কাঠবিড়া৯ কাঠবিড়া৯! সেই ছোট্টটি থেকে শুনে শুনে বড় হ’লাম ছোট্ট তোমার ইয়াব্বড় খাইয়ের কথা! কিন্তু কোনোদিন তোমার সাথে কথা আর হ’লো না। কোনো ইনডোর ডিম-লাইটে কি আউটডোর রোদের সাইটে, কোনো দুপুরেই দুনিয়ার হাঁড়ি উপুড় করা তোমার বুফে খাওয়াদাওয়ারও দেখা হ’লো না কোনো সিন কোনো দিন।
ছোট্টকালে কনুই-ঠ্যাসা টেবিলের ওপর দু’হাত-চাপা গালে-মাথায় মুখস্থের চাপ ছিলো বড়। প্রথম আট লাইন, শেষ আট লাইন, হঠাৎ করে কোনো কোনো পরীক্ষায় আবার দশ লাইন করেও! আর মাঝখান থেকেও ছোট প্রশ্ন তো আসতেই পারে তোমার হনুমানপ্রমাণ বড় মেনুর যেকোনো আইটেম নিয়ে! ওখানেই শেষ নয়। কবিতা আবৃত্তির নামে সেদিনগুলোয় রীতিমতো তোমাকে আমাদের অভিনয় করতে হতো সাষ্টাঙ্গে! সেটাও কোনো খাওয়ার কিংবা খেলার ছলে নয়। প্রতিযোগিতা মানে আর কী, বছরে নিয়ম করে দুয়েকবার, রীতিমতো উপজেলার খোলা প্রান্তরে এক বিশাল শিশুযুদ্ধ! স্কুলের সাথে স্কুলেদের, ছেলের সাথে মেয়েদের, মায়ের সাথে মায়েদের, যেন আজকের ভাগেযোগে ভোগযুগের হরলিক্স-কমপ্ল্যান যুদ্ধেরই কোনো সত্যযুগের এক প্রাচীন পুরাণরূপ! সেখানেও তাই মন না দেবার মতো কোনো ফাঁক-ফাঁকিই ছিলো না বাপু! সর্বখাদক তোমার সাথে সেই প’মুখর খুকিটার ঐ আউট-অব-দ্য-বক্স (নাকি উইদাউট-এনি-বক্স?!) ম্যারাথন পাইথন সংলাপ-প্রলাপ-অপলাপের আদ্যেআপান্ত জ্বলজ্যান্ত রূপায়ণের চড়াদামে, আমাদের খোকাখুকির কেজো দলের যারাই কিনা টিফিনবাটি-হারিকেন কিংবা জগ-মগের কোনোটাই পাবে না, তাদের সবার মায়েদের যে জাতিকুলমান সবই ডুববে গোল্লার ঘোর রসাতলে! মনে রাখবার জন্য তাই তোমার ঐ কিংবদন্তিসুলভ সুকীর্তির আঠারোআনাই সেকালে মেনে নিয়েছিলাম নির্দ্বিধায়, বিশ্বাসও করেছিলাম সকলই নিশ্চিন্তে। আর সেই নি:শর্ত নিষ্কলুষ বিশ্বাস সেদিন সেখানে কোনো বিস্ময়কেও এϾট্র নিতে দেয়নি নিজ দায়িত্বে।
এই বিস্ময়ের সাথে দেখাটা শেষে হ’লো বেশ বড়বেলাতেই এসে। কারণ, খাওয়াখাওয়ির এই কলিযুগের জলে-হাওয়ায়, বড় হয়ে যেতে যেতেও মাথা থেকে যায়নি তোমার বাহারি আহারের সেই অক্ষর স্মৃতি। যতোবার ভাবতে নিলাম তোমার সেই আচানক আহারতালিকার এলাহী আকার-প্রকার-বাহারের কথা, ততোবারই আমার সবেধন-কালো-মণি চোখ দু’টো ছানার দু’টো সাদা বড়া হয়ে ছুটে উঠে গ্যালো কপালে!
