বিকেলের রোদটা সবে গড়িয়ে পড়ছে। সব পাখিরা দিনের শেষে আগামী দিনের কাজ গুছিয়ে নিতে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছে। আর কিছু তরুণ পাখি মনের আনন্দে আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো, গন্তব্যহীন। আর কঙ্ককেই কিনা মন খারাপ করে বসে থাকতে হচ্ছে ঘরে। ওর বাবা মাও আসেনি এখনো। চলে আসবে খুব তাড়াতাড়ি, প্রতিদিন এমন সময়ই ফেরে তারা। আর ফিরেই রাজ্যের গুরু গম্ভীর কথা। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যে গা শিউরে ওঠে কঙ্কর। কবে কোন প্রতিবেশী তিন তারের মাঝ দিয়ে যেতে গিয়ে ঝলসে গেছে, এসব কথা যখন বাবা মা বলে তখন কঙ্কর ইচ্ছে করে ওখান থেকে উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও বসতে। কিন্তু ওর তো সে উপায় নেই। তবে বাবা বলেছে খুব তাড়াতাড়ি নাকি উড়তে পারবে কঙ্ক। আর এজন্য এখন থেকেই রাজ্যের উপদেশ। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। আরেকটি কথা খুব জোর দিয়ে বলে দিয়েছে বাবা মা দুজনই। কখনোই তিন তারের মাঝ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। গেলেই বিপদ। মানে বোঝে না কঙ্ক। আর বোঝার খুব বেশি চেষ্টাও অবশ্য করে না। বাবা মার কথা এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায় নিমিষেই। একবার শুধু ওড়ার শক্তি হোক, তখন কঙ্ক দেখিয়ে দেবে কিভাবে উড়তে হয়। সেদিন কঙ্ক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। নীল একটা আকাশ। আর কঙ্ক নিজে উড়ে বেড়াচ্ছে। আশপাশে আর কেউ নেই। শুধুই ভেসে ভেসে যাচ্ছে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই। এর পরই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মায়ের ডাকে। সন্ধ্যা লেগে গিয়েছিল তো। মা ফিরেই ডাকাডাকি শুরু করেছিল। যেমন প্রতিদিন করে। কঙ্কর এই জিনিসটাও দারুণ ভালো লাগে। সব পাখিরা সন্ধ্যা বেলায় ঘরে ফিরেই ডাকাডাকি করে! সারাদিন কে কোথায় কি করল, আগামী দিন কি করা হবে, এসব।
ভাবতে ভাবতে কখন যে সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেছে খেয়াল করেনি কঙ্ক। টের পেল মায়ের ডাকে। বাবাও চলে আসল একটু পরেই। এসেই প্রতিদিনের কাজ শুরু করলো তারা। আর কঙ্ক চুপ করে বসে তাই শুনতে থাকলো। তার ঠিক কিছুক্ষণ পরেই বাবা যখন কঙ্ককে বললো যে কালকে ওকে ওড়া শেখানো হবে, তখন আর কঙ্ককে পায় কে! ওর চিৎকারে তখন কান পাতাই দায়। এই লাফাচ্ছে তো পরেই আবার ওর বাবার কালো পালকগুলোর ভিতরে গিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। ওর কাণ্ড দেখে তো বাবা মা দুজনই হেসে খুন। বাবা বললেন- হয়েছে হয়েছে আর আনন্দ করতে হবে না। আর মা বললেন- এখন ঘুমিয়ে পড়। সকাল হলেই শুরু হবে ওড়াউড়ি। বল্লেই কি হয়! কঙ্কর চোখে তো আর ঘুম নেই আজ। কঙ্ক কেবল ভাবছে কিভাবে উড়বে কাল। উড়ে কতদূর যাবে। ভাবনার কি আর শেষ আছে!
ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে গেছে জানে না কঙ্ক। ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে।
এই কঙ্ক আর কত ঘুমাবি! ভুলে গেছিস আজ কি করার কথা?
