কবুতর ও একটি দরিদ্র পরিবার

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগের ঘটনা । রাজা সুলতান খাঁ-র রাজ্যের অধীনে জঙ্গলনগরের জমিছেড়া নামক জঙ্গলে পরিপূর্ণ এক গ্রাম। এই গ্রামে বাস করে দরিদ্র দিনমজুর জহির । ভয়ংকর জন্তু-জানোয়ারে পূর্ণ কোন জঙ্গল নয় জমিছেড়া গ্রাম। নানা জাতের পাখির বাস এখানে। জহিরের বাড়ির অর্ধ-মাইলের মধ্যে কোন লোকবসতির চিহ্ন নেই। বউ আর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার তার। জঙ্গলনগরের জমিদার সোনাচান মির্জার অধীনে দিনমজুরের কাজ করে জহির। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় প্রায় দিন দশকের মতন গৃহবন্দি জহির। বাড়ির আশে-পাশে বা জঙ্গলে গজিয়ে উঠা শাকসব্জি কুড়িয়ে কোনমতে সন্তানদের জন্য খাদ্য যুগিয়ে চলেছে জহিরের বউ। বর্ষার কারনে জঙ্গলের কিছু পাখি আশ্রয় নিয়েছে জহিরের কুড়েঘরের চালের ফাঁকফোকরে। আগে দূর থেকে জহিরের পরিবারকে দেখলেও এই প্রথম তারা খুব কাছ থেকে জহিরের অভাবী পরিবারকে দেখতে পেল। পাখিদের খাদ্যের প্রয়োজনে উপার্জন করতে হয় না , তাদের খাদ্য ছড়িয়ে আছে সবখানে কিন্তু মানুষকে খাদ্যের প্রয়োজনে কাজ করতে হয়। পাখিরা এই ব্যাপারটা ভাল জানে। কিন্তু এই প্রথম স্বচক্ষে জহিরের সন্তানদের কষ্ট দেখে – বিষয়টা পাখিদের ভাবিয়ে তুলল। পাখিরা বুঝতে পারে না – কেন এক শ্রেনীর মানুষ আনন্দে কাটায় আর এক শ্রেনী কষ্টে থাকে। জহিরের বাড়িতে আগে থেকে বাস করা কবুতরের সাথে জহিরের পরিবার নিয়ে আলোচনা করে সদ্য আশ্রয় নেওয়া পাখিরা। কবুতরদের কাছ থেকে জহিরের পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে মনঃকষ্ট পায় পাখিরা। বিশেষ করে বাচ্চাদের কষ্ট তাদের ভাবিয়ে তুলে এবং পাখিকুলের পক্ষ থেকে কিভাবে জহিরের পরিবারকে সাহায্য করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনার জন্য পাখিসভার আয়োজন করবে বলে জানান দেয় পাখিরা।
একদিন বৃষ্টি কম থাকায় পাখিরা বিশাল পাখিসভার আয়োজন করল, সভার সভাপতি হল কবুতরের দল। নানা অঞ্চল বা নগর থেকে সব জাতের পাখি এসে জুটল জমিছেড়া গ্রামে। জমিছেড়া গ্রাম পাখির কলকাকলিতে মাতোয়ারা। আলোচনা চলতে থাকে কিভাবে জহিরের সন্তানদের খাদ্য সমস্যা সমাধান করা যায়। এক এক দলের পাখিরা এক এক প্রস্তাব দিতে থাকে । কিন্তু কোন প্রস্তাবই মনের মতন হয় না কবুতর দলের দলনেতার । কবুতর দলনেতা জহিরকে খুব কাছে থেকে দেখেছে এবং জানে, মানুষ তিন বেলা খাদ্য গ্রহন করে এবং তিন বেলার খাদ্য যোগাড় করা কোন পাখি দলের পক্ষে সম্ভব নয় । শুধু চাল খেয়ে মানুষ বাঁচে না আরো নানা পদের খাদ্য খেয়ে থাকে মানুষ । সব পাখিকুল ভাবনায় পড়ে গেল। এমন সমাধান বা উপায় বের করতে হবে যাতে জহির নিজেই