কংস মামার হংস—– এস. আই. গানী

আম্মুকে স্কুলে আসতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কারণ, এর আগে আম্মু কোন দিন স্কুলে আসেনি। তবে হেড স্যারের বেতের আঘাত যে আজ খেতে হবে তা ভাল মতো বুঝতে পারছি। কেননা, আমাদের বাড়ি থেকে কেউ স্কুলে আসা মানে আমার কপালে ব্যাং ডাকা। বাড়িতে দাদুর জন্য আমাকে কেউ কিছু বলতে পারেনা। তার শোধ নেয় স্কুলে এসে স্যারদের সাথে বলে। তবে বুঝতে পারছিনা আজকে আমার অপরাধটা কী! অবশ্য আমার অপরাধ একটাই- দুষ্টামি। তবে আজ যে কী দুষ্টামি করেছি তা আল্লাহ পাকই ভাল জানেন।
আম্মুকে দেখলাম সোজা হেডস্যারের রুমে ঢুকতে। বুঝতে আর বাকি রইল না, আজকে পিঠের ছাল কতখানি উঠবে। এখনি আমার উরু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। হেড-স্যারের জোড়া বেতের মার যে একবার ভক্ষণ করেছে দ্বিতীয়বার সে কথা মনে পড়লে উরু কাঁপা এমনিতে শুরু হয়ে যাবে। কোনভাবে মারটা কাটানো যায় কিনা সে জন্য বেঞ্চের উপর বই খুলে পড়ার ভান করে বইয়ের দিকে চোখ রেখে বসে রইলাম। একটু পর মাকে নিয়ে হেডস্যার ক্লাসে ঢুকলেন। হাতে সেই জোড়া বেত। আমার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ ঢোল পিটাচ্ছে বুঝতে পারলাম আমার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্যারের দিকে তাকালাম। আমার কিছু বলার আগে স্যার বললেন, ‘‘রূপম, তোমার আম্মু তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তুমি বইপত্র গুছিয়ে আম্মুর সাথে চলে যাও।’’ বলেই স্যার চলে গেলেন। আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম একটা। তারপর, বইপত্র গুছিয়ে মায়ের সাথে স্কুল হতে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। আসতে আসতে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম এভাবে আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার কারণ কী? মা নানাবাড়ি যাওয়ার কথা বললেন। নানাবাড়ির কথা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো- সবুজ গাছপালা, মাঠ ভরা সোনালি ফসল, শাপলা ফোটা বিল, ছোট ছোট মাছে ভরা ঝিল, খাল, নদী আর নানান পাখির কিচির-মিচির স্বরের কথা।
আমি গেলে সবাই যেন আমার আপন হয়ে যায়। পাখিরা মিষ্টি সুরে আমাকে গান শুনায়। ফুলেরা নেচে নেচে আমার সাথে কথা বলে। প্রজাপতি আর মৌমাছিগুলো আমার পিছু পিছু উড়ে বেড়ায়।
কংস মামা আর আমি প্রায় সম-বয়সী। তাই আমাদের গলায় গলায় মিল। অবশ্য কংস মামা এখন আমাকে একদম সহ্র করতে পারে না। গত বছর যখন নানাবাড়ি গিয়েছিলাম তখন কংস মামা ছিল তার নানাবাড়ি রাজশাহীতে। দু’দিন পর মাম বাড়ি ফিরেছিল। তবে একা না, সাথে করে নিয়ে এসেছিল একটা রাজহাঁসের ছা। ছা-টি নাকি মামাকে তার নানি দিয়েছিল। ছা-টি দেখে আমি একটা ছড়া কেটে বলেছিলাম- ‘‘কংস মামার হংস/রাজশাহীর বংশ/খেয়ে করে ধ্বংস।’’
ছড়া-টি শুনে সবাই আমাকে বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু কংসা মামা আমার উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছিল। তারপর থেকে কংস মামা আমাকে দেখতে পারে না। আমি যেন তার দু’চোখের বিষ। তবুও আমি মামার পিছু ছাড়িনা। কারণ, কংস মামা একটু বোকা টাইপের। তার সাথে ঘুরে আমি ভীষণ মজা পাই। যে কারণে মামার পিছু আমি জোঁকের মতো লেগে থাকি। সব মিলিয়ে নানাবাড়িতে আমার দারুণ সময় কাটে। তবে দুঃখ পাই এক জায়গায়- আমার নানাদের গ্রামের সব লোকেরা গরু দিয়ে জমি চাষ করে। তাছাড়া মোহনগঞ্জ বাজার থেকে নানাবাড়ি বৌটুনি গ্রাম যাওয়ার দশ কি.