টুকুদের বাইরের হেলান দেয় খোলা জানালার পাশে সেই পুরনো বাদাম গাছটা। গাছটার ঠিক মাঝ ডালে দু’টি কাকের বাসা। তার একটিতে বেশ কয়েকদিন আগে দু’টি কাকের ছানা চোখে পড়লো টুকুর। ছানা দু’টি চোখের পলকেই একটু একটু করে বড় হতে লগলো। মা কাকটি এসে বাচ্চা দু’টিকে খাবার দিয়ে যায়। কখনো মুখ ঘেষে আদর করে খাইয়ে দেয় ঠোঁট দিয়ে।
ঠিক দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বাদাম গাছে চোখ রেখে এক অনাবিল ভালো লাগায় হারিয়ে যায় টুকু। মা-বাবা সন্তানকে কী অসীম আদর-মায়া-মমতা দিয়ে বড় করে। এই কাকের বাচ্চা দু’টিকে না দেখলে সে বুঝতে পারতো না। টুকুর বাবা নেই। বাবা চিরদিন কারো বেঁচে থাকে না। তবে টুকুর বাবাটা একটি সড়ক দূর্ঘটনায় অকালেই হারিয়ে যায়। সে থেকে মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা আর পরম যত্নে ওরা দু’ ভাই-বোন বড় হতে থাকে।
ভাইয়া কাকের বাচ্চা দু’টির একটি নেইরে। ছোট বোন টুসির কথায় ছ্যৎ করে ওঠে টুকুর বুকটা। কোথায় গেলো সেই বাচ্চাটা। মা-কাকটি অকেক্ষণ ধরে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার খোঁজে এদিকে সেদিক ঘোরাঘুরি করলো। শেষে হতাশ হয়ে ডালে বসে তারস্বরে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো।
পড়াশোনার চাপে বেশ ক’দিন জানালার পাশে বসে বাদাম গাছটার দিকে চোখ দেয়া হয়নি টুকুর। আজ চোখ পড়াতেই টুকু খেয়াল করলো কাকের বাচ্চাটি গায়ে গতরে একটু যেনো বড় হয়েছে। মা কাকটি আগের মতো বাচ্চাটিকে খাবার মুখে তুলে দিতে চায় না । বাচ্চাটি যাতে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেই ইচ্চা মা কাকটির। তবু ও বাচ্চার করুণ আকুতির কাছে হার মানে মা কাকটি। সব প্রতিজ্ঞা ভুলে বাচ্চার মুখে সংগ্রহ করে আনা খাবার তুলে দেয়।
টুকুদের শহরের বাসার কিছু দূরে মজা পুকুরের পাড়ে রন্টি, মনি ও শাহেদ বসে আড্ডা দেয়। কেউ কেউ মোবাইলে গেইমস নিয়ে সময় কাটায়। ওদের সাথে টুকুর খুব ভাব। একটু ফাঁক পেলেই তাদের সাথে মিলিত হয় টুকু। কড়া শাসনের মধ্যে থাকে বলে সব সময় এ দিকে তার আসা হয় না। টুকুকে দেখে রন্টি বলে, আজ ক’দিন পর এলি? টুকু বলে মনটা ভালো ছিলোনারে। মনি বলে- কেনো, তোর মন ভালো নেই কেনো? টুকু বলে আমাদের বাদাম গাছের কাকের বাসা থেকে একটি বাচ্চা কে বা কারা নিয়ে গেছে। সে জন্যে বাচ্চাটির মা রোজ রোজ ডালে বসে কা-কা করে কাঁদে। তার সেই কান্নার আওয়াজে আমার মনটা খুব বিষিয়ে ওঠে। সেই জন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। শাহেদ বললো, একটি কাকের বাচ্চার জন্যে তোর এত দরদ। এ রকম চুনোপুটির মন নিয়ে তুই কি করে ডাক্তার হবি। তারচে বরং তুই কবি হয়ে যা। ভালো করবি। টুকু বলে আমার তো ইচ্ছে কবি হই। কিন্তু মায়ের স্বপ্নকে ভঙ্গ করি কি ভাবে? সেই মা, বাবা মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরেছেন। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তাদের দু’ভাই বোনকে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন।
পুনশ্চ শাহেদ বললো, গ্রীষ্মের ছুটিতে তুই কী বাড়ি যাবি?
টুকু বলে, অবশ্যই যাবো। আম-কাঠালের মৌ-মৌ ঘ্রাণে চাচাতো ভাইদের সাথে ক’দিন কাটিয়ে আসবো। তা ছাড়া আমাদের গ্রামটা খুবই সুন্দর। একবার গেলে ফিরে আসতে মন চায় না। ওরা বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো। এক সময়ে সন্ধ্যা নেমে এলে যে যার বাড়ি মুখো হলো।
স্কুল ছুটি হতেই পরদিন টুকুরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সকালে ৭টার ট্রেন ধরলো ওরা। ট্রেনে বসে ছোট বোন টুসির সে কি আনন্দ। অনেকদিন পর চাচাতো বোন ও টিনা হেনার সাথে দেখা হবে। ওদের সাথে ছুটিয়ে বেড়ানোর সে কি আনন্দ। তা টুসি ছাড়া আর কেউ জানে না।
ঝকর ঝক করে ট্রেন চলছে। টুকুর একটু তন্দ্রা ভাব এসেছিল। হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টির ঝাপটায় তার ঘুম ভাব উবে গেলো। ট্রেনটা তখন একটা পুল পেরিয়ে যেতেই দু’পাশে অনেকগুলি গাছের সারি চোখে পড়লো তার।
টুকু ভাবে, এই বৃষ্টিতে মা কাক আর তার বাচচাটির খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি। সেই কষ্টটা যেনো তার বুকেও এসে লাগছে। হঠাৎ এক কোমল হাতের স্পর্শে টুকু জেগে উঠে। দেখে, মা-ঠিক বাবার মতোই তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।