ওয়াইস আল কারনি একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি।

আমীরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)দাঁড়িয়ে আছেন ইয়েমেন থেকে আগত দলটির সামনে। এই দলটি ইয়েমেনথেকে মদিনা হয়ে যাবে ইরাক ও আস-সাম এর দিকে। ওমর (রাঃ) তাদেরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ হে ইয়েমেন বাসি !! তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছ যার নাম ওয়াইস” প্রশ্নটি করে ওমর (রাঃ) অপেক্ষা করছেন। অনেকদিন থেকেই ইয়েমেনের এই ব্যক্তিটিকে খুজছেন তিনি(রাঃ) , প্রতিবারই ইয়েমেন থেকে কোন কাফেলা আসলে ওমর (রাঃ) তাদেরকে ওয়াইস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু এই ব্যক্তি সম্পর্কে কেউ কোন তথ্য দিতে পারে না। প্রতিবারই তাকে হতাশ হতে হয়। আজকে অবশ্য খালিফা ওমর (রাঃ) এর প্রশ্ন শুনে একজন দাড়ালেন। বয়সে বৃদ্ধ , বিশাল দাড়ি। তিনি ওমর (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ “আপনি কোন ওয়াইস এর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন সেটা তো জানি না তবে আমার ভাই এর ছেলের নাম ওয়াইস। কিন্তু তার ব্যপারে তো জিজ্ঞেস করার প্রশ্নই আসে না , সে তো এমন কেউ না।বরং সে এতই গরিব এবং এতই নতমস্তক যে আপনার পরিচিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে আমাদের উট গুলোর দেখা শোনা করে। এমনকি আমাদের মধ্যেও তার কোন বিশেষ স্থান নেই। বৃদ্ধের কাছে ওমর (রাঃ) ওয়াইস সম্পর্কে আরও জানতে চাইলেন। বৃদ্ধ বললঃ ইয়া আমিরুল মুমিনিন কেন আপনি তার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন? আল্লাহর কসম তার মত এত বোকা আর এত হতদরিদ্র আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই। বৃদ্ধের এই কথা শুনে ওমর (রাঃ) তার চোখের পানি আটকাতে পারলেন না।অঝোরে কেদে দিলেন। তার কান্না গোপন রইল না। তিনি কাদতে কাদতে বললেনঃ “ তুমি হত দরিদ্র – সে না ।কারন আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে রাবিইয়া আর মুজার গত্রের লোক সংখ্যার ন্যায় মানুষকে আল্লাহ ওয়াইস এর সুপারিশের উসিলায় মাফ করে দেবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এখন আমাকে বল কোথায় সে?” বৃদ্ধ বললঃ আরাফা’র চুড়ায় আছে সে। ওমর (রাঃ) আলী (রাঃ) কে নিয়ে দ্রুত আরাফায় গেলেন। ঐ তো একটা গাছের নিচে বসে ইবাদত করছেন ওয়াইস, তার চারিপাশের অনেক উঠ, ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) তার সামনে গেলেন , তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম। ওয়াইস তার ইবাদত শেষ করে তাদের দিকে ফিরে সালামের উত্তর দিলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কে তুমি? সে বললঃ আমি উট দেখাশোনা করি এবং একটি গোত্রের কাজের লোক। তারা বললঃ আমরা তোমাকে তোমার পশু পালনের ব্যপারে জিজ্ঞেস করিনি এমনকি তুমি কোন গোত্রের কাজের লোক কিনা সেটাও জানতে চাইনি আমরা জানতে চাচ্ছি তোমার নাম কি? সে বললঃ আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)তারা বললঃ এই আসমান এবং জমিনে যত আল্লাহর সৃষ্টি আছে সবই আল্লাহর বান্দা কিন্তু তোমার নাম কি যেটা দিয়ে তোমার মা তোমাকে সম্বধন করেন? সে বললঃ তোমরা আমার কাছে কি চাও? তারা বললঃ “ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একবার আমাদেরকে ওয়াইস আল কারানি নামে এক ব্যক্তির কথা বলেছিলেন। তার বর্ননা অনুযায়ী সেই ব্যক্তির থাকবে নিলাভ কালো চোখ। এবং তার বাম কাধের নিচে এক দিরহামের মত একটা সাদা দাগ থাকবে। তাই দয়া করে আমাদেরকে দেখতে দাও যে তোমার ঐ সাদা দাগটা আছে কিনা। তাহলেই আমরা বুঝবো আমরা যাকে খুজছি সে তুমি কি না? ওয়াইস তখন তার বাম কাধ উন্মুক্ত করে দেখালেন, দিরহামের ন্যায় সেই সাদা দাগটা স্পষ্ট ফুটে আছে তার বাম কাধের নিচে। ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) এর বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই সেই ওয়াইস আল কারনি যার কথা অনেক অনেক বছর আগে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বলেছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জীবিত। তিনি একটি হাদিসে কুদসি বর্ননা করেছিলেন (আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে হাসিদটি) যেখানে তিনি বলেন, যে আল্লাহ বলেনঃ“আল্লাহ সুবহানাওয়াতালা ভালো বাসেন তার সৃষ্টিকে যে আল্লাহ ভীরু, যার অন্তর পরিসুদ্ধ, তাদেরকে যারা নিজেদেরকে গোপন রাখে, এবং তাদেরকে যারা নিরপরাধ, যার মুখ মন্ডল ধুল মলিন, যার চুল এলোমেলো , যার পেট খালি, এবং সে যদি শাসকের সাথে দেখা করার অনুমতি চায় তাহলে তাকে তা দেয়া হয় না। এবং সে যদি একটু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়,এবং সে যদি দুনিয়ার কিছু ত্যাগ করে সেটা কখনওই তার অভাব বোধ করে না। এবং সে যদি কোথাও থেকে বের হয়ে যায়তাহলে তার বের হয়ে যাওয়াও কেউ লক্ষ করে না। সে যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে দেখতে কেউআসে না এবং সে যদি মারা যায় তাহলে তাকে কবর পর্যন্ত পৌছে দিতেও কেউ আসে না। এই হাদিস শুনে সাহাবারা তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরকম একজনব্যক্তিকে আমরা কিভাবে খুজে পাব? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেনঃ ওয়াইস আল কারনি হচ্ছে এমনই একজন ব্যক্তি।তখন সাহাবারা জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ কে এই ওয়াইস আল কারনি? নবীজি (সাঃ) বলেছিলেনঃ তার গাত্র বর্ন কালো,কাধ প্রশস্থ, উচ্চতা মাঝারি, তার দাড়ি তার বুক পর্যন্ত লম্বা, তার চোখ সবসময় অবনমিত থাকে সেজদার স্থানে। তার ডান হাত থাকে তার বাম হাতের ওপর। সে একান্তে এমনভাবেই কাদে যে তার ঠোট স্ফীত হয়ে যায়। সে একটা উলের পোশাক পরে এবং আসমানের সবাই তাকে চেনে। যদি সে আল্লাহর নামে কোন শপথ করে , সে তা পালন করে। তার ডান কাধের নিচে একটা সাদা দাগ রয়েছে। যখন আখেরাতের দিন আসবে এবং আল্লাহর বান্দাদের কে বলা হবে জান্নাতে প্রবেশ কর তখন ওয়াইসকে বলা হবে ‘দাঁড়াও এবং সুপারিশ কর’ আল্লাহ সুবহানাওয়াতালা তখন তার সুপারিশ অনুযায়ী মুজির এবং রাবিয়া (ওয়াইসের দুই গোত্রের নাম) গোত্রের লোক সংখ্যার সমান লোককে ক্ষমা করে দেবেন । সুতরাং হে ওমর এবং আলী তোমরা যদি কখনও তার দেখা পাও তাহলে তাকে বল তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওয়াইস সম্পর্কে আরো বলেছিলেন যে তার ঘরে বৃদ্ধা মা আছে। যার পুরো দেখা শোনা ওয়াইস করেন এবং বৃদ্ধা মা কে দেখা শোনার জন্যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে দেখা হওয়ার যে সুবর্ন সুযোগ ছিল তা গ্রহন করতে পারে নি। (ওয়াইস আল কারনি তার মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর সাহাবী হওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তাই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় ইসলাম কবুল করলেও তিনি তাবেই রয়ে যান। ) এই ঘটনার পর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আর তাদের মাঝে নেই। আবু বকর (রাঃ) ও দুনিয়া ছেরেছেন। এর মধ্যে শত খোজার পরও ওয়াইস আল কারনিকে খুজে পান নি তারা। আর আজকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বর্ননা কৃত সেই ওয়াইস আল কারনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) ওয়াইস আল কারনি কে জরিয়ে ধরে বললঃ “আমরা সাক্ষ দিচ্ছি যে তুমিই সেই ওয়াইস আল কারনি। সুতরাং আল্লাহর কাছে আমাদের জন্যে ক্ষমার সুপারিশ কর এবং আল্লাহ তোমাকেও ক্ষমা করুক।” উত্তরে ওয়াইস বললেনঃ কোন আদম সন্তান বা নিজেকে আমি ক্ষমা করানোর ক্ষমতা রাখি না , তবে এই জমিনে ইমানদার পুরুষ এবং ইয়ামানদার নারি রয়েছে, মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষ রয়েছে যাদের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তারা বললেনঃ সত্যিই তাই। তখন তিনি বললেনঃ আপনারা দুজন আমার সম্পর্কে জানেন এবং আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি কিন্তু আপনারা কারা? আলী (রাঃ) তখন ওমর (রাঃ) কে দেখিয়ে বললেনঃ ইনি হচ্ছেন আমীরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এবং আমি হচ্ছি আলী বিন আবু তালিব (রাঃ)ওয়াইস তাদের পরিচয় শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং তাদের উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম ইয়া আমি রুল মুমিনিন এবং আলী আপনাকেও। আল্লাহ আপনাদেরকে এই উম্মাহর জন্যে উত্তম প্রতিদান দান করুক।