
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বন্ধুত্ব আর কৃতজ্ঞতা নিয়ে অনেক কাহিনী শুনেছ। কারণ এই দু’টি বিষয় মানুষের জন্মের পর থেকেই আগ্রহ ছিল, আছে এবং থাকবে। এত পুরনো বিষয় হবার পরও আমরা কিন্তু এখনও জানি না, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত আর কার সঙ্গে উচিত নয়। শুরুতেই আমরা এ সম্পর্কে কিছু মূল্যবান কথা বলব। এরপর থাকবে কচ্ছপ ও বিচ্ছুর বন্ধুত্ব নিয়ে একটি রূপকথার গল্প। তাহলে প্রথমেই জেনে নিই কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত?
ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুর মর্যাদা অনেক উপরে। এজন্যই মহান আল্লাহ, নবী করিম (সা.) এবং তাঁর বংশের মহান ইমামগণ বন্ধু নির্বাচন করার ব্যাপারে মূল্যবান কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমনটি করবে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবেন না।” আর হাদিসে বলা হয়েছে, “মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল করা উচিত সে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে।” রাসূল (সা.) বলেছেন, “দুনিয়াতে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রয়েছে, পরকালে তার সঙ্গেই হাশর হবে। এজন্য বন্ধু নির্বাচনের আগে তাকে পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি।”
অন্যদিকে আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি চিন্তাভাবনা করে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।” ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেন, “সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং তিনটি গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। গুণ তিনটি হল- ১. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ২. বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময় এবং ৩. বন্ধুকে হতে হবে নেককার ও পুণ্যবান।” ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদী (রহঃ) বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।
এ উক্তির মূলকথা হচ্ছে, একজন উত্তম বন্ধু যেমন জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন অসৎ বন্ধু জীবনকে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। তাই যাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তাকে আগেই যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। জ্ঞানী, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ, চরিত্রবান, সহজ-সরল ইত্যাদি গুণাবলি দেখে বন্ধু নির্বাচন করলে আশা করা যায় সে উত্তম বন্ধু হতে পারে। বন্ধুরা, বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম তা তোমাদের জীবনে কাজে লাগবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কচ্ছপ ও বিচ্ছুর বন্ধুত্ব
কথিত আছে যে, একটা কচ্ছপ আর এক বিচ্ছু পাশাপাশি বাস করত। একে অপরের প্রতিবেশী। দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করতে করতে তাদের পরস্পরের মাঝে অনেকটা কাছের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। একজনের আরেকজনকে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু পরিচিতি আর বন্ধুত্ব কি এক কথা?
গ্রামে কিংবা শহরে কোনো এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাস করলে মুখগুলো তো প্রায় চেনা হয়ে যায়। চেনা মুখ দেখতে দেখতে আপনও মনে হয়। কিন্তু তাই বলে কি সবাই বন্ধু হয়? হয় না। যাই হোক, কচ্ছপ আর বিচ্ছু যে এলাকাতে থাকে, একদিন সেই এলাকায় ঘটে গেল একটা ঘটনা। এমন ঘটনা যে তাদের জীবনটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। জীবনের ঝুঁকি যেখানে, সেখানে তো আর যাই হোক, অন্তত বসবাস করাটা ঠিক নয়। তাই তারা ওই এলাকা ছেড়ে যাবে বলে ঠিক করল।
এ যাওয়া তো বেড়াতে যাওয়া নয়, বাধ্য হয়ে যাওয়া। কচ্ছপ আর বিচ্ছু তাই আগপাছ না ভেবেই রওনা দিল একসাথে। কিন্তু কোথায় যাবে কিছুই জানে না। তাদের অবস্থা যেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতো। সরকারি বাহিনীর অত্যাচারে ঘরবাড়ি ছেড়ে যখন তাদের চলে যেতে হয় তখন তারা জানে না কোথায় যাবে। শুধু জানে যেতে হবে, তাই যায়। কেউ সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে মরে, আবার কেউ বন জঙ্গলে গিয়ে।
কচ্ছপ আর বিচ্ছুও আপন ভিটে ছেড়ে নিরুদ্দেশে পাড়ি জমায়। যেতে যেতে তাদের সামনে পড়ে একটা নদী। বিচ্ছু তো নদীর দিকে তাকিয়ে হতাশায় স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কচ্ছপকে বলল:
বিচ্ছু: দেখেছ! কী দুর্ভাগ্য আমার!