আচ্ছা, আগে একটু জিগ্যেস করি তো, তোমার নাম কাঠবিড়া৯ কেন গো?! কাঠের গাছের ওপর থাকো, তাই? নাকি, আসলেতে তুমি কাঠই খাও?! কী, বলবে না তো?
আমাদের স্কুলের মাঠের সামনেটায় একটা গাছ ছিলো কাঠবাদামের। ক্লাসের একআধটু ফাঁকেফোকরে, বহু সাধ্যিসাধনায় রাবণমুখো হেডস্যারের দশমাথার দশজোড়া চোখ এড়িয়ে, রাস্তার রিকশা-মানুষও বাঁচিয়ে, ইট-সিমেন্টের ঢিল ঢিলিয়ে সারাদিনের ওষ্ঠাগত কষ্টে, চারপাঁচজনে মিলে পাড়তে পারতাম ঐ বড়জোর চারপাঁচটাই মোটে কাঠবাদাম। ছোট্টবেলার নরম হাতে, মাইরি বলছি, কাঠের থেকেও ঢেরগুণ শক্ত ঠেকতো একেকটা কাঠবাদাম। ইট দিয়ে ছেঁচতে গেলে ইটের রং-কণা খসে যেতো সমানে, বরং হাতের আঙুলও ছেঁচে যেতো মাঝেমধ্যে, কিন্তু কাঠবাদাম কিছু টেরও পেতো না অনেকক্ষণ পর্যন্ত। সে যেন ছেঁচবার বস্তুই নয়! ওর শাঁস পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই নাভিশ্বাস আমাদের ছোট্ট মনে অখাদ্যের সেই ক্ষুধা উঠে যেতো হাতির ডনের তুঙ্গে বলতে ক্লাইম্যাক্সে! তারপর মুখে বা পেটে দেয়ার মতো যেটুকুও বা জুটতো তাতে পদার্থ, হাভাতে কিংবা হাবাদামে’র মতো সেটা গিলতে গিলতে, সারাজীবন পরের-দিনের-বাড়ির-কাজে-নাকাল-বেহাল অপদার্থ আমরা এই হিসেব বস্তুতই করতে শিখিনি তখন পর্যন্ত, যে কতোটা খাটলাম এই মরার এক ফল নামের কুফলের জন্য, আর পেটে আদৌ তার কতোটা চালান হ’লো! (তার ওপর, সেই বস্তুর স্বাদ এখন যদ্দূর মনে পড়ে, এরচে’ তো খোদ কাঠের কুচি মুখে পুরে চিবোলেও বরং কিছুমাত্র ভাল্লাগাটার চান্স ছিলো হয়তোবা, নয়তো কাঠঠোকরা বা তুমি কাঠবিড়া৯ সে বস্তু সাবাড় করো কোন আনন্দে!) তবু, সেই দিনগুলোতে এই সারের-স্বাদের হিসেব ছাড়াই, মাঝেমধ্যে বড়জোর হাতের মধ্যে ইটের ছ্যাঁচার অল্পবিস্তর সই-স্বাক্ষর সিল-ছাপ্পর নিয়ে, যার যার প্যাডেল মেরে আমরা ঠিকঠাক চালান হয়ে যেতাম যে যার মায়ের কোলে বাবার ঘরে, আবার পরের দিন সেই একই খনিতে পয়সা দিয়ে বেগার বেকার গতর খাটতে যাবো বলে।
সে যাক। যেজন্যে বলছিলাম তোমাকে এই কাঠ ভানতে বাদামের গীত ঐ কাঠবাদাম চেনার পর থেকে কাঠবিড়া৯ ভাবলেও আমার প্রথমটাতেই মনে হয় এমন কাঠ-কঠিন কোনো বিড়ালের শরীর হবে, যার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করলে সে বিড়াল তো রা পর্যন্ত করবে না, উল্টেআ ঐ ইটা-আধলাই বরং আর্তম্যাঁও করে উঠতে পারে! ধরেছুঁয়ে তোমাকে দেখে যে আমার সেই স্বত:কল্পনার সত্যাসত্য যাচাই করতাম কখনো, সে সুযোগ জীবনে কোনোদিন আসেনি, জানি আসবেও না। ছোট্টকালের সাদাকালো বর্ণপরিচয় বইয়ের বাইরে আর তো