বলি, “হয় আমার কথার জবাব দিতে, নয় চলে যেতে।”

তার বাবা বলল, “তুই আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁক করেছিস । তুই আমার দু চক্ষের বিষ ॥—দূর হ ।”

ছেলেটা বলল, “বেশ তাই যাব, বাবা শুধু ভোর হতে দাও । ভোরে বেরিয়ে পড়ব । শিখব কী করে কাঁপতে হয় । সেটা শিখলে হয়তো জানতে পারব কী করে রুজি-রোজগার হয় ।”

 

তার বাবা বলল, “যা-কিছু শেখো গিয়ে । সেটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। এই নে পঞ্চাশ ডলার । বেরিয়ে পড় । কিন্তু খবরদার । কাউকে বলবি না কোথা থেকে এসেছিস । কাউকে বলবি না তোর বাপের নাম কী । তোর জন্যে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে ।”

ছেলেটা বলল, “যা বললে তাই হবে । এটা আর বেশি কথা কী ?” ভোর হলে সেই পঞ্চাশ ডলার পকেটে গুঁজে ছেলেটা পথে বেরিয়ে পড়ল । হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে সে কেবল আউড়ে যায়, “কাঁপতে যদি পারতাম। কাঁপতে যদি পারতাম ।’

হঠাৎ পথে দেখা গেল আর-একটা লোককে । ছেলেটার বিড় বিড়, করে কথাগুলো সে শুনেছিল । খানিক হাঁটার পর একটা ফাঁসিকাঠ চোখে পড়তে ছেলেটাকে সে বলল, “ওরে শোন । ঐ যে গাছটা দেখছিস, ওখানে এক সঙ্গে সাত-সাতটা ডাকাতকে লটকানো হয়েছে । গাছতলায় বসে থাক । রাত হলে শিখবি কী করে কাঁপতে হয় ।”

ছেলেটা বলল, “এটা আর শক্ত কী ? অনায়াসে পারব । অত চট্‌পট্‌ কাঁপতে শিখলে আমার এই পঞ্চাশ ডলারের পুরোটাই তোমায় দিয়ে দেব । কাল সকালে এসো ।”

সেই ফাঁসিকাঠটার কাছের গাছতলায় গিয়ে বসে পড়ল ছেলেটা । রাত হল । খুব ঠাণ্ডা । ছেলেটা আগুন জ্বালাল । কিন্তু মাঝরাতে এমন ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করল যে, আগুন সত্ত্বেও শরীর আর গরম হয় না । বাতাসে সেই ডাকাতদের মড়াগুলো এদিক-সেদিক দুলতে-দুলতে খট্‌খট্‌ করতে লাগল । ছেলেটা ভাবল, ‘আগুন-তাতে আমি শীতে কাঁপলে, গাছের ওপর ও-বেচারাদের কতই-না জানি শীত করছে ।” তাই সে একটা মই দিয়ে উঠে সেই সাতটা ডাকাতের মড়া এক-এক করে নামিয়ে আনল, তার পর খুঁচিয়ে আগুনের আঁচ গন গনে করে তাতিয়ে তোলার জন্যে সেগুলোকে রাখল আগুনের চার পাশে । তাদের পোশাকে আগুন ধরতেও মড়াগুলো কিন্তু নড়ল না । তাই-না দেখে ছেলেটা বলল, “সাবধান ! নয়তো আবার তোমাদের গাছে লটকে দেব ।” কিন্তু ডাকাতদের মড়াগুলো তার কথা শুনতে পেল না । চুপচাপ রইল তারা । তাদের পোশাক জ্বলতে লাগল ।

তাই-না দেখে ছেলেটা দারুণ রেগে উঠল । বলল, “তোমরা সাবধান না হলে আমি আর কী করব ? তোমাদের সঙ্গে আমি তো আর পুড়ে মরতে পারি না।” আবার তাদের সারি সারি গাছে লটকে দিয়ে গাছতলার আগুন-তাতে বসে সে ঘুমিয়ে পড়ল ।

পরদিন সকালে সেই লোকটা তার কাছে এসে পঞ্চাশ ডলার চেয়ে বলল, “আশাকরি এখন বুঝেছ—কী করে কাঁপতে হয়।”

ছেলেটা বলল, “না-না, কী করে বুঝব ? বেচারারা তো একবারও মুখ খোলে নি । ভারি তারা বোকা–নিজেদের পোশাক পুড়লেও কোনো কথা বলে না ” .