মি. বর্ষাকালে রাসত্মার উপর হাটুকাদা হয়। গরুগুলো মাল বোঝায় গাড়ি টেনে নিয়ে যায় সে রাসত্মা দিয়ে। অনেক কষ্ট হয় গরুগুলোর। আর সে কষ্টে আমার ছোট্ট বুকটা ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই। নানির কাছে শুনেছিলাম ভোটের আগে প্রতিনিধিরা রাসত্মা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ভোটের পরে সে কথা তাদের আর মনে থাকেনা। আর এমনটা নাকি গত পনের বছর ধরে হয়ে আসছে। তবুও নানাবাড়িতে পৌঁছাতে পারলে আমার মনটা ভাল হয়ে যায়। নানাবাড়িতে ক’দিন থাকবো জিজ্ঞাসা করতেই আম্মু বললেন- আববুর কী একটা দরকারে নানাবাড়ি যাওয়া হচ্ছে রাতটা পার করে সকালেই আবার ফিরতে হবে। আববুর অফিস থেকে ছুটি দেবে না। তাই থাকা হবে না। ভাবলাম, নানাবাড়িতে তাহলে এবার আর মজা হচ্ছেনা! মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও নানুবাড়ি যেতে পারছি সেটাই বড় কথা।
দুপুরের পর আমরা বেরুলাম নানাবাড়ির উদ্দেশে। আমি, আম্মু এবং আববু। প্রথমে বাসে করে কিছু পথ যাওয়ার পর সেখান থেকে ভ্যানে করে মোহনগঞ্জ বাজার। তারপর মোহন গঞ্জ বাজার থেকে গরুগাড়িতে করে নানা বাড়ি বৌটুনি গ্রাম। আমরা মোহনগঞ্জ বাজারে এসে নামলাম। মোহনগঞ্জ বাজারটা অনেক ছোট। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে এ বাজারে। আর সে দু’দিনে মাছ-গোশ-তরকারিসহ সবকিছু পাওয়া যায় এখানে। আর অন্যান্য দিন তেমন কিছু পাওয়া যায় না। মোহনগঞ্জ বাজারে একটা মিষ্টির দোকান আছে। আমরা যখন নানাবাড়ি যাই তখন এ বাজার থেকে দু’কেজি করে মিষ্টি নিয়ে যাই। আজও দু’কেজি মিষ্টি নিলাম। তারপর একটা গরুর গাড়িতে উঠলাম আমরা। গরুর গাড়িতে চড়তে আমার ভীষণ আনন্দ লাগে। কচ্ কচ্ কচ্ কচ্ শব্দ করে চলে গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে বসে আমি চারপাশের প্রকৃতিকে উপভোগ করি।
অবারিত সবুজের প্রামত্ম ছুঁয়ে নুয়ে পড়া আকাশ দেখি। নির্মল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখে আমারও পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। বৌটুনি গ্রাম যাওয়ার এ রাসত্মাটা বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। দু’পাশে ধান ক্ষেত, সরষে ক্ষেত আর বিভিন্ন ফুল-ফসলের মাঠ। আর এ সব মাঠগুলোর ওপারে কালো গ্রাম। হালকা কুয়াশায় ধূসর মনে হয় অনেক দূরের ঐ গ্রামগুলো। ধানক্ষেত আর ফসলের মাঠ বেয়ে অনেকদূর যাওয়ার পর প্রশসত্ম একটা খাল রাসত্মার মাজা ভেঙে দিয়ে দু’পাশের সাঁকো দিয়ে দুপাশের রাসত্মাকে এক করা হয়েছে। দু’পাশের গাড়িগুলো এখাল পাড়ে এসে থেমে যায়। তারপর গাড়ি থেকে নেমে সাঁকো পার হয়ে ওপাশের গাড়িতে করে গমত্মব্যে পৌঁছাতে হয়। খালটার স্বচ্ছ পানিতে সব সময় অসংখ্য শাপলা ফুটে থাকে। লাল-সাদা শাপলাগুলোকে দেখে আমারও ফুল হয়ে ফুটে থাকতে ইচ্ছে করে।
সাঁকোর মাথায় এসে নামলাম আমরা। বরাবরই সাঁকো পার হতে ভয় করে আমার। দু’টো বাঁশে তৈরি সাঁকোটা খুব নড়বড়ে। যদি সাঁকো থেকে নিচে পড়ে যাই তাহলে ফুল হয়ে ফুটে থাকার পরিবর্তে শালুক হয়ে ডুবে থাকতে হবে আমার। আববুর হাত ধরে ভয়ে ভয়েই সাঁকো পার হলাম। খালের বুকের শাপলাগুলোকে দেখে লোভ হল শাপলা তোলার। একটা শাপলা তুলে মালা গাঁথার কথা আম্মুকে বলতেই আম্মু ধমক দিয়ে উঠলেন। আর সেই ধমকে একেবারে চুপ হয়ে গেলাম আমি। সন্ধ্যার সময় আমরা নানাবাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। আমাদের দেখে সবাই খুশি। একে একে সবাই আমাদের ভালমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কংস মামাকে কোথাও দেখলাম না। নানির কাছে জিজ্ঞেস করতেই নানি বললেন, মামা পড়তে গেছে। রাত দশটার পরে বাড়ি আসবে।
আমরা যে কাল চলে যাব সে কথা এসেই আম্মু নানিকে বললেন। কিন্তু নানি বিশ্বাস করতে না পেরে খানিকক্ষণ পর আবারো আম্মুর কাছে জিজ্ঞেস করলেন সত্যিই আমরা চলে যাব কিনা। আম্মু হ্যাঁ বললে নানি চিমিত্মত গলায় বললেন- ‘‘তয় অহন গোশ কোই পাই ক’তো দেহি? জামাইরে তো কহনো গোশ না খাইয়া বের হত দেইনাই!’’
