শশধর। সতীশ, একটু ঠাণ্ডা হও। তোমার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, সে কি আমি জানি নে। তোমার মাসি রাগের মুখে কী বলেছেন, সে কি অমন করে মনে নিতে আছে। দেখো, গোড়ায় যা ভুল হয়েছে তা এখন যতটা সম্ভব প্রতিকার করা যাবে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
সতীশ। মেসোমশায়, প্রতিকারের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। মাসিমার সঙ্গে আমার এখন যেরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে তাতে তোমার ঘরের অন্ন আমার গলা দিয়ে আর গলবে না। এতদিন তোমাদের যা খরচ করিয়েছি তা যদি শেষ কড়িটি পর্যন্ত শোধ করে না দিতে পারি, তবে আমার মরেও শান্তি নেই। প্রতিকার যদি কিছু থাকে তো সে আমার হাতে, তুমি কী প্রতিকার করবে।
শশধর । না, শোনো সতীশ, একটু স্থির হও। তোমার যা কর্তব্য সে তুমি পরে ভেবো— তোমার সম্বন্ধে আমরা যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকেই করতে হবে। দেখো, আমার বিষয়ের এক অংশ আমি তোমাকে লিখে দেব— সেটাকে তুমি দান মনে কোরো না, সে তোমার প্রাপ্য। আমি সমস্ত ঠিক করে রেখেছি— পরশু শুক্রবারে রেজেস্ট্রি করে দেব।
সতীশ । ( শশধরের পায়ের ধুলা লইয়া ) মেসোমশায়, কী আর বলব— তোমার এই স্নেহে—
শশধর। আচ্ছা, থাক্ থাক্। ও-সব স্নেহ-ফ্নেহ আমি কিছু বুঝি নে, রসকষ আমার কিছুই নেই— যা কর্তব্য তা কোনোরকমে পালন করতেই হবে এই বুঝি। সাড়ে আটটা বাজল, তুমি আজ কোরিন্থিয়ানে যাবে বলেছিলে, যাও। সতীশ, একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। দানপত্রখানা আমি মিস্টার ভাদুড়িকে দিয়েই লিখিয়ে নিয়েছি। ভাবে বোধ হল , তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন— তোমার প্রতি যে তাঁর টান নেই এমন তো দেখা গেল না। এমন-কি, আমি চলে আসবার সময় তিনি আমাকে বললেন, সতীশ আজকাল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে না কেন।
ওরে রামচরণ, তোর মা-ঠাকুরানীকে একবার ডেকে দে তো।
সুকুমারী । কী স্থির করলে।
শশধর । একটা চমৎকার প্ল্যান ঠাউরেছি।
সুকুমারী । তোমার প্ল্যান যত চমৎকার হবে সে আমি জানি। যা হোক, সতীশকে এ বাড়ি হতে বিদায় করেছ তো?
শশধর । তাই যদি না করব তবে আর প্ল্যান কিসের। আমি ঠিক করেছি সতীশকে আমাদের তরফ-মানিকপুর লিখেপড়ে দেব— তা হলেই সে স্বচ্ছন্দে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
সুকুমারী । আহা, কী সুন্দর প্ল্যানই ঠাউরেছ। সৌন্দর্যে আমি একেবারে মুগ্ধ। না না, তুমি অমন পাগলামি করতে পারবে না, আমি বলে দিলেম।
শশধর । দেখো, এক সময়ে তো ওকেই সমস্ত সম্পত্তি দেবার কথা ছিল।
সুকুমারী । তখন তো আমার হরেন জন্মায় নি। তা ছাড়া তুমি কি ভাব, তোমার আর ছেলেপুলে হবে না ।
শশধর । সুকু,ভেবে দেখো , আমাদের অন্যায় হচ্ছে । মনেই কর-না কেন, তোমার দুই ছেলে।
সুকুমারী । সে আমি অতশত বুঝি নে— তুমি যদি এমন কাজ কর তবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব— এই আমি বলে গেলুম।
শশধর। কী সতীশ, থিয়েটারে গেলে না।
সতীশ । না মেসোমশায়, আজ আর থিয়েটার না। এই দেখো, দীর্ঘকাল পরে মিস্টার ভাদুড়ির কাছ হতে আমি নিমন্ত্রণ পেয়েছি। তোমার দানপত্রের ফল দেখো। সংসারের উপর আমার ধিক্কার জন্মে গেছে, মেসোমশায়। আমি তোমার সে তালুক নেব না।
শশধর । কেন, সতীশ।
সতীশ । আমি ছদ্মবেশে পৃথিবীর কোনো সুখভোগ করব না। আমার যদি নিজের কোনো মূল্য থাকে তবে সেই মূল্য দিয়ে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই ভোগ করব, তার চেয়ে এক কানাকড়িও আমি বেশি চাই না, তা ছাড়া তুমি যে আমাকে তোমার সম্পত্তির অংশ দিতে চাও, মাসিমার সম্মতি নিয়েছ তো?
শশধর । না, সে তিনি— অর্থাৎ সে একরকম করে হবে। হঠাৎ তিনি রাজি না হতে পারেন, কিন্তু—
সতীশ । তুমি তাঁকে বলেছ?
শশধর । হাঁ, বলেছি বৈকি ! বিলক্ষণ। তাঁকে না বলেই কি আর—
সতীশ । তিনি রাজি হয়েছেন?
শশধর । তাকে ঠিক রাজি বলা যায় না বটে, কিন্তু ভালো করে বুঝিয়ে—
সতীশ । বৃথা চেষ্টা মেসোমশায় । তাঁর নারাজিতে তোমার সম্পত্তি নিতে চাই নে। তুমি তাঁকে বোলো, আজ পর্যন্ত তিনি আমাকে যে অন্ন খাইয়েছেন তা উদ্গার না করে আমি বাঁচব না। তাঁর সমস্ত ঋণ সুদসুদ্ধ শোধ করে তবে আমি হাঁপ ছাড়ব।
শশধর । সে কিছুই দরকার নেই সতীশ — তোমাকে বরঞ্চ কিছু নগদ টাকা গোপনে—
সতীশ । না মেসোমশায় আর ঋণ বাড়াব না। তোমার কাছে এখন কেবল আমার একটা অনুরোধ আছে। তোমার যে সাহেব-বন্ধুর আপিসে আমাকে কাজ দিতে চেয়েছিলে, সেখানে আমার কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।
শহধর। পারবে তো?
সতীশ। এর পরেও যদি না পারি তবে পুনর্বার মাসিমার অন্য খাওয়াই আমার উপযুক্ত শাস্তি হবে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।