কচ্ছপ: কেন, কী হয়েছে? দুর্ভাগ্য বলছো কেন?
বিচ্ছু: সামনে নদী! অথৈ পানি। আমি এখন না সামনে যেতে পারব, না পেছনে। যদি সামনে যাই, নদীর পানিতে ডুবে মরব। আর যদি পেছনে ফিরে যাই, তাহলে তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাব।
কচ্ছপ: চিন্তা করো না বন্ধু! আমাদের বন্ধুত্ব তো একদিনের নয়। সামনে যত বিপদই কিংবা যত সুযোগই আসুক, সবকিছুই সমানভাবে ভাগ করে নেব। তোমার সুখে দুঃখে আমি শেয়ার করব, আর আমার সুখে দুঃখে তুমি, ঠিকাছে? আমি তোমাকে নিরাপদে নদী পার করিয়ে দেব, চিন্তা করো না। তুমি আমার পিঠে চড়ে বস, আমি পানিতে ভেসে ভেসে নদী পাড়ি দেব আর তুমি আমার পিঠে বসেই চলে যাবে।
বিচ্ছু খুশি হয়ে কচ্ছপের পিঠে চড়ে বসল। কচ্ছপও সাঁতরাতে সাঁতরাতে পাড়ি জমালো নদীতে। নদীর পানির উপর দিয়ে কী আরামে যাচ্ছে বিচ্ছু! কিন্তু হঠাৎ কচ্ছপের মনে হলো, পিঠে যেন কেমন আঁচড় আঁচড়ের মতো লাগছে।
কচ্ছপ: পিঠে বসে কী করছো? কেমন যেন আঁচড় টানার শব্দ পাচ্ছি!
বিচ্ছু: না, তেমন কিছু না। চেষ্টা করছি একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করতে।
কচ্ছপ: কেন, কী করবে?
বিচ্ছু: কেন বুঝতে পারছো না! তোমার গায়ে হুল ফোটাতে…
কচ্ছপ বিস্মিত হয়ে বলল: “এই নিমকহারাম! নির্দয় বে-ইনসাফ! আমি আমার জীবনের মায়া ত্যাগ করে তোকে মহাবিপদ থেকে বাঁচাতে নদী পাড়ি দিলাম। তোকে সম্মানের সাথে আমার পিঠে বসালাম, আর তুই এই তার প্রতিদান দিলি?”
বিচ্ছু বলল: “দেখ বন্ধু! সবকিছুরই একটা স্বভাব প্রকৃতি আছে। আগুনের বৈশিষ্ট্য হলো পোড়ানো। আমার স্বভাব হলো হুল ফোটানো।”
কচ্ছপ এবার বুঝতে পারল, সে ভুল করেছে। সে বলল: “তোমার দোষ নেই, দোষটা আমার। আমি কেন তোমার মতো এক অকৃতজ্ঞকে বন্ধু বানালাম?”
এই বলেই কচ্ছপ একটি ঝাঁকি দিয়ে বিচ্ছুকে পানিতে ফেলে দিলো এবং নিজে নিরাপদে নদীর ওপারে চলে গেল।
গল্পের শিক্ষা
বন্ধুরা, কচ্ছপের সঙ্গে বিচ্ছুর প্রতারণা ও পরিণতি সম্পর্কে গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, বন্ধুত্ব করার আগে মানুষকে ভালোভাবে চিনে নিতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “শেষ বিচারের দিন সকল বন্ধুই শত্রুতে পরিণত হবে, তবে একমাত্র সৎ বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পরিচিত হবে।” তাই বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারি, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার গুণাবলি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।