কবি পরিবারে নবীর আগমন

রাসূল (সা.)-এর দাদার নাম ছিল আবদুল মুত্তালিব। কবি পরিবার হিসেবে তাঁর পরিবারের সুখ্যাতি ছিল সারা আরবে। তাঁর সন্তানরা কম-বেশি সবাই কাব্যচর্চা করতেন। তাঁদের কাব্যচর্চা নিয়ে আছে নানা চমকপ্রদ ঘটনা। একবারের ঘটনা শুনুন।

আবদুল মুত্তালিবের ছিল পাঁচ কন্যা। তখন তিনি বুড়ো হয়েছেন। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে একদিন তাঁর মনে এক আজব খেয়াল জাগল। তিনি তাঁর পাঁচ কন্যাকে কাছে ডাকলেন এবং বললেন—
“আমি জানি, আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে নিয়ে শোককাব্য রচনা করবে এবং তা আবৃত্তি করে বিলাপ ও মাতম করবে।”

তৎকালীন আরবে এটা ছিল এক সাধারণ রেওয়াজ। কারো নিকটজন মারা গেলে তার আপনজনেরা মৃত ব্যক্তির নামে শোককাব্য আবৃত্তি করে মাতম করত। তিনি বললেন—
“আমার বড় শখ, আমাকে নিয়ে তোমরা যে মর্সিয়া রচনা করবে, মরার আগেই তা একটু শুনি।”

কী আজব কথা! মরার আগে কেউ শোককাব্য শুনতে চায় নাকি? কিন্তু এ তো জন্মদাতা পিতার অন্তিম আবদার! বরং বলা উচিত মৃত্যুপথযাত্রী পিতার অন্তিম হুকুম। পিতার এই হুকুম পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কন্যারা। তারা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে শোককাব্য লিখে পিতার সামনে হাজির হলো। পিতা বললেন—
“পড়ো।”
কন্যারা নিজ নিজ কবিতা পিতাকে শুনিয়ে দিল।

এ তো গেল রাসূল (সা.)-এর ফুফুদের কাব্যচর্চার কথা। এবার শুনুন চাচার কাহিনী। রাসূলের (সা.) পিতৃব্য আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিবের কবিখ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। আবু তালিব কেবল রাসূল (সা.)-এর চাচাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশের নেতা। আমরা জানি, তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলাম কবুল করেননি, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর নিরাপত্তা বিধান এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান।

তিনি তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। এ-ও জানতেন, তাঁর ভাতিজা যে দ্বীনের প্রচার করছেন, সেটাই সত্য ও সঠিক দ্বীন। কিন্তু অহঙ্কার ও আত্মঅহমিকার কারণে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তিনি এই দ্বীন কবুল করতে রাজি হননি। তাঁর কোনো কোনো কবিতায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে ব্যক্ত হয়েছে তাঁর বেদনার্ত হৃদয়ের আর্তি। তাতে ফুটে উঠেছে কেন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি তার অন্তর্নিহিত কারণ।

তিনি তাঁর ‘নিন্দার ভয়ে’ কবিতায় বলেন—
‘সেই নূরানী চেহারার অধিকারী/ যাঁর চেহারার বরকতে/ মেঘমালা থেকে নেমে আসে বারিধারা
এতিমদের আনন্দ আর বিধবাদের রক্ষক হিসাবে/ যাঁর মহত্ত্ব সূর্যের মতো দীপ্যমান
বনু হাশিমের অসহায়, দুস্থ ও নিঃস্বরা/ যাঁর আশ্রয়ে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিপালিত হয়
সে আর কেউ নয়— আমাদের ছেলে মুহাম্মদ।/ লোকেরা জানে,/ আমাদের পুত্র সত্যবাদী আল-আমীন
যে কখনো বেহুদা কথা বলে না/ এমন কোনো কাজ করে না/ যাতে নেই কল্যাণের ছোঁয়া।
হে পুত্র,/ তুমি আমাকে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিতে ডাক দিয়েছো।
আমি জানি তুমি আমার হিতাকাঙ্ক্ষী, আর/ তুমি যে দ্বীনের পথে ডাকছো, সেটাই শ্রেষ্ঠতম দ্বীন।
হায়! যদি গালমন্দ ও নিন্দার আশঙ্কা না থাকত/ তবে আমি এ দ্বীন অবশ্যই কবুল করতাম।
আমিও হতাম উৎসর্গীতপ্রাণ সাদা বলাকা।’
(সূত্র: রাসূলের শানে কবিতা, পৃ. ৪৬)

