আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা প্রতারণা, ধোঁকাবাজি ও কপটতার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা জানে না যে, কপটতা বা ধোঁকাবাজি হচ্ছে এমন এক ঘৃণ্য কাজ যা মানুষের সম্মান ও মর্যাদাকে হুমকির সম্মুখীন করে। পবিত্র কোরআনে কপট লোকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “তারা আল্লাহ ও ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দিতে অথচ তারা বুঝতে পারে না যে, তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না।” কপটতাকে একটি আত্মিক রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন, “কপটতাপূর্ণ লোকদের ব্যাপারে সতর্ক হও। কেননা তারা ভুলপথে পরিচালিত। তারা বিভ্রান্ত,তাদের অন্তর রুগ্ন এবং তাদের চেহারা অপবিত্র।” তিনি আরো বলেছেন, “কপট লোক নিজের তোষামোদকারী এবং অন্যের বদনামকারী।” কপট বা প্রতারকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলা হলেও অনেক সরজ-সরল মানুষ তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নানা ধরনের হয়রানী ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তবে, কেবল মানুষই নয়, পশু-পাখির মধ্যেও প্রতারণা, কপটতা ও জুলুম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটি নেয়া হয়েছে অষ্টম শতকে বিশিষ্ট কবি ও লেখক নিজামুদ্দীন গাজানী তাবরিজীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ রিয়াজুল মুলুক ফী রিয়াজুস সুলুক’ থেকে।
একদিন এক শিয়াল শিকারের খোঁজে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। খানিক পর তার কানে এলো এক বনমোরগের ডাক। ডাক অনুসরণ করে সে পৌঁছে গেল বনের ধারে। বনমোরগ ধরার নেশায় ঝোপঝাড় ও লতাপাতার ফাঁকফোঁকর দিয়ে এগুতে লাগল শিয়াল। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো, একটি গাছের আড়াল থেকে মচমচে শব্দ আসছে। সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতেই দেখলো বিরাট একটা হাতি গাছপালার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ঘটনাক্রমে একই পথে উল্টো দিক থেকে আসছে একটা সিংহ।
হাতি আর সিংহ মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। পথটি এত সরু যে, কেউ কাউকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে না। সিংহ বলল : আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়া। আমি পার হবো।
সিংহের নির্দেশ শুনে হাতি গেল ক্ষেপে। সে বলল: তুই সরে দাঁড়া! আর তাতে রাজি না হলে আমার হাত পায়ের নিচ দিয়ে পার হ।
সিংহ বলল: কি বললি, আমি তোর হাত-পায়ের নিচ দিয়ে পার হব? তুই কি জানস না আমি হচ্ছি পশুদের রাজা।
হাতি: তুই পশুরাজ হলি কিভাবে? আমি হচ্ছি হাতি, সবার বড়। আমাকে সম্মান জানানো তোর জন্য ফরজ।
সিংহ: গর্দান বড় হলেই কেউ বড় হয় না রে! তুই তো নিজের সম্মানই রক্ষা করতে পারিস না। তুই যদি বড় আর মান সম্মানের পাত্রই হতিস, তাহলে তোর পিঠে মানুষকে খাটিয়া বাঁধতে দিতিস না। মানুষ যখন তোর খাটিয়ায় চড়ে আরামে ঘুরে বেড়ায় তখন তোর মান-সম্মান কোথায় থাকে? শুনে রাখ- মান সম্মান বলতে যা কিছু আছে তা কেবল আমারই। দেখিস না, এই বনের সবাই আমাকে কেমন ভয় করে চলে?
হাতি : যারা ভয় করে করুক। কিন্তু আমি তোকে ভয় করি না। তোকে উপরে তুলে এমন এক আছাড় মারবো যে তোর হাড়গোড় একেবারে ভেঙে যাবে।
সিংহ: তুই আমাকে আছাড় মারবি আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো? আমি তোর শুঁড়ে এমন এক থাবা মারবো যে, মাটিতে গড়াগড়ি খাবি আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করবি।
এ কথা শুনে হাতি গায়ে আগুন ধরে গেল। চোখের পলকে হাতি তার শুঁড় দিয়ে সিংহের পেট ও পিঠ পেঁচিয়ে ধরল। এরপর মাটি থেকে বহু উপরে তুলে মোটাসোটা গাছের দিকে প্রবল জোরে ছুঁড়ে মারল সিংহকে। তারপর নিজের পথে ধরে এগিয়ে গেল হাতিটি।
সিংহ উড়ে গিয়ে পড়লো গাছপালার উপর। তার মাথা গিয়ে পড়লো একটা বিশাল মেহগনী গাছের গোড়ায়। ‘মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে পড়লো সিংহ। শিয়াল গাছের আড়ালে বসে নীরবে এ ঘটনা দেখছিল। কিছুক্ষণ পর সিংহের হুশ ফিরে এলো। কোনোমতে নিজেকে গাছপালার ফাঁক থেকে বের করে আনলো এবং বাইরে রোদে এসে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। এ সময় শিয়াল সিংহের সামনে গিয়ে সালাম দিল। তারপর বলল :আমি দূর থেকে দেখলাম আপনি এখানে শুয়ে আছেন। ভাবলাম মহারাজ বোধহয় অসুস্থ। তাই আপনার খেদমতে ছুটে এলাম।
সিংহ : তুই ঠিকই ধরেছিস কিছুদিন যাবত শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাই শিকারও করতে পারছি না। কিন্তু তোকে তো চিনতে পারলাম না। তোর বাবার নাম কি?
