
বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি, মহান আল্লাহর রহমতে তোমরা সবাই ভালো ও সুস্থ আছ। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি মানুষ। মানুষ হলো সৃষ্টির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। ঝিনুকের মাঝে যেমন মুক্তা থাকে তেমনি আকাশ ও জমিনের মাঝে সেরা সৃষ্টি হলো মানুষ। এজন্যই মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ নামে পরিচিত। এই মানুষের প্রয়োজনেই আল্লাহপাক নানা প্রজাতির উদ্ভিদ-প্রাণি ও পশুপাখি সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় জীবজন্তু ও পশুপাখির কথা এসেছে। প্রায় প্রতি জায়গাতেই এসব সৃষ্টিতে আল্লাহর নিপুণ সৃষ্টি-কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রায় একইসাথে বলা হয়েছে যে, এসব সৃষ্টির পেছনে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
বন্ধুরা, তোমরা যদি চিড়িয়াখানায় যাও তাহলে নানা বিচিত্র সব পশু-পাখি দেখতে পাবে। এদের একেকটির বৈশিষ্ট্য, বর্ণ, আকৃতি ও স্বভাব একেক রকম। চিড়িয়াখানা প্রাণি জগতের একটা নমূনা মাত্র। বলা হয়ে থাকে- আল্লাহপাক আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। কোনো মানুষের পক্ষে এত প্রজাতির প্রাণি দেখা সম্ভব নয়। সব প্রাণি দেখা বা তাদের সম্পর্কে জানা সম্ভব না হলেও আমাদের আশেপাশে যেসব পশু-পাখি বাস করে তাদের সম্পর্কে আমরা ইচ্ছে করলেই জানতে পারি। তাদের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা শিক্ষাও নিতে পারি।
বন্ধুরা, এসব কথা বলার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ, আজকে আমরা পাখিদের নিয়ে একটি গল্প শোনাতে যাচ্ছি। পুরনো দিনের এক পাখি শিকারীর কথা বলছি। শিকারী পাখিদের আটকানোর জন্য বিভিন্ন রকমের ফাঁদ পেতে রাখত। যেসব নিরীহ পাখি ওই ফাঁদে আটকা পড়ত সেগুলো সে খাঁচায় ঢুকিয়ে বাজারে নিয়ে মানুষের কাছে বিক্রি করত। পাখি বিক্রেতার দোকান বিচিত্র পাখিতে ভর্তি ছিল। সব পাখি এক এক রকমের খাঁচায় বিচিত্র কিচির মিচির শব্দে সারাক্ষণ গুঞ্জরিত ছিল। চড়ুই পাখি, বুলবুল পাখি, তোতা পাখি, কবুতর, ময়না জাতীয় পাখি, কানারি পাখি, বনঘুঘু জাতীয় পাখিসহ আরও বহু ধরনের পাখি ছিল তার দোকানে। একেক পাখির একেক রকমের সুর। বিচিত্র সুরে তারা দোকানকে সারাক্ষণ সুরের ঝংকারে মুখরিত করে রাখত।
কোনো কোনো পাখি ছিল, তারা শব্দ নকল করতে পারত। কেউ দোকানে ঢুকে সালাম দিলে কিছুক্ষণ পর সেই পাখি হুবহু সেরকম শব্দে সালাম দিত। পাখি বিক্রেতার ক্রেতারাও ছিল বিভিন্ন রকমের। কেউ আসত বুলবুল পাখি কেনার জন্য, কেউ আসতো কবুতর কিনতে। কোনো কোনো ক্রেতা আসত পাখির সুরেলা সঙ্গীত শুনে হৃদয়মনে আনন্দ পাবার জন্য, প্রশান্তি লাভ করার জন্য। আবার কেউ আসতো পাখি কিনে নিয়ে জবাই করে মাংস দিয়ে কাবাব বানিয়ে খাবার জন্য। কোনো কোনো ক্রেতা আসত পাখির খেলা করে সময় কাটাবে-এই চিন্তা করে। একেক ক্রেতা আসতো তোতা বা ময়না জাতীয় পাখি কেনার জন্য। তার এ জাতীয় পাখি কিনে নিয়ে তাদের কথা অনুকরণ করিয়ে আনন্দ পেত। এরকম পাখির বৈচিত্র্যের মতো মানুষ বা পাখি ক্রেতার মধ্যেও বৈচিত্র্য ছিল।