তারাও বললঃ আল্লাহ তোমাকেও উত্তম প্রতিদান দেক। এর পর ওয়াইস আল কারনি তাদের জন্যে দোয়া করলেন। ওমর (রাঃ) ওয়াইস আল কারনি কে বললেনঃ “ তুমি এখন ইহ জীবন এবং পরকালে আমার বন্ধু।” ওয়াইস আল কারনি জানেন ইহজীবনে ওমরের বন্ধু হওয়া মানে সুনাম এবং একটি সচ্ছল জীবন, তাই তিনি ওমর (রাঃ) এর বন্ধুত্ব তো গ্রহন করলেন কিন্তু খুব বিনয়ের সাথে তার সাথের সচ্ছলতা এবং সুনাম যা ওমর (রাঃ) এর মাধ্যমে সে পেতে পারত সেটাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। সে যেমন আছেন ঠিক তেমনই থাকার ইচ্ছে পোষণ করলেন। ওমর (রাঃ) বলেনঃ তুমি কোথায় যেতে চাও এখন? ওয়াইস আল কারনি বলেনঃ ইরাকের কুফায়।ওমর (রাঃ)ঃ ঠিক আছে আমি একটা চিঠি লেখে দেই কুফার গভর্নরকে যাতে সে তোমার ভালো দেখা শোনা করতে পারে। ওয়াইস বললেনঃ দয়া করে এই কাজ করবেন না।কারন আমি নিজেকে এইভাবে অচেনা রাখতেই পছন্দ করি। আমি আল্লাহর রাস্তায় এভাবেই অপরিচিত হয়েই থাকতে চাই।এরপর সে কুফায় চলে যায়। সেখানেই বসতি স্থাপন করে। এইভাবে কেটে যায় আরও কিছু বছর , একবার কুফা থেকে ওয়াইস আল কারনির গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মদিনায় আসেন। তার কাছে ওমর(রাঃ) ওয়াইস আল কারনি কেমন আছেন তা জানতে চান। খালিফা ওয়াইস আল কারনির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে দেখে সেই ব্যক্তি খুব অবাক হয় , সে খালিফা ওমর (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেঃ আমি তাকে দারিদ্রতায় নিমজ্জিত দেখে এসেছি্ ,তার ঘরে কোন আসবাব নেই, কেন আপনি এই ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেসকরছেন । ওমর (রাঃ) এই ব্যক্তিকে বললেনঃ যদি তুমি তার দেখা পাও , তাকে বলো তোমার জন্যে দোয়া করতে কারন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার কথা বলেছিলেন। সেই ব্যক্তি কুফায় ফিরে ওয়াইসের সাথে দেখা করে। তাকে বলে ঃ ওয়াইস আমার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।ওয়াইস বললেনঃ তুমি নিজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারন তুমি মাত্র সফর করে আসলে। আর মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। সে বললঃ না না। আমি চাই তুমি আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর। ওয়াইস আল কারনি একটু চুপ থাকলেন তারপর বললেনঃ “তোমার কি ওমরের সাথে দেখা হয়ে ছিল?” সে বললঃ হ্যা । ওয়াইস আল কারনি বুঝতে পারল কি হয়েছে ব্যপারটা । তিনি কিছু বললেন না।ঐ ব্যক্তির জন্যে দোয়া করলেন। এই ঘটনা পুরো কুফায় আগুনের মত ছরিয়ে পড়ল ,সবাই জেনে গেল ওয়াইস আল কারনি সম্পর্কে । নিজেদের আল্লাহর দরবারে মাফ করিয়ে নিতে মানুষ জন যখন ওয়াইসের খোজে তার বাড়ি গেল , দেখলো বাড়ি খালি পরে আছে ওয়াইস নেই। নাম , যশ , খ্যাতি সব কিছুকে দু হাত দিয়ে ছুরে ফেলে একমাত্র আল্লাহর জন্যে বেচেছেন তিনি। তার তাকওয়া , তার মর্যাদা সে কারো কাছে প্রকাশ করতে চান নি। একমাত্র আল্লাহর জন্যেই সব করেছেন এবং আল্লাহর কাছ থেকেই ইন শা আল্লাহ তিনি এর বিনিময় পাবেন , সত্যি ওয়াইস আল কারনি একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি। আল্লাহ আমাদের সকল কথা এবং কাজকে সঠিক এখলাসের চাদর দিয়ে ঢেকে দিক । আমিন। —[সুত্রঃ শেইখ আনওয়ার আল আওলাকি -এর লেকচার এবং অন্যান্য]

মুসলিম সেনাপতি আমর এর ন্যায়পরায়ণতা

বাঘের

বাঘের রাজত্ব !!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *