কচ্ছপ

বাবা কখনো কাছিম বলেন না, বলেন কচ্ছপ।
অনেক সময় লক্ষ করেছি, কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা অথবা কথা-কাটাকাটি শুরু হলে, ওই প্রসঙ্গ বা কথার মধ্যে ডান হাতের তর্জনী সোজা করে কিছু বলার জন্য যেন সুযোগ খোঁজেন বাবা। বলেন, ‘এক্কেবারে কচ্ছপের মতো।’ একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এর মধ্যে কাছিমের মতো কী দেখলেন?’ সে কথা জিজ্ঞেস করাও যেন অপরাধ। বাবা সুযোগ পেয়ে যেতেন। তারপর এক ঘণ্টার চার ভাগের তিন ভাগ সময় নিয়ে চলত চুলচেরা ব্যাখ্যা। স্কুলশিক্ষক বাবা ঝাড়া ৪৫ মিনিট ধরে বিষয়ের বুকের ওপরে বসে বিষয়কে কাবু করতে না পারলে শান্ত হতেন না।
একদিন বিপদে পড়েছিল আমার বড় বোন হেনা। মায়ের সঙ্গে বাবার কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল, যা প্রায়ই হয়। মাকে বাবা বললেন, ‘তুমি একটা মাদি কচ্ছপ।’
কথা-কাটাকাটি কিংবা অন্য কোনো প্রসঙ্গের চূড়ান্ত রায় বাবা কখন দেবেন, আমরা জেনে ফেলেছিলাম—যখনই তিনি ‘কচ্ছপ’ বলে বাক্য শেষ করতেন বুঝতাম, নিজের ঘৃণা কিংবা তুচ্ছার্থ প্রকাশের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছেন তিনি। ‘একটা মাদি কচ্ছপ’ বলার পরেই হেনা আপা হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাছিমের স্ত্রীলিঙ্গ কী?’ এর ফল হলো বিশ্রী। বাবা এক লাফে উঠে গিয়ে হেনা আপার কোঁকড়ানো চুল ধরে টানতে টানতে বারান্দা থেকে নিয়ে গেলেন ঘরে। মা চিৎকার করে বললেন, ‘ওর কী দোষ, ওকে কি মেরে ফেলবে? দরজা খোলো।’ আমরা অবাক হয়ে শুনলাম হেনা আপাকে বাবা বলছেন, এই হচ্ছে খাতা, এই কলম, এক ঘণ্টা সময়, কচ্ছপের ওপর ৩০০ শব্দের মধ্যে একটা রচনা লিখতে হবে, স্ত্রী-কচ্ছপকে এক শব্দে কী বলা হয় সেটারও ব্যাখ্যা চাই, এ ছাড়া তোকে কে রেহাই দেয়, দেখে নেব।’
দরজায় শিকল দিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। আমার হাসি পেল। বাবার একবারও মনে হলো না, শিকল যে কেউ একটু পরেই খুলে দেবে। মা আমাকে বললেন, ‘যা, তোর বাবাকে ডেকে আন।’ আমি বলি, ‘কেন?’ মা আমার কথার জবাব দেন না। মনে হলো, কেঁদে ফেলবেন, তার বদলে বাজার থেকে কী কী আনতে হবে তার একটা ফর্দ আর ৫০০ টাকা দিয়ে চলে যান মা।
ঘরের ভেতর থেকে হেনা আপা দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমি শিকল খুলে দিলে মা বললেন, ‘দরজাটা আমি খুললে ভালো হতো।’ মায়ের কথা শুনে আপা আর আমি পরস্পরের দিকে তাকালাম। মা চান, আমরা যেন বাবাকে ভয় পাই।
আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে তপনের ছোট শিরিন দশম শ্রেণির মধ্যমানের ছাত্রী, বাবাকে একটু বেশি ভয় পায়। এই জন্য বাবা বোধ হয় ওকে খানিকটা বেশিই স্নেহ করেন। আমার ছোট তপন পড়ে কলেজের প্রথম বর্ষে। বারবার আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ায়, কোনো কথা বোঝে না অথচ ইংরেজি গান শোনে। বাবার ব্যক্তিত্বকে আমলই দেয় না। বাবা কখনো কিছু বললে উঁচু গলায় সে জবাব দেবেই; এবং সেই উত্তর বাবা যা বলবেন হবে তার উল্টো। আমার মনে হয়, বাবা ওর প্রতিবাদে ভয় পান। মা একদিন নরম গলায় তপনকে বললেন, ‘তোর বাবার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে পারিস না?’ তপনের মেজাজ তখন ভালো ছিল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে। হাতের চিরুনি মাথার পেছনে, আয়নায় স্থির দেখাচ্ছে ওর চোখ দুটি। মনে হলো, সঠিক একটা জবাব খুঁজছে ও। বলল, ‘বাবার মতো লোকদের কথার জবাব জোরে না দিলে তারা মরে যাবে, তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তঁাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর বাবাও আমাকে…এই বাসায় চিৎকার করার একজন মানুষ তো চাই।’ তপনের কথা শুনে এই প্রথম আমার মনে হলো, ও বিশ্লেষণ করা শিখছে, আগে ওকে কখনো এভাবে গুছিয়ে কথা বলতে শুনিনি।
আজ শেষ বিকেলে পলিথিনের হলুদ ব্যাগ হাতে বাবা বাসায় ফিরলেন ভিজতে ভিজতে। বাসা থেকে সকালে হেনা আপাকে ঘরে শিকল দিয়ে রেগে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন জায়গায় সেলাই দেওয়া ছাতাটা নিয়ে যাননি। বাবার হাতে ব্যাগ দেখেই মা গজরাতে শুরু করলেন। মায়ের মুখের ভেতর কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যা বের হয়ে এল তা এমন: ‘এই মানুষটার আর আক্কেল হলো না, সকালে যে বাজারের টাকা দিয়ে গেছে মনে নেই।’ সব শুনে একটু হাসলেন বাবা। এ রকম হাসি দেখলে মা আর আমরা বুঝি তাঁর মেজাজ ভালো। বললেন, ‘মাছগুলি তাজা তাই।’ ‘তাজা’ কথাটা মাছ কিনে আনার বাবা পর বলবেনই; এবং মা উত্তরে বলবেন, ‘সে তো প্রতিদিনই বলো।’ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি অবেলায় বাবার বাজার করা মা পছন্দই করেন না। কিন্তু বাজার আনার পর মা-ই বেশ যত্নে রান্না করেন গরম-গরম ঝোল, বাবার সামনে বসে পাতে তুলে দিয়ে তাঁকে খাওয়ান। অসহায় মানুষকে আরেকজন মানুষ ভালোবাসছে, দুজনের চোখমুখই তৃপ্ত—দৃশ্যটি মন্দ নয়।
হেনা আপা সত্যি সত্যি কাছিমের ওপর ৩০০ শব্দের মধ্যে একটি রচনা লিখেছে। ও কি ভেবেছিল বাবা বাইরে থেকে এসেই ওর রচনা দেখতে চাইবেন? আমাকে কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে হেনা আপা বলল, ‘এই দ্যাখ লিখেছি, বাবাকে দেব?’ আমি বললাম, ‘না, বাবা যদি তোমার রচনা দেখতে না চান, তুমি যদি নিজে থেকে দাও তবে তাঁকে অপমান করা হবে। মনে হয় ব্যাপারটা বাবা ভুলেই গেছেন।’ কথা শুনে আপা একটু হাসল, মনে হয়, বাবার মনটা বিচার করে নিল। ওদিকে ততক্ষণে রচনাটি পড়তে আরম্ভ করেছি

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!