বাবার ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসেছে কঙ্ক। কি যে বলে বাবা! আজকের দিনের কাজ কি ভোলা যায়? কখন যাব বাবা? ত্বরিৎ গতিতে কঙ্কর জিজ্ঞাসা। এই তো এখনি। সূর্যটা ভালো করে উঠে নিক। এখনো আলসে ভাঙেনি শরীরের। আবার সারাদিন ঘুরে বেড়াতে হবে। বাবার আলসে জড়ানো কন্ঠ।
বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কঙ্ক এবার তাকায় মায়ের দিকে। মা এখনো তার কুচকুচে কালো শরীরটাতে ঠোট ঢুকিয়ে বসে আছে। তাকাতেই মা বলে উঠলো
কঙ্ক তুই বড় হয়ে গেলি? আর তো আমার কোনো চিন্তা নেই।
গর্বে বুক ফুলে ওঠে কঙ্কর। হঠাৎ করে আবার কান্না পেয়ে যায়। বড় হলেই তো বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে হবে। আলাদা বাসা বানাতে হবে। এসব মোটেও ভাবতে চায় না ও। কদিন আগে খাঁ খাঁ দুপুর বেলাতে মা ওর জন্য খাওয়ার নিয়ে এসে খাওয়াতে খাওয়াতে এই কথাগুলো বলছিলো। তা শুনে কঙ্কর সে কী মন খারাপ। কেন বড় হলেই বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে হবে! কেন এই ছোটবেলার মতো করে বাবা মা ওকে আদর করবে না? খুব কান্না পেয়েছিল কঙ্কর। সেই কথাটা আবার মনে পড়ে গেছে ওর। তবে সেই মন খারাপ করা বিষয়টাকে এখন মোটেও পাত্তা দিতে চাইছে না কঙ্ক। আর কিছুক্ষণ পরেই ওর এই ছোট্ট জীবনটার স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। এখন কি মন খারাপ করলে চলে?
এই কঙ্ক চল চল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়। বাবা তাড়া দিয়ে ওঠে, এবার শুরু হবে তোর ওড়ার প্রশিক্ষণ।
কঙ্কর হঠাৎ করে বুক কেঁপে ওঠে। পারবে তো! নিজের বুকটার ঢিপ ঢিপ শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে কঙ্ক। বাবা উড়ে গিয়ে পাশের ডালে বসে। ওখান থেকেই ডাকতে থাকে কঙ্ককে। ওর পাশে বসে থেকে মা উৎসাহ দিতে থাকে। সব শুনে টুনে কি রকম যেন হয়ে যায় কঙ্কর মাথা। হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে। কিন্তু কিসের কি। সোজা গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো কঙ্ক গিয়ে পড়ে গাছের নিচে ভাটি ফুলের ঝাড়টাতে। ঘাড়ে দারুণ ব্যাথা পেয়েছে কঙ্ক। মনে হচ্ছে মরে গেছে। তারপরই বাবার গলা শুনতে পায় পাশেই। বাবা বলছে, ব্যাথা পেয়েছিস? ব্যাথা না পেয়েই উড়তে চাইলে তো হবে না। নে আবার শুরু কর। এবার মাটিতেই চেষ্টা কর। এই কথা বলে বাবা গিয়ে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে সেখান থেকে ডাকতে থাকে কঙ্ককে। কঙ্করও জেদ চেপে যায়। কোনো রকমে উঠে দাড়িয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে বাবাকে লক্ষ্য করে। মজার ব্যাপারটা তখনই টের পায় কঙ্ক। মাটির একটু ওপর দিয়ে সোজা গিয়ে দাড়ায় বাবার পাশে। আর ওটুকু করতে পেরেই সেকি আনন্দ কঙ্কর। তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দেয় ও।
২.
