মধ্য এশিয়ার দেশ তাজকিস্তান ।১৯৯০ সালের আগে সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনে ছিল দেশটি । সুন্দর এ দেশটির মানুষগুলোও খুব সুন্দর । তাদের লোকগল্পগুলো আরো সুন্দর ।
এমনি একটি গল্প এক কাঠুরিয়াকে নিয়ে । স্ত্রীকে নিয়ে সে বনেই বাস করত । কাঠুরে প্রতিদিন দড়ি আর কুঠার নিয়ে উুচু পাহাড়ের উপরে যে বন সেই বনে কাঠ কাটতে যেত । সেখানে সে কাঠ কেটে কাঠ চেলা করত আর বেঁধে বাজারে বিক্রি করত । বিক্রি করে যে অর্থ্ পেত তাই দিয়ে সে আর তার বউ কোনোমতে দিন যাপন করত । একদিন সেই কাঠুরে বিরাট এক গাছ কেটে চেলা করতে যাবে, এমন সময় দেখল একটা লম্বা মস্ত বড় ভালুক তার দিকে এগিয়ে আসছে । আল্লাহই জানেন ওটা কোথা থেকে এলো । ভালুকটা আমাকে এক্ষুণি খেয়ে ফেলবে, কাঠুরে ভবল । ভয়ে আধমরা হয়ে সে জীবনের সবকিছুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল । কিন্তু ভালুকটা কাঠুরের সমস্ত আশংকা মিথ্যে করে দিয়ে তাকে কোনোরকম আঘাত করল না । ‘এই যে ভাই’. ভালুকটি বলল ।’আমি প্রতিদিন দেখি তুমি কষ্ট করে এখানে আস, গাছ কেটে চেলা কর, বোঝা বাঁধ । বলতো, তুমি এসব কেন কর?’ কাঠুরে ভয়ে ভয়ে বলল,’আমি এ কাঠ বাজারে বিক্রি করি এবং যা পাই তাই দিয়ে আমার স্ত্রী ও আমি কোনরকমে জীবনযাপন করি । ভালুক উত্তর দিল, তাই যদি হয় তাহলে তোমাকে আর এভাবে কষ্ট আর পরিশ্রম করতে হবে না । আমি তোমার জন্য প্রতিদিন এক বোঝা কাঠ সংগ্রহ করে সেটা পাহাড়ের গোড়ায় রেখে আসব । তোমাকে শুধু এসে কাঠের বোঝাটা ওখান থেকে নিয়ে যেতে হবে ।
পরদিন কাঠুরে ভীষণ খুশি হয়ে দেখল যে, জায়গামতো এক আঁটি কাঠ পড়ে রয়েছে । সে বোঝাটা ঘাড়ে উঠিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল । এভাবেই কাটল কয়েকদিন । কাঠুরে ভাবল,’ ভালুকটা এত ভালো ! আমার উচিত তার এই দয়ার স্বীকৃতি দেয়া । সে তার স্ত্রীকে বললো, ভালো করে রাতের খাবার তৈরী কর, আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে আসব । কাঠুরে পাহাড়ে উঠে ভালুককে খুঁজে বের করল এবং রাতের খাবারের দাওয়াত দিল । ভলুক আসতে চাইছিল না । সে জানতে চাইল কাঠুরের স্ত্রী তাকে দাওয়াত করার কথা জানে কি না । কাঠুরে জবাবে বলল, তুমি যে আমার বন্ধু, আমার স্ত্রীর কাছে এটাই যথেষ্ট । অনেক অনুরোধের পর ভালুক অবশেষে রাজি হলো ।
নানান ধরণের গল্প করতে করতে ওরা দুজন ঘরের কাছে এসে হাজির হলো । কাঠুরে গিন্নি অিতিথিকে অভ্যর্থ্না করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এল । বেরিয়ে এসেই সে দেখতে পেল তার স্বামী বিশালদেহী এক ভালুককে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে । কী ভয়ংকর ! সে চিৎকার করে উঠল । এমন একটা কুৎসিত ভালুক কখনো তোমার বন্ধু হতে পারে না । ‘কথাটা শুনে ভালুক খুব আঘাত পেল । সে খূব রেগে গেল আর কাঠুরেকে বলল, আমি কুৎসিত আর ভয়ংকর ! তুমি তাহলে তোমার কুঠার দিয়ে এখনই আমার মাথায় আঘাত করো । কাঠুরে ভালুককে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলল, তুমি কে , সেটা না জেনেই আমার স্ত্রী কথাটা বলেছে, তুমি কিছু মনে করো না ভাই । যা বলছি তাই করো, আমার মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করো ’ভালুক চিৎকার করে বলল ।
কাঠুরে ভয় পেয়ে গিয়ে ভাবল, আমি যদি ওকে আমার কুঠার দিয়ে আঘাত করি, তাহলে হয়তো সে ক্ষেপে গিয়ে আমাদের মেরে ফেলবে, আর যদি ওর কথা না শুনি তাহলেও হয়তো এই জেদি ভালুক একই কাজ করবে।ও সত্যিই খুব ভালো , কিন্ত কী করব, ওর কথা না শুনে তো উপায় নেই ।
ঠিক আছে, তুমি যদি ও রকম জেদ ধরো,’কাঠুরে জোরে জোরে কথাটা বলে সমস্ত শক্তি দিয়ে ভালুকের মাথায় কুঠার দিয়ে আঘাত করল । রক্তাক্ত অসস্থায় ভালুক ওদের উঠোন থেকে দৌড়ে চলে গেল । আর কাঠুরে মন খারাপ করে তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল । কাঠুরে নিশ্চিত ছিল যে মাথায় এরকম আঘাত নিয়ে ভালুক বাঁচতে পারবে না । এ চিন্তা কাঠুরের মনটাকে বিষাদে ভরিয়ে দিল । এ ঘটনা যাতে আর মনে না পড়ে তাই কাঠুরে আরো দূর থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে শুরু করল । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অতটা দীর্ঘ্পথ কাঠুরের জন্য খূব কষ্টকর হয়ে উঠল । সে ভাবল, আমি অযথা কষ্ট করছি কেন? ভালুক তো কবেই মরে গেছে । এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই । আমি আবার আমার পুরনো বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করি না কেন?তাই কাঠুরে আবার তার পুরোনো বনে ফিরে গেল । কিন্তু একটা গাছ কাটতে না কাটতেই ভালুকটা এসে তার পাশ দাঁড়াল । কাঠুরে আশ্চর্য্ এবং হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । কোনো সন্দেহ নেই এটা সেই একই ভালুক । সে ভালুকের মাথার দিকে ভালো করে খেয়াল করে দেখল কিন্তু তার দেয়া আঘাতের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেল না । ভালুককে বেঁচে থাকতে দেখে সে মনে মনে খুশি হলো, যদিও ভীষণ ভয়ও পেল এই ভেবে যে, ভালুকটা হয়তো তাকে এবার মেরে ফেলবে ।
ভালুক তার সব কষ্ট ভুলে গেল এবং বলর, তুমিতো কুঠার দিয়ে আঘাত করেছিলে তার কষ্ট এখন আর আমার মধ্যে নেই, কিন্তু তোমার স্ত্রীর কথার আঘাত আমার মনের মধ্যে যে কষ্ট দিয়েছে সেটাতো সহজে সারবে না ।