আম্মু বললেন- ‘‘আজ না হয় গোশ না-ই দিলে। তাতে কোন সমস্যা নেই। তোমার জামাই কিছু মনে করবে না। আর তাছাড়া আমরা তো একটা দরকারে এসেছি।’’
কিন্তু নানি আম্মুর কথা শুনলেন না। কংস মামার হাঁসটা জবাই করার কথা বললেন।
আম্মু না করলেও নানি শুনলেন না। শেষ পর্যমত্ম তাই সিদ্ধামত্ম হল। কংস মামা হাঁসটাকে তার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসে। যত্ন করে সাদা হাঁসটার গায়ে লাল আর সবুজ রং মাখিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে অন্য লোকদের হাঁস মামাদের বাড়ি আসে। মামার হাঁসের দেয়ালেও ঢোকে। সে সব হাঁসের সাথে মিশে নিজের হাঁসটা যেন হারিয়ে না যায় সে জন্যই মামা তার হাঁসটার গায়ে রঙ মাখিয়ে রেখেছে। হাঁসটা জবাই করা হলে মামা অনেক কষ্ট পাবে জেনেও গোশত খাওয়ার লোভে আমিও সায় দিলাম হাঁসটা জবাই করতে। তারপর রান্নাবান্না শেষে পরম তৃপ্তি নিয়ে কংস মামার হাঁসটা সাবাড় করলাম। অবশ্য মামার জন্যও রাখা হয়েছে।
রাত দশটার কিছুপর মামা বাড়ি ফিরল। প্রতিদিনের মত টর্চ নিয়ে মামা দেয়ালে গেল তার হাঁসটা দেখতে। হাঁস না পেয়ে মামা চিৎকার শুরু করলে নানি বললেন- ‘‘হ্যাঁরে কংস, তোর হাঁস আইজ পশ্চিমের বড় বিলে গেছিলো। তয় ফিরে আসে নাই। অনেক খুঁইজাও পাই না।’’
নানির কথাগুলো শুনে মামা কাঁদো কাঁদো বললো- ‘‘কী কও মা! হাঁস পশ্চিমের বিলে গেছিলো! ফিরে নাই!’’
কাথাগুলো শেষ করল কী করল না তর আগেই মামা টর্চের আলোজ্বেলে পশ্চিমের বিলমুখো দৌড় শুরু করল। পেছন থেকে আমরা অনেক বার ডাকলাম কিন্তু মামা ফিরল না। শেষ মেষ বড় মামা বেরুলেন কংস মামার পেছন পেছন। রাত বারটার দিকে বড় মামা ফিরে এলেন কিন্তু কংস মামাকে কোথাও খুঁজে পাননি তিনি। আমরা সবাই চিমিত্মত হয়ে পড়েছিলাম ততক্ষণ। এবার চিমত্মাটা আরো বেড়ে গেল। আবারো খুঁজতে বেরুনো হল কংস মামাকে। কিন্তু রিক্ত হসেত্ম ফিরে এলেন সবাই। মামাকে কোথাও পাওয়া যায়নি।
এই রাতে নিশ্চয় কংস মামার ভয়ানক কোন বিপদ হয়েছে। সবাই নানিকে বকাবকি করতে লাগলেন। কেন তিনি মামাকে মিথ্যা বলতে গেলেন! আমরা সবাই চিমত্মার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হলাম। আম্মু আর নানি তো কান্না শুরু করে দিয়েছেন। আমারও খুবই খারাপ লাগছে। মাঝে মাঝে আমিও কেঁদে উঠছি। আর মনে মনে দুআ করছি, ‘‘আল্লাহ আমার কংস মামাকে তুমি ফিরিয়ে আনো। আসেত্ম আসেত্ম রাত ফুরাতে লাগল কিন্তু মামা ফিরল না। নির্ঘুমে রাত কাটল আমাদের। তারপর ভোর বেলা চারিদিকে যখন সকালের আলো ফুটতে শুরু করল তখন হঠাৎ কংস মামার কণ্ঠে হাঁক-ডাক শুনতে পেয়ে আমরা ঘরের বাইরে এসে দেখি আঙিনার মাঝখানে মামা দাঁড়িয়ে। আর তার কোলে লাল-সবুজ রং মাখানো সাদা রঙের এক রাজহাঁস।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!