নিজের খাদ্য যোগাড় করতে পারে। নানা দিক নিয়ে আলোচনা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা । সন্ধ্যা নামার ঘন্টা খানেক আগে তোতা আর ময়নার দল জানাল তাদের কাছে ভাল একটা উপায় আছে । তবে শর্ত হল সেই উপায় বলার আগে কাক ও চড়ুই পাখিদলদের সভা ত্যাগ করতে হবে কারন কাক আর চড়ুই পাখিকুল পেটে কোন কথা রাখতে পারে না । রাগে-দুঃখে কাক আর চড়ুই পাখির দল সভা ত্যাগ করল। এবং ভবিষ্যতে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে তারা করবে না বলে জানান দিয়ে চলে যায় ।
তোতা, ময়না আর কবুতরের দল গোপন রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে। ” কি উপায়” জানার জন্য উম্মুখ হয়ে উঠে কবুতরের দলনেতা। তোতা আর ময়না জানায় তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বন্দি আছে রাজা সুলতান খাঁ-র পাখিবন্দিশালায় । রাজার বড় বেগমের শখ পাখি পালন তবে সেই সব পাখি যারা কথা বলতে পারে মানুষের মতন । তাই অনেক তোতা-ময়না বন্দি রানির কাছে । বন্দি করার পর পর তাদের পাখা কেটে দেওয়া হয় । রাজপ্রসাদে ঘুরে বেড়াতে পারে বিনা বাধায় । বড় বেগমের সারাদিন কাটে পাখিদের সাথে কথা বলে। “বুঝলাম বড় বেগম পাখি খুব ভালবাসেন কিন্তু জহিরের ভাগ্য ফেরার সাথে কি সম্পর্ক , কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বল ” – বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে কবুতর দলনেতা । তোতা জানায় তার এক বন্দি আত্মীয়ের কাছে শুনেছে বড় বেগম যে সব গহনা পড়ে থাকেন তা নাকি অনেক দামী । রাজা অন্যদেশ থেকে এই সব দামি গহনা যোগাড় করে আনেন বেগমদের জন্য। দামি একটা গহনা যদি নিয়ে এসে জহিরকে দেওয়া যায় তাহলে সে তার সন্তানদের ভাগ্য ফেরাতে পারবে। কবুতর দলনেতা প্রস্তাব শুনে খুব খুশি হল কিন্তু কিভাবে হবে জানার জন্য প্রশ্ন করল তোতা পাখির কাছে । তোতা আর ময়না পাখির দল জানাল তারা এই কাজ করতে পারবে না কারন রাজপ্রসাদে নতুন কোন উড়ন্ত তোতা বা ময়না দেখলে বন্দি করার হুকুম জারি আছে । তাই তোতা আর ময়না পাখি ভুলেও উড়ে রাজপ্রসাদের দিকে যায় না। এই কাজ করতে পারবে শুধু কবুতর দল কারন কবুতর ধরা বা মারা নিষেধ আছে রাজ্যে। কবুতর নির্বিচারে ঘুরে বেড়াতে পারে রাজ্য এবং রাজপ্রাসাদে। কবুতর দলনেতার চোখে চিন্তার ভাব দেখে তোতা বলল এই কাজে তারা সাহায্যের হাত বাড়াবে । তাদের যে সব আত্মীয় বন্দি তারাই বেগমের গহনা চুরিতে সাহায্য করবে। তবে যেহেতু বন্দি পাখিদের উড়ার ক্ষমতা নাই তাই চুরি করা গহনা নিয়ে আসতে হবে কবুতরকে।