লোকটা বুঝল সেদিন তার কপালে পঞ্চাশ ডলার পাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না । যাবার সময় তাই সে বলে গেল, “জম্মেও এরকম মশকরা দেখি নি ।”

ছেলেটা আবার যাত্রা শুরু করল । আর যেতে যেতে আপন-মনে জাগল বিড় বিড়, করতে, “কাঁপতে যদি পারতাম । কাঁপতে যদি পারতাম ।”

তার পিছন-পিছন আসছিল এক গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান । ছেলেটার কথা শুনে সে প্রশ্ন করলে, “কে তুমি ?”

ছেলেটা বলল, “জানি না ।”

গাড়োয়ান আবার প্রশ্ন করল,

“কোথা থেকে আসছ ?”

জানি না!”

“তোমার বাবার নাম কী ?”

“সেটা তোমায় বলতে পারব না ।” “বিড় বিড় করে কী-সব বকছিলে ?”

ছেলেটা বলল, “আমি শুধু জানতে চাই কী করে কাঁপতে হয় । কিন্তু কেউ আমায় সেটা শেখায় না ।” –

গাড়োয়ান বলল, “বাজে বকবক থামাও ! আমার সঙ্গে এসো । তোমার থাকার ভালো একটা ব্যবস্থা করে দেব ।”

তার সঙ্গে গেল ছেলেটা । সন্ধেয় তারা একটা সরাইখানায় পৌছল। স্থির করল, সেখানেই রাত কাটাবে। .ঘরে এসে ছেলেটা আবার চেঁচিয়ে উঠল, “যদি কাঁপতে পারতাম । যদি শুধু কাঁপতে পারতাম”

সরাইখানার মালিক আড়িপেতে কথাগুলো শুনে বলল, “কাপুনি শিখতে চাও ? — বেশ কথা। এখানেই তার সব চেয়ে ভালো সুযোগ পাবে ।”

বউ তাকে মুখ-ঝামটা দিয়ে বলল, “থামো তো । অনেক গোঁয়ার লোক ওখানে মরেছে । এ-ছেলেটার চোখদুটো ভারি সুন্দর। ঐ চোখে দিনের আলো আর সে দেখতে না পেলে আমার দুঃখের অবধি থাকবে না ।”

ছেলেটা কিন্তু বলল, “কাজটা,কঠিন হলে আমি তো শিখবই । তাই তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি।” সরাইখানার মালিককে প্রশ্ন করে করে জেরবার করে তুলল সে । শেষপর্যন্ত সরাইখানার মালিককে কবুল করে তাকে জানাতে হল সব ব্যাপারটা। ছেলেটা শুনল কাছেই রয়েছে একটা মায়াবী দুর্গ ৷ সহজেই সেখানে যে-কোনো লোক শিখতে পারে—কী করে কাঁপতে হয় । শুধু দরকার সেখানে তিনটে রাত কাটানো । রাজা বলেছেন সেখানে তিন রাত যে কাটাবে তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবেন । মেয়েটির মতো রাপসী আর হয় না । সেই দুর্গে আছে রাশি রাশি গুপ্ত ধনদৌলত। সেগুলো পাহারা দিচ্ছে যখের দল আর ডাকিনী-যোগিনীরা । অনেকেই সেই দুর্গে গিয়েছিল; কিন্তু প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে নি ।

পরদিন ছেলেটা রাজার কাছে গিয়ে বলল, “রাজামশাই । রাজা– মশাই ! আপনি অনুমতি দিন। ঐ মায়াবী দুর্গে তিন রাত কাটাতে আমি প্রস্তুত ।”

 

 

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!