কোথাও কখনো কোনো স্ট্যাটিক শটে তোমার চেহারাও দেখলাম না একেবারেই! চর্মপ্রত্যক্ষে তোমাকে দেখবার আমার অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি বলতে তো কেবল চোখে-গোনা দুয়েকবারের; তা-ও আবার তার প্রতিবারই তোমার এক ভোঁ দৌড়ে ফ্রেম-ইন ফ্রেম-আউটের সুপার-ডিন্যামিক এক এক্সট্রিম ফাস্ট ফরোয়ার্ড শটে, যাতে কিনা ঘটনা শুরু হয়ে গেলে পরে চিলের মতো চোখ তাক করে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথাকে এক মুহূর্তে সেই হঠাত ফ্রেমের এপার-ওপার করেও ঠিকঠাক তোমাকে ধারণ করে উঠতে পারিনি! তার আগেই দৃষ্টিসীমা থেকে তুমি হাপিস! মাপছাড়া ঐটুকু সময়ের মধ্যে তোমার গায়ের রংটাই শুধু বুঝতে পেরেছি, গাছের গায়ের মতৈ, যে রংটাকে হঠাত করে ঐরকম ভোঁ-সচল সমূর্তি দেখলে রীতিমতো আত্নাখামচানো একটা ভয়ই ধরে যাবে বুকে। আমারও সে ভয় ধরেছে সেই প্রতিবারই। আর, দ্বিতীয় যে উপসর্গটা একটু ধরতে পেরেছিলাম সেই কয়েকটা ঝটিকা দর্শনে, সে তোমার পুরোটার অর্ধেকেরও বেশ বড় আকারের একটা ঝুলঝাড়ুমার্কা লেজ; যা ঐ ভয়টাকেই যে আরো দুয়েক লাঠি বেশি ভল করে তুলবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক আর সে-কারণে বলাও বাহুল্য। এই প্রসঙ্গে তবু আর এটুকুও বলে যাই, যে ততোদিনে কিন্তু ঐ সবেধন বর্ণপরিচয় বইটা থেকেও তুমি নিজে তো উধাও হয়েইছো, সাথে আমাদের বর্ণমালা থেকেও সমূলে উঠিয়ে নিয়ে গ্যাছো সেই ৯ বর্ণটাকেই!
সেও যাক। কথা হচ্ছিলো তোমার পেটুকপনা খানাদানা পিনাজিনার সেই পুরাণগল্প নিয়ে। খুকিটার কল্পনারও বলিহারি বাবা! ওর নিশ্চয়ই পড়া মুখস্থের মতো শাস্তি ছিলো না কোনো। তাই তো ঐ বয়সে ফাঁদতে পারলো এমন রাজা-উজির-মারা একটা বিনিসুতার বাকওয়াস! আর, ঘর থেকে দাদা-কাকু-মা-মাসি’র কেউ দেখলূ না যে ঐটুকুন ঐ খুকিটা তোমার সাথে অমন যা-নয়-তাই একটা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে বসলো! (তুমি তো বরং গলার কাঁটা বের করে জীবনোদ্ধার করা সেই জাঙ্গল-ওয়াচ হাওয়াইয়ের পামেলা এন্ডার-বকটাকে ছেড়ে দেয়া বাঘটার থেকেও মহঙ্কেÄর পরিচয় দিয়েছো, যে খুকিটার ওপর তুমি তোমার ঐ গেছো শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে হামলে পড়োনি! কবি তো সেই অদ্ভুতুড়ে মোলাকাত জুড়ে দিয়েই সিন গুটিয়েছিলো প্রায়! খুকিকে খাওয়া পাইয়ে দিতে যেখানে রাঙাদা’ কিংবা মা কেউই আসেনি ঘর থেকে বেরিয়ে, তো নিজেই খাওয়া হয়ে গিয়ে চ্যাঁচালেও তাকে বাঁচাতে কে বা তখন শুনে আসতে পারতো বাড়ির বাইরের ঐ দূর গাছালিতে?)