শিয়াল: মহারাজ! আমি এই জঙ্গলেই থাকি। আমার বাবার নাম থালাব। আমাদের বংশ আপনার পরিবারের খাদেম ছিল। আমরা তো আপনাদের শিকার করা পশুর উচ্ছিষ্ট খেয়েই বেঁচে আছি হুজুর!
সিংহ: হ্যাঁ, তোর বাবাকে চিনতাম। সে আমাদের খুব খেদমত করতো। আজ তোকে একটা কাজ দিতে চাই, পারবি তো কাজটি করতে?
শিয়াল: এই গোলাম আপনার খেদমত করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবে। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য?
সিংহ: তুই তো দেখতেই পাচ্ছিস আমার শরীরটা বেশী ভাল না। তুমি যদি বুদ্ধি করে কোনো পশুকে এখানে আনতে পারিস তাহলে পেটে কিছু দানাপানি পড়ত। তুই ভাবিস নে যে, তোকে রেখেই আমি একা একা খাব। দু’জন মিলে মজা করে খেতাম আর কি!
সিংহের প্রস্তাবে শিয়াল রাজি হল। তারপর সোজা চলে গেল মেষ ও ছাগল পালের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল একটি ছাগল পাল থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে। তখন সে সুযোগ বুঝে ছাগলের কাছে গেল। শিয়াল কিছু লতাপাতা মুখে পুরে তিরিং-বিরিং লাফানো শুরু করল। ছাগল দূর থেকে শিয়ালের খেলা দেখে সেদিকে মনোযোগ দিল। খেলা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই শিয়ালের কাছে এসে হাসতে লাগল ছাগলটি। এরপর হাসি একটু থামিয়ে শিয়ালকে বলল: তোমার মনে আজ অনেক ফুর্তি তাই না শিয়াল ভায়া?
শিয়াল : ফুর্তি থাকবে না কেন? আমি তোর মত মাঠে পড়ে থাকি? আমার যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাই। খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা আর মনে আনন্দে ঘুরে বেড়ানোইতো আমার কাজ।
ছাগল : খেলাধুলা ভাল। তবে জীবনটাতো শুধু খেলাধুলার জন্য নয়। বেঁচে থাকতে হলে, কাজ-কর্ম, বিপদাপদ এমনকি সিংহ, বাঘ, ভল্লুক এসব দুশমনের কথাও ভাবতে হবে।
শিয়াল : কি যে বলিস তুই! এসব একদম বাজে কথা। বাঘ-ভল্লুক, এরা আবার কোন্ জানোয়ার? তুই কোনদিন নিজ চোখে এদেরকে দেখেছিস?
ছাগল : আমি দেখি নাই। তবে শুনেছি ওরা খুব ভয়ংকর প্রাণী।
শিয়াল: একদম বাজে কথা। ওরা মোটেই ভয়ংকর প্রাণী না। এই আজই তো আমি এক সিংহের সঙ্গে খেলা করে এলাম। তার কান ধরে কামড় দিলাম। লেজ ধরে টানলাম। কই আমাকে তো কামড় দিল না! তুই বিশ্বাস না করলে আমার সঙ্গে চল। তুইও সিংহের সঙ্গে খেলা করতে পারবি।
শিয়ালের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না ছাগলটি। তারপরও মনে কৌতুহল জাগল সিংহকে এক নজর দেখার। শিয়ালও ছাগলকে এই বলে লোভ দেখালে যে, সিংহকে এক নজর দেখা মানে নিজেকে ধন্য করা। এর মাধ্যমে ছাগলের সম্মানও অনেক বেড়ে যাবে।
শিয়ালের চালাকি বুঝতে না পেরে সিংহকে দেখার ভয়ংকর সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলল ছাগল। বনের ভেতর গিয়ে ছাগল যেই সিংহকে দেখলো অমনি ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেল। সেখানেই থেমে গিয়ে ছাগলটি বলল:
ছাগল: শিয়াল ভাইয়া, আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি আর সামনে যাব না। আজ যদি কোন বিপদ আসে তাহলে সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে। আর সিংহটি যদি অসুস্থই হয় তাহলে একটা অসুস্থ প্রাণীকে কষ্ট দেয়া মোটেই উচিত হবে না।
শেষ পর্যায়ে এসে ছাগলকে বাগে আনা যাচ্ছে না দেখে শিয়াল খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিন্তু হতাশ না হয়ে আবার ছাগলকে ধোঁকা দেয়া শুরু করল। শিয়াল বলল ;
শিয়াল: তুই মিছেমিছি ভয় পাচ্ছিস। একটা অসুস্থ প্রাণী আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তারপরও তুই যদি আমার সঙ্গে যেতে না চাস তাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমি গিয়ে সিংহের সঙ্গে খেলা করে আসি। যদি দেখিস সিংহ আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে তাহলে আমি ‘হুক্কাহুয়া’ ডাক দেয়ার সাথে সাথেই চলে আসিস।
শিয়াল এ কথা বলে এগিয়ে গেল সিংহের কাছে। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল:
শিয়াল: মহারাজ! খুব সাবধানে থাকবেন। আমি বহু ছলতাচুরি করে একটা ছাগলকে সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে আসতে চাচ্ছে না। আমি এখন আপনার সাথে কিছু খেলতামাশা করবো। আর আপনি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবেন। তাহলে দেখবেন ছাগলও এক্ষুনি এখানে চলে আসছে।
ছাগলের গোশত খাওয়ার লোভে বনের রাজা সিংহ শিয়ালের এ অন্যায় প্রস্তাবও মেনে নিল। শিয়াল এ সময় সিংহের লেজ ও কান ধরে টানাটানি করতে লাগল। তারপর সিংহের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এদিক-ওদিক যেতে লাগল। দূর থেকে ছাগল এসব দেখ খুব মজা পেল। এ সময় শিয়াল হুক্কাহুয়া ডাক দিতেই ছাগলটি ছুটে গেল সিংহের কাছে। ছাগল বলল :
ছাগল : আমিও সিংহের কানের কাছে ভ্যা ভ্যা করবো, কানে সুড়সুড়ি দেবো এবং লেজে কামড় দেবো।
শিয়াল বলল: তোর যা মনে চায় তাই কর। এমন সুযোগ তো আর পাবিনে।
ছাগল তখন খুশীতে এগিয়ে গেল সিংহের কাছে। কানে ভ্যা করে চিৎকার দিতেই সিংহ এক ঝটকায় ছাগলকে দুই থাবা দিয়ে ধরে ফেললো। এরপর সিংহ বলল: এই পুচকে ছাগল! লাজ-শরমের মাথা খেয়েছিস নাকি!! বেয়াদব-বেহায়া ছোটলোক কোথাকার! তুই যে অন্যায় করেছিস তাতে তোকে খেয়ে ফেলা আমার জন্য ফরজ।
সিংহের ধমক খেয়ে ছাগল কান্নাকাটি শুরু করে দিল এবং বলল: আমার কোন দোষ নেই মহারাজ! এই বজ্জাত শিয়ালই আমাকে এখানে এনেছে। আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করার শিক্ষাও সে-ই দিয়েছে। আমাকে মাফ করুন হুজুর।
সিংহ বলল : তোর কোন মাফ নাই। তোর আক্কেল-বুদ্ধি থাকলে দলবল ছেড়ে শিয়ালের কথায় আমার সাথে খেল-তামাশা জুড়ে দিতি না। তুই ইচ্ছা না করলে শিয়াল তোকে জীবনেও আমার কাছে আনতে পারতো না। তোর অপরাধের শাস্তি তোকে ভোগ করতেই হবে।
এই বলে ক্ষুধার্ত সিংহটি ছাগলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছাগল বুঝতে পারল, শিয়ালের ধোঁকা আর নিজের বোকামীর কারণেই তাকে সিংহের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
এ গল্প থেকে আমরা দু’টি বিষয় শিখতে পারলাম। বিষয় দু’টি হলো কাউকে ধোঁকা দেয়া কিংবা প্রতারণা করা যেমন যাবে না তেমনি প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়াও ঠিক হবে না। #