তন্ময়ের আজ মনটা বড্ড খারাপ। ঈদের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকী। অথচ এখনও এত এত হোমওয়ার্ক, ক্লাস। আর ভালো লাগে না তন্ময়ের। নিজের জীবনটাকে ব্যবহার করা টিস্যু পেপার মনে হয় ওর। কোথায় ঈদ নিয়ে প্ল্যান করবে বিল্টু, রাসেলদের সঙ্গে। তা না, কেবল ক্লাস আর ক্লাস। আর বাবা মাও যেন কেমন। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো ভালো কথাই বলে না। কেন এমন হয়! বাবা মা’রা কেন বোঝে না তন্ময়ের সব সময় পড়াশোনার কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগে না। রাজ্যের যত গুরুগম্ভীর কথাবার্তা। স্কুল থেকে ফেরার সময় আজকে তন্ময় ভাবছিল যদি পাখি হতে পারতাম! কোনো চিন্তা নেই। শুধুই আকাশে ভেসে থাকা। ভাবতে ভাবতেই বাসায় চলে আসে তন্ময়। এখন এই যে সন্ধ্যা লেগে যাচ্ছে, কিন্তু দেখো তন্ময় মন খারাপ করে বসে আছে। হঠাৎ তন্ময়ের মনযোগ চলে যায় রাস্তার ওপাশের আম গাছগুলোর দিকে। প্রতিদিনই এই সময়টাতে এই ঘটনাটা ঘটে। রাজ্যের যত কাক আছে সবগুলো মনে হয় এই জায়গাটাতে থাকে। সারাদিন কোথায় ঘুরে বেড়ায় তার কোনো হদিশ থাকে না। সারাদিন আস্তাকুড়ে এঁটোকাটা খেয়ে বেড়ায়। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ঠিক দেখো সব এসে হাজির হয় এখানে। আর এসময় এদের চিৎকারে কান পাতাই দায়। মা তো প্রতিদিনই ক্ষেপে যায়। কেন তোদের প্রতিদিনই এই সভা! না করলেই কি নয়? রীতিমত মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। বাবা তো প্রতিদিন এসময় বাড়িতে থাকে না। যেদিন থাকে সেদিন মায়ের চিৎকার শুনতে শুনতে একসময় বলে, আরে থাক না ওরা। ওদের যাওয়ার জায়গা গুলো খুব ছোটো হয়ে আসছে। একটু মেনে নিলেই তো আর কোনো সমস্যা নেই। বাবার কথা শুনে মায়ের মেজাজ যেন আরো বেড়ে যায়।
তুমি তো বাড়িতে থাকো না প্রতিদিন। সবদিন এই অত্যাচার সহ্য করতে হলে বুঝতে।
বাবা এসময় মিটিমিটি হাসে। বাবা মা’র কথা শুনে দারুণ মজা পায় তন্ময়। আরো এক সময় কাকগুলো তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। বিদ্যুতের তারে কোনো কাক আটকে মারা গেলে যেন ওদের শোক সভা বসে। এ সময় অবশ্য মা বলে, আহারে আরেকটা কাক বুঝি তারে আটকে মারা গেল। তবে বিষয়টা সত্যিই অদ্ভূত। তাহলে কি কাকদেরও নিজেদের সমাজ ব্যবস্থা আছে! কেউ মারা গেলে ওরাও তবে শোক পালন করে। তন্ময়ের ভাবনার শেষ নেই। এই যেমন বাবার কথাও তো ওকে ভাবায়।
সত্যি তো। যেভাবে গাছ কেটে ফেলে মানুষ বাড়ি বানাচ্ছে তাতে তো আর ওদের থাকার জায়গা থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে আর কোনো পাখি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেদিন স্কুলে হারুন স্যারও এই কথা বলছিলেন। বলছিলেন ইকো সিস্টেমের কথা। বুঝতে একটু খটোমটো লাগলেও তন্ময় অন্তত এটুকু বুঝেছিল যে প্রকৃতিতে প্রত্যেকটি প্রাণীর প্রয়োজন আছে। কোনো প্রাণী হারিয়ে গেলে একসময় মানুষও হারিয়ে যাবে।
এখন এই সন্ধেবেলা চুপ করে বারান্দায় বসে তন্ময় যখন এত কথা ভাবছিল, তখনই বাবা এসে বাসায় ঢুকেছে। একদম তন্ময়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছিস তন্ময়?
হঠাৎ বাবার গলা শুনে চমকে তাকালো তন্ময়। তারপর বাবাকে দেখে এমনিতেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল ওর। কিছু না বাবা, কাকগুলোর কথা ভাবছিলাম। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিল তন্ময়।
কাক নিয়ে গবেষণা! তুই তো কাক বিজ্ঞানী হয়ে গেলি! মজা করলো বাবা।
মজার ধার কাছ দিয়ে না হেঁটে তন্ময় জিজ্ঞেস করলো, বাবা এবার ঈদের কেনাকাটা আমরা কবে করবো?