যাই হোক, একদিন পাখি বিক্রেতা গেল তার পেতে আসা জালের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। জালে কোনো পাখি আটকা পড়লে যত তাড়াতাড়ি তাদেরকে নিয়ে আসা ততই ভালো। ফাঁদের কাছে গিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা পাখি আটকা পড়েছে। কয়েকটা চড়ুই পাখির সাথে একটা কাকও রয়েছে। এগুলোকে দেখে দোকানদার বলল: ‘কাক আবার আটকা পড়ল কী করতে? এই কাক তো বিক্রি হবে না। কেউ কি কাক কিনতে আসবে? কাকটাকে ছেড়ে দেয়াই ভালো। সে তার ভাগ্য নিয়ে চলে যাক তার নিজের ভূবনে। কাক, না তার গলায় সুর আছে, না তার গোশত খেতে মজা আছে।’ মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতে পাখি বিক্রেতা তার জালে হাত দিল কাকটাকে বের করে আনার জন্য।
কাক পাখি শিকারীকে দেখেই ভয় পেয়ে গেল। তাই সে ভালোমতো একটা ঠোকর বসিয়ে দিল পাখি শিকারীর হাতে। কাকের মারাত্মক ঠোকরে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠল শিকারী। এরপর রেগেমেগে তীব্র চিৎকার দিয়ে কাককে বলল: ‘আমার হাতে ঠোকর দিয়েছিস? আমি চেয়েছি তোকে ছেড়ে দিতে। ঠিক আছে, তোকেও খাঁচায় বন্দী করে রাখবো যাতে আর কোনোদিন এ কাজ না করিস। উচিত শিক্ষা হবে তোর।’ পাখি বিক্রেতা জালে আটকা পড়া চড়ুইগুলোর সাথে কাককেও নিয়ে গেল দোকানে। একটা খাঁচায় বন্দী করে রাখলো কাকটাকে।
কাক দোকানে গিয়ে যখন আরও বহু পাখি দেখল, খুশি হয়ে গেল। সবাইকে বলল: ‘বন্ধুরা! ভালোই হলো। সবাই মিলে আমরা চিন্তা করবো কীভাবে এই খাঁচা থেকে পালানো যায়। চলো সবাই মিলে চিন্তাভাবনা করি, পরামর্শ করি। দেখি কীভাবে কী করা যায়।’ চড়ুই পাখিগুলো কিচির মিচির শব্দ তুলে বলল: ‘ঠিক বলেছ! ওই পাখি শিকারীর দোকান থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’
তোতা পাখি নিজেকে মনে করত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং ভালো পাখি। কাকের এই মুক্তির চিন্তা তার ভালো লাগল না। বিশেষ করে খাঁচায় বন্দী সব পাখি কাকের কথায় সায় দেয়াতে তার আরও খারাপ লাগল। তোতা তাই কাককে লক্ষ্য করে বলল: ‘এইসব কথা তোমার মতো একটা কালো পাখির মুখে মানায় না। চুপ কর! নিজের চরকায় তেল দাও।’ কাক তোতা পাখির দিকে তাকিয়ে বলল: ‘ছি ছি! কীরকম অহংকারী তুমি! খাঁচার ভেতরে থেকে এতো অহংকার দেখাচ্ছো! আর যদি মুক্তি পেয়ে আল্লাহর দেয়া নিঃসীম আকাশে কিংবা সীমাহীন বনজঙ্গলে যেতে পারতে তাহলে কী করতে? তখন তো বোধ হয় বলতে- আমি পাখিদের খোদা। দেখছনা তোমার গলার সুরকে কীভাবে মানুষেরা সরু করে ফেলছে! এই মানুষেরা আমাদের মতো পাখিদের জন্য কী করতে পারে-হয় খাঁচায় ভর্তি করে রাখবে অথবা জবাই করবে-এই তো। তুমি সেই মানুষদের কথা নকল করে এভাবে অহংকার করছো?
