
বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভাল ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই মুনাফিকের বৈশিষ্টগুলোর সঙ্গে পরিচিত। মুনাফিকের চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো ওয়াদা ভঙ্গ করা বা কথা দিয়ে কথা না রাখা। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, তোমরা এমন কথা বল যারা তোমরা কর না।”
আমিরুল মুমেনীন ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে আমানতের ব্যাপারে আস্থাশীল নয় এবং বিশ্বাসঘাতকতা থেকে বিরত থাকে না।” তিনি আরো বলেন, “বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার কর কেননা এটা নিকৃষ্টতম পাপের কাজ। বিশ্বাসঘাতকরা অবশ্যই তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য দোজখের আগুনে জ্বলতে থাকবে।”
মহান আল্লাহ ঈমানদারদের সম্পর্কে বলেছেন, “এবং এসব লোক আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।” সুতরাং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না তারা যে মুনাফিক তা সহজেই বোঝা যায়।
তো বন্ধুরা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা ওয়াদার খেলাফ নিয়ে শুরুতেই আছে একটি গল্প। তাহলে প্রথমেই শোনা যাক আমাদের আজকের গল্প ‘কথা না রাখার পরিণতি’।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। সে সময় মরু এলাকার মানুষের একটা পেশা ছিল পশুপালন করা। সবারই প্রায় অনেক অনেক গরু, ছাগল কিংবা ভেড়া থাকত। অনেকের আবার উটও থাকত। যাদের অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল তারা তাদের পশুগুলোকে চরানোর জন্যে কিংবা দেখভাল করার জন্যে বেতন দিয়ে একজন রাখাল রাখত। রাখালবৃত্তির পেশাটি তখন যেমন খুবই প্রচলিত ছিল তেমনি মরুবাসী সবারই কমবেশি পশুরপাল ছিল।
এরকমই একজনের ছিল প্রচুর দুম্বা আর গরু। পশুর সংখ্যা দিয়ে সে সময় কে কত সম্পদশালী তা পরিমাপ করা হতো। এই আমাদের গল্পের এই পশুর মালিক সম্পদের দিক থেকে গরিব না হলেও মনের দিক থেকে ছিল একদম গরিব। এতো পশু থাকার পরও কৃপণতা করত। পয়সা দিতে হবে বলে সে কোনো রাখাল রাখেনি। নিজেই সারাদিন কষ্ট করে মরু প্রান্তরে নিজের পশুগুলো চরাত আর দিনশেষে পশুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরে আসত।
একদিনের ঘটনা। প্রতিদিনের মত সেদিনও সে তার পশুগুলোকে চরাতে নিয়ে গেল এক প্রান্তরে। সেদিন আবহাওয়া খুব একটা সুবিধার ছিল না। আকাশে মেঘ ছিল। সেইসাথে ফসলা ফসলা বাতাসও। সব মিলিয়ে প্রকৃতি সেদিন বৃষ্টির সম্ভাবনার আভাস দিচ্ছিল। মেষপালের মালিক তাই অপেক্ষা করছিল। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা দেখতে পেলেই পশুর পাল নিয়ে ফিরে যাবে বাড়ি।
অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি আর সেই সাথে দমকা বাতাস। কী আর করা। তাড়াতাড়ি করে পশুগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করল লোকটি। কিন্তু পশু তো পশুই, তাও আবার এক জাতের নয়। গরু যায় একদিকে, মেষ যায় আরেক দিকে। সেইসাথে বিচিত্র শব্দে তাদের ডাকাডাকি। বৃষ্টির শব্দের সাথে ঝড়ো বাতাসের শাঁ শাঁ মিশ্রণ। সবমিলিয়ে এক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
এরকম পরিস্থিতিতে একজন রাখাল থাকলে কতোই না ভালো হতো! কিন্তু না, কৃপণ মেষপালের মালিক কাউকে পয়সা দেবে না। সব ঝামেলা, সব কষ্ট, সব প্রতিকূল পরিস্থিতে সে একাই সামলাবে। কিন্তু পারল কোথায়! পশুদের একত্রিত করতেই হিমশিম খেয়ে গেল। সেইসাথে তুমুল বৃষ্টি আর প্রবল ঝড়ের তোড়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল।
বৃষ্টির প্রবল বর্ষণ থেকে বাঁচতে মেষমালিক শেষ পর্যন্ত উঁচুতে একটা গাছের নীচে আশ্রয় নিল। এদিকে বৃষ্টিতে ভিজে তার গরু আর দুম্বাগুলো জবুথবু হয়ে একটার গায়ে আরেকটা লেগে রইল। বৃষ্টি কিংবা ঝোড়ো বাতাসের সময় পশুরা জাতের কথা ভুলে গিয়ে এভাবেই একত্রিত হয়ে থাকে, যাতে দুর্যোগ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পায়।
মেষমালিক গাছের শাখার আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল- কখন বৃষ্টি থামে, কখন ঝড়ো বাতাস থামে, সে আশায়। কিন্তু তার আশায় গুড়েবালি।
অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করল, তবু না বাতাস থামল না, বৃষ্টি কমল। গাছের পাতা ভেদ করে বৃষ্টি এখন নীচেও সরাসরি পড়তে শুরু করল। উপরের দিকে চোখ তুলে এদিক ওদিক তাকালো মেষপালের মালিক। হঠাৎ তার দৃষ্টি থেমে গেল দূরে একটা মিনার দেখে। কী চমৎকার মিনার। মিনারের পাশে বিশাল গম্বুজ ফিরোজা রঙের। এই গম্বুজের নীচে শুয়ে আছেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সা.) এর পবিত্র বংশের একজন পুরুষ বা ইমামজাদা। তাঁদের স্মরণে গড়ে ওঠা পবিত্র মাজারগুলোও ইমামজাদা নামেই খ্যাতি পেয়েছে। বড়ই মহান ছিলেন তাঁরা।
মেষমালিক ওই ইমামজাদার দিকে দৃষ্টি মেলে ধরে মনে মনে কী যেন ভাবল। এরপর চোখ বন্ধ করে বলল: হে আল্লাহ! তুমি যদি আমাকে এই বৃষ্টি-বাদল আর ঝড়-তুফান থেকে রক্ষা কর তাহলে আমি আমার পশু পালের অর্ধেক পশু এই ইমামজাদার উদ্দেশ্যে গরিব মিসকিনকে দান করে দেব। এভাবে মানত করার পর ধীরে ধীরে বৃষ্টিও কমে এল, ঝোড়ো বাতাসও প্রায় থেমে গেল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মেষমালিক তার পশুপাল নিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
পশুর পাল নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে কৃপণ মেষমালিক মনে মনে বললো: ঝড় বৃষ্টি তো আস্তে আস্তে থেমেই যেত, কেন যে আমি অস্থির হয়ে গেলাম আর এতোগুলো পশু মানত করে বসলাম। অর্ধেক গরু আর অর্ধেক দুম্বা আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দিতে হবে..কী সাংঘাতিক ব্যাপার। কেন যে একটু ধৈর্য ধরলাম না..ইস্..স..স।
পথে যেতে যেতে ইমামজাদার দিকে তাকালো আবার। সামনেই ইমামজাদা। তার তো পশুপালের অর্ধেকটা সেখানে দিয়ে যাবার জন্যে মানত করেছিল। চিৎকার করে বলল: হে প্রিয় ইমামজাদা! আমি তো ঝোঁকের মাঝে আপনার উদ্দেশ্যে আমার পশুপালের অর্ধেকটা দান করে দেব বলে মানত করেছিলাম। কিন্তু আপনি হয়তো চান না যে, পশুগুলো আমি যাকে-তাকে দিয়ে দেই। আসলে এটা কী করে সম্ভব, আমি পশুগুলোকে এনে আপনার মাজারে দান করি আর আপনার যা খুশি তা-ই করেন! তা কি হয়?
এই বলে মেষমালিক তার পশুগুলোকে আবার নিয়ে চলল বাড়ির দিকে। পশুপালের দিকে তাকাতেই মানতের কারণে তার অনুশোচনা হলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা এল। আবারো ইমামজাদার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতে শুরু করল: হে প্রিয় ইমামজাদা! আপনার তো কোনো রাখাল নেই। তাই আমি যদি আপনার উদ্দেশ্যে দানের পশুগুলো চরাই, লালন পালন করি, কেমন হয়! দুধ, পশম আর কাশ্ক যেটুকু হবে সেগুলোর অর্ধেকটা আমি গরিব ফকিরকে দান করে দেব! এই বলে মেষমালিক আবার রওনা দিল।
হঠাৎ তার মনে পড়ল গরু আর মেষের রাখালগিরি করা তো সহজ কাজ নয়, বেশ কষ্টের। ইমামজাদার দিকে লোকটি আবার তাকিয়ে বলল: আমি তো বলতে ভুলে গেছি! আমি যে তোমার গরু আর দুম্বাগুলো লালন পালন করব আমার বেতনের কী হবে! এককাজ করব, মানতের পশুগুলোর দুধ আর কাশ্ক বা দুগ্ধজাত খাবারগুলো আমার পারিশ্রমিক হিসেবে আমি নেব। পশমগুলো তোমার রাস্তায় অর্থাৎ ফকির গরিবকে দিয়ে দেব।
এসব বলতে বলতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সে। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। সামনেই ইমামজাদা। ইমামজাদার মাজার পার হবার সময় মাজারের দিকে তাকিয়ে সে আবারো বলল: আমার জীবন আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক।
আপনির দুম্বার পশম দিয়ে কী করবেন? আমি তো ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টিতে আটকে গিয়ে মানত করে বসেছিলাম। কী জানি কী বলেছিলাম কে জানে! আসলে ‘কীসের কাশ্ক আর কীসের পশম’……
মেষমালিকের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ তুমুল জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়ে গেল। আশ্চর্যরকমভাবে কোত্থেকে যেন বন্যার ঢল নেমে এল। একেবারে খরস্রোতা বন্যা। ওই ঢল মেষমালিকের পশুগুলোর একাংশ তুলে নিয়ে গেল। মরে গেল ঢলের মুখে পড়া পশুগুলো..কিছু গরু, কিছু দুম্বা। মেষমালিক হতবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখল।
এই ঘটনার পর কেউ বিপদে পড়ে মানত করে সেটা পূরণ না করলে প্রবাদের মতো বলতে শুরু করে ‘চে কাশকি, চে পাশমি’। মানে ‘কীসের কাশ্ক আর কীসের পশম’..।