ভালো কথা বলেছিস। আমরা কালই যাচ্ছি মার্কেটে।
বাবার উত্তর শুনে আনন্দে একটা লাফ দিয়ে ফেললো তন্ময়। সত্যি বাবা! কি কি কিনবো আমি!
ঐ হল, ঈদের চিন্তায় এমনিতেই ছেলের মাথায় পড়াশোনা ঢুকছে না। তার মধ্যে আবার কেনাকাটা। পাশ থেকে মা বলে উঠলো।
রাতে শুয়ে শুয়ে তন্ময় কাল কি করবে তাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো। আর ঘুম ভাঙলো আবার সেই কাকের চিৎকারে, পরদিন সকালে। বিছানা থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তন্ময় দেখে একটা ছোট কাক মাটিতে পড়ে আছে আর তার পাশেই বড় কাকটা চিৎকার করে যাচ্ছে একটানা।
৩.
কঙ্ক এখন খুব ভালো না হলেও বেশ ভালো উড়তে পারে। এটা অবশ্য বাবার কথা। তবে কঙ্কর মনে হয়, ও খুব ভালো করে ওড়া শিখে গেছে। আর তারপর থেকেই এ ডাল ও ডালে গিয়ে বসছে কঙ্ক। আর মাঝে মাঝে আকাশেও কয়েক পাক খেয়ে নেমে আসছে। তবে মায়ের নিষেধ আছে। এই গাছের আশপাশেই থাকতে হবে ওকে। দূরে যাওয়ার সময় নাকি এখনো হয়নি। সময় হলেই বাবা মা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বলেছে। আর সত্যি কথা কি! কঙ্কও একা একা বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কাল একবার একটু দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। খুব উচু দিয়ে উড়ছিল না অবশ্য। কিছুদূর যেতেই হুশ করে কি যেন একটা চলে গেল। আর সঙ্গে পঁ পঁ করে কি আওয়াজ! শুনে মোটামুটি আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গিয়েছিল কঙ্কর। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল ঐ জিনিসটার ভিতরে অনেকগুলো মানুষ। কেউ বসে আছে আবার কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে টেখে কঙ্ক বেজায় ভয় পেয়ে যায়। আর বেশি সাহস না দেখিয়ে সোজা ফিরে আসে বাসায়। মা বলেছে মানুষ নামের ঐ প্রাণীরা নাকি খুব একটা সুবিধার না। কোনো কারণ ছাড়াই এরা যে কারো ক্ষতি করে। আর তাতে নাকি তারা বিশাল আনন্দ পায়। একটু উড়ে এসে কঙ্ক যখন বাসায় বসে এসব ভাবছিল তখনই মা ওর জন্য খাওয়ার নিয়ে আসে। মাকে দেখে কঙ্ক বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। বেশ আগ্রহ নিয়ে মাকে বলে তার অভিজ্ঞতার কথা। শুনে মাকে বেশ চিন্তিত দেখায়। এরপর কঙ্ককে বলে, কাল তোকে নিয়ে ঘুরতে বের হব।
সত্যি নিয়ে যাবে! কঙ্কর গলায় খুশির ঝিলিক।