তোতা বলল: ব্যস। ব্যস। অনেক হয়েছে। আর বলতে হবে না। তোর ওই কর্কশ কণ্ঠস্বর বিশ্রি লাগছে। আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুই যদি পারিস মানুষের কথা নকল করগে,যাহ। কাক বলল: আমি কোন দুঃখে অনুকরণ করতে যাব? তোমার মতো কথা নকল করে মানুষের বাসায় খাঁচাবন্দী হয়ে থাকব? আর খাঁচায় থেকে ভাঁড়ের অভিনয় করব? প্রশ্নই আসে না। সে-ই ভালো, মানুষ আমার কর্কশ কণ্ঠ শুনে ভালো না বাসুক, তোমার মতো খাঁচার ভেতর আটকে না রাখুক।
চড়ুইগুলো একসাথে বলে উঠল: আমাদের কিচির মিচির গুঞ্জরণ অনেক ভালো। তোমার পছন্দ না হলে কানে তুলা দিয়ে রাখ। কবুতরেরাও বলে উঠল: আমাদের বাকবাকুম শব্দ শুনতে যেরকমই লাগুক আমাদের জন্য সেটাই ভালো। আমাদের বাকবাকুম করতেই ভালোবাসি।
কাক এতোক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কী যেন ভাবছিল। সবার কথা শুনে এবার বলল: হ্যাঁ, ঠিকই! চড়ুই পাখি কিচির মিচির শব্দ করতেই ভালোবাসে আর পায়রারা বাকবাকুম। আর আমরা কাকেরা কা-কা করতেই পছন্দ করি। ওই পংক্তিটা শোনোনি: কাবুতার ব কাবুতার, বজ্ ব বজ্ কোনাদ হাম জেন্স ব হাম জেন্স পারভজ অর্থাৎ কবুতরের সাথে কবুতর, শ্যেনের সাথে শ্যেন স্বজাতির সাথে স্বজাতির হওয়া উচিত লেনদেন।
কাক আরো বলল: মানুষেরা কিন্তু আমাদের পাখিদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে নি। তোতা পাখি যখন মানুষের কথা নকল করল তখনই মানুষ তোতাদের ধরে বাসায় নিয়ে খাঁচায় রাখতে শুরু করল। আর এই তোতার কারণে আমাদেরও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাই হে তোতাজান! মানুষের ভাষা নকল করে তুমি যেহেতু মজা পাও, সেহেতু তুমি এখানেই থাকো। সারাজীবনের জন্য মানুষের খাঁচায় বন্দী থাকো। আর আমি ভালো করেই জানি আমার কী করা উচিত।’
কাকেরা এমনভাবে কা-কা করে চেঁচামেচি করতে লাগল যে পাখি বিক্রেতার মাথাটাই খারাপ করে দিল। এদিকে কাকেদের কা কা শব্দ শুনে দোকানের আশেপাশে আরো যত কাক ছিল সবাই এসে দোকানের আশেপাশে সমবেত হলো এবং অভ্যাসবশত সমস্বরে কা-কা করতে লাগল। দোকানদার তার কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিরাট খাঁচার দুয়ার খুলে দিল আর কাকের সাথে আরো কিছু পাখিও সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে উড়ে মুক্ত আকাশে চলে গেল। কিন্তু তোতাপাখি রয়ে গেল খাঁচায়। মানুষের কথা নকল করার জন্য সে আপন খাঁচাতেই বন্দী হয়ে রইল।
এই ঘটনার পর থেকেই কে যখন বলতে চায় বা বোঝাতে চায় মানুষের উচিত তার সমমনাদের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা করা, তখনই তারা এই পংক্তিটা উচ্চারণ করে: কবুতরের সাথে কবুতর, শ্যেনের সাথে শ্যেন স্বজাতির সাথে স্বজাতির হওয়া উচিত লেনদেন।
বন্ধুরা, দেখলে তো- মানুষের কথা নকল করতে গিয়ে তোতাপাখির কি পরিণতি হলো? সত্যিই বলতে কী, যার যে বৈশিষ্ট্য, সে অনুযায়ীই কাজ করা উচিত। কোনোভাবেই অন্যকে নকল বা অনুকরণ করা উচিত নয়।