নফল নামাজ শেষে দু’হাত তুলে দোয়া করার সময় শহির উদ্দিনের দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। প্রতিবার কবর খুঁড়তে যাওয়ার আগে শহির উদ্দিন দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। শহির তার বাবার কাছে শুনেছিলো, যে ব্যক্তি একশোটা কবর খুঁড়বে সে বেহেশত পাবে। কথাটা সত্য কিনা শহির জানে না। বেশ কয়েকবার সে ভেবেছিলো ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে ওঠে নি। আর উত্তরে যদি ইমাম সাহেব বলে যে এটা সত্য কথা না, তাহলে তার মনটা বড় খারাপ হয়ে যাবে। বেহেশত পাওয়ার জন্য সে কত কিছুই না করলো। সে শুনেছিলো তিন কন্যা সন্তানের বাবারা সহজে জান্নাতে যাবে। এসবের মধ্যে যে একটা ‘কিন্তু’ আছে সেটা নিয়ে শহির ভাবে না। তিন কন্যা সন্তান মিল না হওয়া পর্যন্ত সে সন্তান নেওয়া চালিয়ে গেছে। তিন কন্যা আর ছয় পুত্র মিলে তার সন্তান সংখ্যা নয় জন।
শহির উদ্দিন এলাকার একজন গোরখোদক। ঘর-গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি সে কবর খুঁড়ে বেড়ায়। আশে-পাশে কেউ মারা গেলে তার ডাক পড়ে। মুর্দার গোসলও করায় সে। আগে তার সাথে কাজ করতো প্রতিবেশি নছর আলী। গতবার নছর আলী মারা যাওয়ায় এখন সে তার ভাতিজা আনিসকে সাথে নেয়। প্রতিটা কবর খোড়ার পর সে একটা কলম দিয়ে তার ঘরের বাশের খুঁটিতে একটা করে দাগ দেয়। মাঝে মাঝে গুণে দেখে। কয়েকদিন আগে গুনে দেখেছে ৯৯টা। গত মাসের ঘটনা সেটা। শহিরের প্রায়ই মনে হয় একশোটা কবর খোঁড়ার আগেই তার মৃত্যু হবে। অবশেষে আজ যখন সে দায়িত্ব পেলো বেলায়েত হাজীর কবর খোঁড়ার তখন তার মনে প্রশান্তি আসলো। তাই আজ চোখের পানির পরিমাণ বেশি। কিন্তু আজ তার মনে হলো বেহেশত পাওয়া এতো সহজ না। জীবনে কত পাপ-ই না সে করেছে। কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে শহির তওবা করে। তার এও মনে পড়ে যে একশো নম্বর কবর যে সে খুঁড়তে পারবে তার-ই বা নিশ্চয়তা কোথায়? বেলায়েত হাজীর কবর খোঁড়ার আগেই তো উপরওয়ালা তাকে তুলে নিতে পারে।
কবর খুড়তে যাওয়ার সময় ইনহেলারটা নিতে ভুল করে না শহির। তার হাঁপানি আছে। রোগটা বংশগত। তার দাদার ছিলো। বাপের না থাকলেও তার হয়েছে। কবর খুঁড়তে খুঁড়তে কোনো কোনো সময় নিশ্বাসের টান পড়ে। গলা দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দ হতে থাকে। তখন ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। সবসময় হয় না তবু সাবধানতা অবলম্বন করে শহির উদ্দিন।
বেলায়েত হাজীর ছোট ভাই আইয়ুব এসে কবর খোঁড়ার জায়গা দেখিয়ে দেয়। হুজুরের পাড় গোরস্থান। একেকটা কবরের জায়গায় এ পর্যন্ত পাঁচটা করে কবর পড়েছে। বেলায়েত হাজীর জায়গার অভাব নেই। ইচ্ছে করলেই বাড়ির পাশে তার কবর হতে পারতো। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিলো হুজুরের পাড়েই কবর হবে। বাপ-দাদা যেখানে সমাহিত হয়েছে সেখানেই যেনো তারও শেষ ঠাঁই হয়। বেলায়েত হাজীর সুনাম আছে এ গ্রামে। জনকল্যাণমূলক অনেক কাজ করেছেন তিনি। স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন। বেলায়েত হাজী আগে থেকেই পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। গ্রামে অনেক জমিজমা থাকলেও তাতে লোভ নেই তার। তার ভাইয়েরা সেসব জমি ভোগদখল করে।
বেলায়েত হাজী গতরাতে মারা গেছেন ঢাকার এক হাসপাতালে। এখন গ্রামে লাশ আনার প্রক্রিয়া চলছে। বাদ আছর জানাজা পড়া হবে বলে মাইকিং করা হচ্ছে।
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে ভাতিজা আনিসকে অনেক কথা শোনায় শহির উদ্দিন।