পরদিন সকাল সকাল মায়ের সঙ্গে উড়ে গিয়ে কঙ্ক বসে একটা রাস্তার পাশে দেয়ালে। সে দেখে তার পাশেই মানুষ নামের প্রাণীগুলো বাড়ি থেকে খাবার দাবার নিয়ে এসে ফেলে রেখে যাচ্ছে। যার যেভাবে খুশি। এমন সময় মা বলে, শোন এই যে দেখছিস মানুষগুলো খাবার ফেলে রেখে যাচ্ছে এগুলো ওদের কাছে আবর্জনা। কিন্তু আমরা তো এগুলোই খাই। এখান থেকেই খাবার খুজে নিতে হবে। এখন থেকে তোর খাবার তুই নিজেই খুঁজে নিবি। কিন্তু সাবধান। মানুষদের কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। মায়ের কথা মন দিয়ে শোনে কঙ্ক। রাস্তার মানুষদের দিকে তাকিয়ে দেখে সবাই কেমন একই রকম কাপড় পড়ে হেঁটে হেঁটে একই দিকে যাচ্ছে। মাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই মা বলে, আজকে মানুষদের আনন্দের দিন। একে ওরা ঈদ বলে। এখন ওরা সবাই এক জায়গায় যাবে। এর পর আবার সবার সঙ্গে দেখা টেখা করে ফিরে আসবে। শুনে কঙ্কর মনে হয় ওদের কেন এরকম কোনো দিন নেই! সবাই এক জায়গায়া গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে মজা করা যেত। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে এত¶ণ যেন মা ওকে কি বলছিল। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকার কারণে কঙ্ক তা মোটেও শুনতে পায়নি। মা বুঝতে পারে কঙ্ক তার কথা শোনেনি। এজন্য ওকে খুব করে বকা লাগায়। বলে, তুই এখন বড় হয়ে গেছিস। আর আমি তোকে খাওয়ার এনে দেব না। নিজের খাবার তুই আজ থেকেই নিজে খুঁজে নিবি।
বকা খেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় কঙ্কর। কিন্তু কিছু বলে না। হঠাৎ করেই উড়াল দেয় আকাশে। মা অবশ্য পিছন থেকে ডাকছিল। কিন্তু সেদিকে কান না দিয়ে উড়তেই থাকে কঙ্ক। কোথায় যাচ্ছে তা নিজেও জানে না। উড়তে উড়তে কঙ্ক গিয়ে বসে একটা বাড়ির দেয়ালে। এই জায়গাটা ও চেনে না। আগে কখনো আসেনি। তবে এখন কঙ্কর মন খারাপ তো, এজন্য এগুলো কিছুই মনে হচ্ছে না ওর। এখন কঙ্কর শুধু মনে হচ্ছে, কেন বড় হতে গেল! বড় হওয়া ভালো না। মায়ের কাছ থেকে আর সেই আদর পাওয়া হবে না। মায়ের ঠোঁটে তুলে দেয়া খাবার আর খাওয়া হবে না কখনো। নিজেকে খুব একা লাগে ওর। মনে হয় পৃথিবীতে কেউ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে আবার উড়াল দেয় কঙ্ক। অনেক্ষণ নিজের মতো ভেসে বেড়ায়। এতক্ষণ কোনদিক দিয়ে যাচ্ছিলো তা খেয়াল করেনি ও। হঠাৎ সামনে দেখে তিনটা তার। মা বাবার কথা মনে পড়ে ওর। বারবার দুজনই নিষেধ করে দিয়েছিল যেন তিন তারের ভিতর দিয়ে কঙ্ক না যায়। কিন্তু এখন সেকথা কঙ্কর মনেই পড়লো না। ওর মন খারাপ তো, তাই কোনো কিছুই মনে নেই। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও হঠাৎ পিছন থেকে কঙ্ক শুনতে পায় মায়ের গলা। বারবার করে ডাকছে। যেন তিন তারের কাছে কঙ্ক না যায়। কিন্তু ততক্ষণে কঙ্ক তিন তারের কাছে চলে গেছে। তিনতারের ভিতরে দিয়ে যেতে গিয়ে কি যে হলো, কঙ্কর শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। চারদিকটা হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেল কঙ্কর কাছে।
৪.