চাচা-ফুফুদের রেখে এবার আসুন তাঁর মায়ের কাছে। আমরা সবাই জানি, কবি ও কবিতার জন্য ভুবনখ্যাত এক জনপদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাসূল (সা.)। দু-একটি খণ্ড কবিতা ছাড়া তিনি যদিও কোনো কবিতা রচনা করেননি, কিন্তু তাঁর আম্মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব ছিলেন যুগধর্মের দাবিতে একজন স্বভাবকবি।

রাসূল (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের আকস্মিক মৃত্যুর পর তিনি যে মর্সিয়া বা শোকগাথা রচনা করেছিলেন, তা আজও ইতিহাসখ্যাত। রাসূলের জন্মের আগেই মারা যান তাঁর পিতা। পিতার মৃত্যুর পর মা আমিনা যে মর্সিয়া কাব্য লেখেন, তা আজও অমর হয়ে আছে। তিনি লিখেছিলেন—

‘আশিয়্যাতান রা-হাও ইয়াহমালুনা সারীতারান/ লাকা দেরাতা আছহাবুল ফিততাযানুমি।’

অর্থ: হায় রে, নিঠুর ওরা আসর বেলায়/ দাফন করল আমার হৃদয়-সখায়।
দাফন করল সবে করিয়া নুজ্জুম/ অনাথিনী আমি কারে করেছি জুলুম?

(সূত্র: রাসূলের শানে কবিতা, পৃ. ৭)

রাসূল (সা.)-এর জন্মের আগে মা আমিনা প্রায়ই স্বপ্নাদিষ্ট হতেন যে জগৎখ্যাত এক শিশুর জন্ম হবে। এ মধুর স্বপ্ন তাঁকে আবেগাপ্লুত করত। এ আবেগ তিনি তুলে ধরেছেন সেই সময়ের বেশ কিছু খণ্ড কবিতায়। ইতিহাসের পাতায় সেসব কবিতাও অমর হয়ে আছে। যেমন তিনি লিখেছেন—

‘ফা আনতা মাবউছুন ইলাল আনামি/ তুব আছু ফিল হিল্লি ওয়া ফিল হারামি।’

অর্থ: প্রেরিত হচ্ছ তুমি জগৎবাসীর কাছে/ প্রেরণ করা হচ্ছে তোমায় হিল ও হারামের কাছে।
(সূত্র: পূর্বোক্ত, পৃ. ৭)

মায়ের পর এবার আসুন মেয়ের কাছে। মহানবী (সা.)-এর নয়নের মণি কন্যা ফাতিমা (রা.) অসাধারণ কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রাসূলের মৃত্যুর পর তিনি যে মর্সিয়া কাব্য লেখেন, তার ভাষান্তরিত রূপ এখন বাংলায়ও পাওয়া যায়। অনেকেই মা ফাতিমার কবিতার বঙ্গানুবাদ করেছেন। কবি আবদুস সাত্তার, আধুনিক বাংলা কাব্যের এক স্বনামখ্যাত কবি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত কবি আফজাল চৌধুরীর নাত যুগে যুগে গ্রন্থে অনূদিত মা ফাতিমার যেসব কবিতা উল্লেখ করেছেন, তাতে হযরত ফাতিমাতুজ্জোহরা (রা.)-এর কাব্যসাধনার অসামান্য চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখান থেকে একটি মর্সিয়া উদ্ধৃত করছি—

‘তোমার বিহনে আমি বৃষ্টিহীন বিশুষ্ক মরু/ তোমার অন্তর্ধানে বন্ধ অহির পুণ্যবাণী
তোমার আগে যদি হতো মরণ আমার/ তুমিই করতে শোক তা আমি জানি।
প্রিয়জন জানে মৃত্যু কত গুরুভার/ মাটির স্তূপ হয় শোকাতুর তরু
আমার হৃদয়ের আজ যে গহিন অন্ধকার/ এ বিশ্বে পড়ত যদি কণামাত্র তার
নিমেষে সব হতো গভীর কালো/ আলো বলে ধরণীতে থাকত না কিছু আর।’