-বুঝলু বাজান কবর খুঁড়বার সময় বুঝা যায় কোন মানুষ কেমন। কারো কারো কবর খুঁড়বার সময় কলকল করি পানি ওঠে। সেই পানি ফির ছেঁকি ফেলা নাগে। মুই যখন ছোট আছনু তখনকার একটা ঘটনা শুন। কালাম মাওলানার দাদীর কবরের জাগাত আরএকটা কবর খুঁড়ি দেকনো বেচরির বেটির শরীলের কিচ্ছু হয় নাই। বেচরির বেটি খুব পরহেজগার আছলো। পর-পুরুষের কাছোত মুখ দেখায় নাই। সারাক্ষণ তছবি গনছিলো। নামাজ-কালাম নিয়া সারাজীবন কাটায়া দিছে।
আনিস একমনে জ্যাঠার কথা শোনে। কবর খুঁড়তে খুঁড়তে এখন প্রতিদিনই তার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। নামাজটা সে ধরতে চায় ঠিক মতো। কিন্তু কিছুদিন পড়ার পর আবার শয়তান অসওয়াসা দেয়।
কবর খোঁড়া প্রায় শেষের দিকে। উপরে উঠে শহির একটু বিশ্রাম নেয়। আনিস কবরটা মসৃণ করতে থাকে। শহির উপর থেকে কবরের দিকে তাকায়।
-দেখলু বাজান কবরটা কেমন চকচক করেছোল। সবার কবর এমতোন চকচক করে না। আহা! বেলায়েত হাজী বড় ভালো মানুষ। আল্লাহ তুমি তারে বেহেশত নসীব করো। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে শহির উদ্দিন।
তারপর কী মনে করে যেন কবরে নেমে পড়ে। কবরের চারপাশ শুঁকে দেখে।
-সোবহানআল্লাহ। দেখ দেখ কী কা-! মাটি থাকি সেন্ট বেরায়ছোল। একেবারে কী যেন কয় একটা ফুলের মতন!
আনিস দেয়ালগুলো শুঁকে দেখে। না, তার কাছে তেমন কোনো সুবাস অনুভূত হচ্ছে না। শুধু মাটির একটা সোঁদা গন্ধ।
-কি বাজান পাইস নাই? আনিসের মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাবের আশায় প্রশ্ন করে শহির।
-হ্যাঁ বড়আব্বা পাওয়া যায়ছোল। কোনো সুবাস না পেলেও চাচাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলে আনিস।
শহির উদ্দিন আবার উপরে ওঠে। গলার মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি লাগে। শ্বাসকষ্ট হওয়ার আগ মুহূর্তে এমন হয়। বাশির মত আওয়াজ হতে থাকে। ইনহেলারটা বের করে পাফ নেয় সে। বেলায়েত হাজীর ছোট ভাই আইয়ুবকে ছুটে আসতে দেখে। শহির ভাবে কাজে তাড়া দিতে আসছে সে। তাই কাছে আসতে বলে, ভাইজান কাজ শেষ।
– কবর খোঁড়া নাগবে না। আইয়ুব বলে।
– কি কন? খোঁড়া নাগবে না ক্যানে? তখনো শ্বাসকষ্টটা যায় নি শহিরের।
– ভাইজানের বড় ছেলে লাশ আনির দিবে না। ঢাকাত কবর দিবে।
-এইটা কোনো কথা হইল্ ভাইজান? কাজ তো শ্যাষ। এলা কবরের কি হইবে?
-মোন্দে দেও। ভাইজানের ইচ্ছা আছলো এ্যাটে কবর হইবে। বড় বেটা দেওয়ানি হইছে। শ্যাষ দেখাটাও দেইখপার পাইনো না।
আইয়ুব মিয়া চলে যায়। আরেকটা পাফ নেয় শহির। তবু শ্বাসকষ্ট কমছে না। আনিস একদৃষ্টিতে আইয়ুবের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে। এখন কী করবে বুঝতে পারছে না সে।
-চাচা কবর কি মোন্দে দেমো?
-মোর খুব কষ্ট নাগেছোল। আগোত বাড়ি নিয়া চলেক তো।
শহির উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়তে থাকে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কোলে করে তাকে বাড়ি নিয়ে চলে আনিস। বিছানায় শুইয়ে দেয়।
-মোর খুব কষ্ট হয়ছোল শেফালির মা।
শহিরের ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে কাঁদতে থাকে। শহিরের চোখে ভাসতে থাকে কবরটা। তার জীবনে খোড়া একশো নম্বর কবর। কবরটা খুঁড়েছিলো বেলায়েত হাজীর জন্য। এখন লাশ আসবে না বলে বন্ধ করে দিতে হবে। আনিসকে পাশে ডাকে শহির। বলে, একটা কাজ করেকতো বাজান। আনিস বলে, কবর মোন্দার কথা কন? ওটা এলা পরে মোন্দামো। শহির বলে, মোন্দার কথা নোমায়। ঐ খুঁটিটাত একটা দাগ দে তো ।
ঠিক তখনি তার বুকের উপর চড়ে বসে আরেক শহির। ‘কিসের দাগ দিতে বলতেছিস? বেলায়েত হাজীর লাশ তো আসতেছে না। ত্ইু তো ওটা কবর খুড়িস নাই। ওটা হইছে একটা গর্ত।’
শহির উদ্দিন কান তালা লাগানো উচ্চস্বরে চিৎকার করে ওঠে, না না না । ##