কালকে ঈদ। উত্তেজনায় তন্ময়ের থেকে থেকেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। নতুন কেনা জামা আর জুতোর দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। কখন পড়ে বের হবে ওগুলো, এই চিন্তায় মোটামুটি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর। বাবা অবশ্য এবার ঈদে একটা দারুণ জিনিস কিনে দিয়েছে। একটা হাতঘড়ি। এমনি করে বললে তো মনে করে নেবে সাধারণ একটা ঘড়ি। কিন্তু তা না। এই ঘড়িটার ডায়াল রাতে জ্বলে। আর তাছাড়া ঘড়িটাতে একট সুইচ আছে সেটা টিপে দিলে ঘড়িটা নিজে নিজেই সময় জানিয়ে দেয়। কেনার পর থেকে কতবার যে ঐ সুইচ টিপেছে তন্ময়! মা তো বলছিল ঈদের সকালে আর নাকি ঘড়িটা দেখতে পাবে না। তার আগেই ওকে পটল তুলতে হবে। কিন্তু তাই বলে কি আর তন্ময়কে থামানো সম্ভব! হয়তো থামানো যেত। বাবা আবার মাকে বলেছে, কি হয়েছে তাতে! ওর মতো ওকে থাকতে দাও। তন্ময় তো আর কোনো বড় মানুষ নয় যে সব বুঝতে হবে। থাকুক ও নিজের মতো।
বাবার কথা শুনে তন্ময় মনে মনে বেজায় খুশি। ইচ্ছেমতো ঘড়িটাকে টিপেটুপে দেখে যখন তন্ময় মোটামুটি ক্লান্ত, তখন রাত হয়ে গেছে। মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। বাবা কোথায় যেন বের হয়েছে। জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তন্ময়। রাস্তার ওপাশে আম গাছগুলো দেখা যাচ্ছে। তন্ময়ের হঠাৎ করেই মনে পড়লো সেদিনের সেই কাকের ছানাটার কথা। ও কি সেদিন উড়তে পেরেছিল? তন্ময় সেদিন আর সারাদিন ও নিয়ে ভাবার কোনো সময় পায়নি।
স্কুল থেকে ফিরেই বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল মার্কেটে। তারপর তো ঘুরতে ঘুরতে ঘেমে টেমে এক্কেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। সেইজন্যই তো ওর মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল কাকের ছানাটার কথা। আজ আবার মনে পড়তেই খুব জানতে ইচ্ছে করলো সেদিন কাকের ছানাটা উড়তে পেরেছিল কিনা সেই কথাটা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঐ কাকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু আরেকটা কথা। তন্ময় ঐ কাকটাকে আলাদা করে চিনবে কি করে! ওদেরকে তো চেনার কোনো উপায় নেই। সত্যিই তো! তন্ময় বেশ চিন্তিত হয়ে যায় বিষয়টা নিয়ে। আচ্ছা ওদেরও কি ঈদ আছে! ওরাও কি সবার সঙ্গে আনন্দ করে। নাহ্, অনেক বেশি চিন্তা করা হয়ে গেছে। মাথাটা গরম গরম লাগছে। তন্ময় সোজা ছুট লাগালো মায়ের কাছে। যত জিজ্ঞাসা মাথায় আসে সবই তো ও মায়ের কাছেই আগে করে। এবারও কি তার ব্যতিক্রম হতে পারে!
তোর কি চিন্তা করার আর কিছু নেই! মা ওর কথা শুনে পুরো বিরক্ত। ঘরে গিয়ে বই পড়, কমিক পড় যা খুশি কর। এখন আমার অনেক কাজ। জ্বালাতন করিস না।
মনটা খারাপই হলো। কি আর করার আছে। বড়রা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে, কোনো মানে খুজে পায় না তন্ময়। তবে এই আগামীকাল যে কাকটাকে খুজে বের করবেই তন্ময় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
পরের দিন খুব সকালে তন্ময়ের ঘুম ভাঙে বাবার ডাকে। এই তন্ময় চল চল নামায পড়ে আসি। ডাকটা কানে যেতে যা দেরী হল, এর পরই এক লাফে বিছানা থেকে নেমে তন্ময় গিয়ে সোজা ঢুকলো বাথরুমে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো নামায পড়তে। ঈদগাহ থেকে নামায পড়ে ফেরার পথে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তন্ময় দেখে ইলেক্ট্রিকের তারে একটা কাক মরে ঝুলে আছে। আর রাজ্যের যত কাক সব জড়ো হয়েছে ঐ জায়গায়। ওদের চিৎকারে টেকা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বাবার হাত ধরে তন্ময় সোজা গিয়ে ঢোকে বাসায়। ওরা বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই মা বলে উঠলো, এই সকাল বেলাতেই একটা কাক মারা পড়লো। কেন যে ওরা দেখে উড়তে পারে না!
তন্ময় আবার বাসা থেকে বের হয়ে ঝুলে থাকা কাকটার দিকে তাকালো। হঠাৎ করে ওর মনে হলো, এটাই সেই কাকটা। কেবল ওড়া শুরু করেছিল তো, তাই হয়তো বুঝতে পারেনি। ঈদের দিনের শুরুতেই তন্ময়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।