প্রতিদিনের মতন পাখিদের সাথে বড় বেগম গোসল সারতে গেলেন আলিশান পুকুরে। শরিরের সমস্ত গহনা খুলে ঘাটে রেখে নেমে পড়লেন পানিতে । জলকেলিতে বেগমের ব্যস্ততার ফাঁকে ছোট দুটি কানের দুল তুলে নিল তোতা পাখি আর অপেক্ষায় থাকা কবুতরের কাছে পৌছে দিল সেই কানের দুল । যে প্রান্তে সিপাইদের আনাগোনা কম সেই পথ দিয়ে কানের দুই দুল নিয়ে উড়াল দিল দুই কবুতর । দুল নিয়ে উড়তে উড়তে চলে এল জহিরের বাড়ি জমিছেড়া গ্রামে। একদিন সকালবেলা সুযোগ বুঝে জহিরের বিছানার উপর ফেলে দিল কানের দুল । জহিরের বউ বিছানা ঘোছাতে গিয়ে কানের দুল দেখে খুশিতে অজ্ঞান হয়ে যায় । রাতে জহির ফিরে এলে তার হাতে তুলে দেন দুল । জহিরের নানা প্রশ্নে বিব্রত হয়ে পড়ে জহিরের বউ এবং সে দুলগুলো চুরি করে আনেনি তা ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে বিশ্বাস করাতে হয় জহিরকে। কিভাবে এই দুল তাদের বাসায় এল তা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারে না জহির । শেষে বউয়ের কথায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হল “আল্লাহ চোখ তুলে চেয়েছেন ” বলে। খুব ভোরে দুল দুইটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন শহরতলির উদ্দেশ্যে । দিন যায় রাত যায় বউ অপেক্ষা করতে থাকে জহিরের ।
এইদিকে রাজপ্রসাদের অবস্থা গুরুতর । বেগমের যে কানের দুল হারিয়েছে তার মূল্য নাকি দুই নগরের সমান । মানে দুইখানা জঙ্গলনগরের মতন নগরী কেনা যায় কানের দুই দুল বিক্রি করে। সেদিন যেসব সিপাহী পাহারায় ছিল ডাকা হল তাদের কিন্তু ঘটনা শুনে সব সিপাহী অবাক । কাউকে আসতে যেতে দেখেনি কেউ । কর্তব্যে অবহেলার জন্য বন্দি হল কয়েকজন সিপাহী। সবার মনে এক প্রশ্ন – কানের দুল গেল কই ? রাজা ডেকে আনলেন রাজ্যের বড় বড় গুনীন আর নামজাদা সব গোয়ান্দাদের । গুনীনরা যাদু বলে খুজে বের করার চেষ্টা চালাতে লাগল এবং শেষে একটা বিষয়ে উপনীত হল যে – রাজ্যে ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসছে আর গোয়ান্দারা বেগমের আলিশান পুকুর পাড়ে বসে আলামত খোজায় দিন-রাত এক করে ফেললেন । পুকুরের চারিদিকে বিশাল উচু দেয়াল আর ওপারে সৈন্যদের আনাগোনা । কেউ যদি চুরি করতে আসে তাহলে সে শুধুমাত্র কানের দুল নিয়ে পালিয়ে যাবে কেন , কানের দুলের সাথে আরো অনেক গহনা ছিল। বাঘা বাঘা গোয়ান্দারা বসে বসে মাথার চুল ছিড়তে লাগলেন । কোন উপায় খুজে বের করতে পারল না। রাজা সবার ব্যর্থতা দেখে খবর পাঠালেন মহামানব মহারাজার কাছে। বিশ্বে যত রাজ্য আছে সব রাজারা উনার পরামর্শ নিয়ে থাকেন বলে উনি রাজার রাজা তাই উনার নাম – মহারাজা । মহারাজাকে সাদর সম্ভাষনে আদর আপ্যয়ন করে রাজ্য নিয়ে আসা হল। তিনি এসেই বেগমের সাথে একান্তে কথা বলার অনুমতি চাইলেন রাজার কাছে । বেগমকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে এলেন । তারপর রাজার কাছে ফিরে বললেন – রাজপ্রাসাদে