আর, তুমিও তো পারো! একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষের-বাচ্চার সাথে খাওয়া নিয়ে এইরকম একটা হার্ডকোর লড়াই করা, এমনকি ভরাহাটে অতো আরো মানুষের সামনে সেই যুদ্ধে অমন নিরঙ্কুশভাবে বিপুল ব্যবধানে জিতেও যাওয়া, চাট্টেখানি কথা নয় বাপু! প্রাণীকুলের আর কেউ কোনোদিন ওটা পেরেছে বলে কিন্তু শুনিনি আমি!
পেয়ারা-বাতাবিনেবু তো যথার্থই খাওয়ার ব্যাপার ছিলো। তাই বলে একেবারে অতো বড় লাউ পর্যন্ত যেতে হ’লো তোমার? সেখানেও তো থামলে না! শুধু মানুষে খায় যে গুড়মুড়ি-দুধভাত, সে পর্যন্তও হাত বাড়ালে তুমি! এমনকি নিজের সমান বিড়াল-বাচ্চা, কুকুর-ছানাকেও ছাড়লে না! এ কী রে বাবা! ছি ছিছিছি! ডাইনি আর হোঁত্কা পেটুক গালিতে তোমাকে বরং কমই মন্দ বলা হয়! আর, ছোঁচা যদি তুমি না হও, তো সেটা আর কে? বাঁদরীমুখী, হুত্মোচোখী বলার পরও তুমি তো এতটুকু টললে না তোমার সেই হোঁত্কামি থেকে! খুকি আড়ি দিলে না হয় তোমার কিচ্ছুটি এসে যায় না, তাই বলে মানুষের কিল কিংবা ঢিল দেয়ার হুমকিও তুমি পরোয়া করলে না?! পিলে-কুড়িকুষ্টির অভিশাপ তোমার গায়েও লাগলো না! আচ্ছা, কোনো একটা পোকা কি সেদিন ঢুকেছিলো তোমার পেটে? তাতেও তুমি তো বরং খুশিই হ’তে, তাই না? হোঁত্কা পেটুক কোথাকার!
ভয় না হয় না-ই ছিলো! মানুষের মতো ফ্রক-জামায় লজ্জা দূর করে জাতে ওঠার, এমনকি মানুষের ঘরে দিদি কিংবা বিয়ে-হওয়া বউদি হয়ে যাওয়ার প্রস্তাবেও তুমি এতটুকু পোষ মানলে না! খাওয়া ছাড়া আর কিছুই তোমার রোচেনি, না? পেটের থলিটা কতোটুকু ছিলো তোমার? ঐটুকু শরীরে পুরো পৃথিবীর অতো অতো খাওয়া, অতো অভিশাপের কতো তুমুল ঝোড়ো ধাওয়া, আর অতো লোভের হাওয়া হজম করে, সবকিছুকে কলা দেখিয়ে দিব্যি বেরিয়ে গ্যালে গোল্লাছুট আর দাড়িয়াবান্ধার সবগুলো ঘর কেটে কেটে কাটিয়ে ফাটিয়ে নীরবে মাঠ পার হয়ে!
যাক। বিস্ময়-অবিশ্বাসের বিচিত্র রঙে এতক্ষণের বিড়াল-কুকুর ঈর্ষাবর্ষণের সারমর্মটাও শেষে বলে যাই তবে। ঐটুকুন একটা কাঠবিড়া৯ হয়ে, আমার কল্পনারও ধরাছোঁয়ার বাইরে এতকিছু যে খেয়ে হজম করতে পেরেছো তুমি- এটাই সবচে’ বড় কথা, এ যুগের বড় সিদ্ধি। তোমাকে পাঁচবার স্যাল্যুট দিয়ে, আজ তাই আমিই মরি, আমিই কচু খাই।