কী অসামান্য চিত্রকল্প, কী গভীর ভাবের দ্যোতনা! ইতিহাসের দিকে তাকালে এভাবেই আমরা দেখতে পাই— মহানবী (সা.)-এর মা, চাচা, ফুফু, কন্যা— বলতে গেলে সে পরিবারের সবাই ছিলেন কবি। তাই অনায়াসেই বলা যায়, আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব এবং শেষ নবীকে এক কবি পরিবারে পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে কবিদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহেরই অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে।

কবিপরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে কবিদের প্রতি ছিল নবীজীর বিশেষ আকর্ষণ। তিনি তাঁর একমাত্র কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন আরবের প্রখ্যাত কবি হযরত আলী (রা.)-এর সঙ্গে। মহানবীর জামাতা হযরত আলী (রা.) এমন এক কালোত্তীর্ণ কবি ছিলেন, যাঁকে আজও আরবে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি নবীকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে ছোট্ট একটি কবিতা তুলে ধরছি। হযরত আলী (রা.)-এর গর্বিত শামশীর কবিতাটি নিম্নরূপ—

‘ফাতিমা, নবী-নন্দিনী ওগো/ লও এ তরবারি, গর্বিত শামশীর।
ভীরুতা কিংবা পরাজয়ের কালিমা/ স্পর্শ করেনি কভু তরবারি এ আলীর।
আপসহীন সিংহশাবক, বীর যোদ্ধা আমি/ বীরের বংশধর, আমি বীর সংগ্রামী।
আল্লাহ ও নবীর সপক্ষে এ দু’ধারী জুলফিকার/ লড়াইয়ের ময়দানে ঝলসে উঠেছে বারংবার।
জালিমের ত্রাস আমি— বন্ধু শত মজলুমানের/ বন্ধু আমি নির্যাতিত অযুত লক্ষ প্রাণের।
জানি, একদিন আল্লাহর কাছে তার পাবো পুরস্কার/ তুমিও জেনে রাখো—
একমাত্র জান্নাতই উদ্দীপ্ত জীবনের লক্ষ্য এ বান্দার।’

এই সামান্য আলোচনা থেকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (সা.) আরবের এক প্রসিদ্ধ কবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন এমন এক পরিবারে যাঁর চাচা, ফুফু, মা, মেয়ে ও মেয়ের স্বামী— সকলেই ছিলেন কবি। এখানে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না, নবী না হলে হয়তো তিনিও কোনো জগৎখ্যাত কবি হতেন।

পৃথিবীতে কবির সম্মান অতুলনীয় হলেও নবীর সম্মানের কাছে তা কিছুই নয়। যাকে নবুওয়তের মতো মহা সম্মানে আল্লাহ ভূষিত করবেন, তাঁর জন্য কবি হিসেবে সম্মানিত হওয়া একেবারেই গৌণ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এ কথাটাই পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন—
‘আমি রাসূলকে কবিতা শিক্ষা দিইনি, এবং তা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৬৯)

সত্যিই তো তাই— যিনি হবেন রাহমাতুল্লিল আলামিন, খাতামুন নাবিয়িন, সাইয়্যিদুল মুরসালিন, মাহবুবি খোদা, তাঁর কবি হওয়ার প্রয়োজন কী? যিনি হবেন নবীকুলের সরদার, তিনি কবি হতে যাবেন কেন? এই কারণেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবীকে কবি হিসেবে পাঠাননি; তবে তাঁকে কবি পরিবারে পাঠিয়ে পৃথিবীবাসীর সামনে কবিদের মর্যাদাও উচ্চে তুলে ধরেছেন।

আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম হাবিব রাসূল মুহাম্মদকে কেন একটি কবি পরিবারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? এর কি কোনো অন্তর্নিহিত কারণ ছিল, নাকি এটি কেবলই এক কাকতালীয় ঘটনা? আসলে আমরা আমাদের বিবেক, বুদ্ধি ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনার অবতারণা করতে পারি; আল্লাহর সীমাহীন কুদরত উপলব্ধি করে চমৎকৃত হতে পারি; গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তাঁর কাছে মস্তক অবনত করতে পারি। আসল সত্য ও প্রকৃত কারণ একমাত্র তিনিই ভালো জানেন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!