যত পাখি আছে সব পাখি নিয়ে আসা হোক উনার সামনে এবং কোন পাখি যদি অসুস্থ হয়েও থাকে তাকেও যেন নিয়ে আসা হয়। যে কথা সেই কাজ । রাজপ্রাসাদের সব পাখি আনা হল মহারাজার সামনে । পাখিদের একে একে জিজ্ঞাসা করলেন – ঘটনার দিন বেগমের গোসলের সময় কে কে ছিল আলীশান পুকুর পাড়ে ? পাঁচটি বড় বড় তোতা পাখি স্বীকার করল সেইদিন তারা ছিল বেগমের সাথে তবে কিভাবে হারালো তারা জানে না, দেখেনি। পাঁচ পাখিকে বন্দি করার নির্দেশ দিতে বললেন রাজাকে এবং ভাল একটা দিন দেখে তাদের হত্যা করা হবে জানালেন । রাজাকে – রাজপ্রাসাদের আসে-পাশে যত পাখি দেখা যাবে তাদের গুলি করে হত্যা ও ধরপাকড়ের নির্দেশ দিতে বললেন ।
এইদিকে রাজ্য জুড়ে পাখি হত্যা ও ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল । ভয়ে সব পাখি উড়ে চলে গেল জঙ্গলনগরের জমিছেড়া গ্রামে। হত্যা ও ধরা পড়ল কাক আর চড়ুই পাখি বেশি । জমিছেড়া গ্রামের গাছে গাছে পাখিতে ভরে গেল । এদিকে জহিরের বাড়ি ফেরার কোন নাম নেই । অভাব আরো প্রচন্ড ভাবে জেকে বসেছে জহিরের বাড়িতে । কান্নার রোল শুনা যায় প্রতি দিনে-রাতে। কবুতরের দলনেতা বিচলিত হয়ে পড়ে । নানা দলে বিভক্ত হয়ে নগরে নগরে কবুতর খুজে ফেরে জহিরকে। কবুতরের দলনেতার উপর রাগে ফুলতে থাকে অন্য পাখিরা । তাদের অভিযোগ – কবুতর, তোতা আর ময়নার কারনে আজ তাদের জীবন বিপন্ন । কে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা যদি রাজার কাছে কেউ স্বীকার না করে তাহলে পাখিকুল ধ্বংস হয়ে যাবে । রাজপ্রাসাদে থাকা কবুতরদের জিজ্ঞাসা বাদের জন্য বন্দি করা হল । তবে তারা মহারাজাকে জানাল যে, ঘটনার দিন অন্য নগরের কিছু কবুতর এখানে এসেছিল তবে তারা কোন নগরীর তা জানে না। খেতে না পাওয়া আর চোখের সামনে অন্য পাখিদের হত্যা সহ্য করতে না পেরে এক তোতা স্বীকার করল সে এই কান্ডটি করেছে । তবে দুই কবুতর কোন নগরীর ছিল সে জানে না । মহারাজা রাজাকে রাজ্যের সব পাখি কোথায় পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে খোঁজ নিতে বললেন । খুজতে খুজতে সৈন্যরা চলে এল জমিছেড়া গ্রামে। গাছে গাছে পাখির বাসায় তাল্লাশি চালানো হল।পাখিরা আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মহারাজার কাছে সতি্য ঘটনা খুলে বলল । বন্দি করে আনা হল কবুতরের দলনেতাকে এবং দলনেতার স্বীকারোক্তি মতে জহিরের বউ আর দুই ছেলে-মেয়েকে । জহিরের বউ স্বীকার করলেন কানের দুল তিনি তার স্বামী জহিরকে দিয়েছেন এবংতারপর থেকে জহির লাপাত্তা। কোন খবর নেই জহিরের। এদিকে একদল কবুতর ফিরে এসে জহিরকে খুজে পাওয়ার সন্ধান দিলেন এবং জানালেন জহির মদ আরে কয়েক বেগম নিয়ে মহানন্দে দিন কাটাচ্ছেন । রাজা সব শুনে জহিরকে ধরে আনার নির্দেশ দিলেন ।

দুঃখিত!