ইরানের খোরাসান প্রদেশের রাজধানী নিশাপুর। সেখানে ১০৪৪ সালে জন্ম হয় গিয়াস উদ্দিন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম। তিনি সমগ্র বিশ্বে ওমর খৈয়াম নামে পরিচিত। খৈয়াম তার বংশগত উপাধি। এই শব্দটির মানে হচ্ছে তাঁবু নির্মাতা বা তাঁবু ব্যবসায়ী। তার বংশের কেউ হয়তো এ কাজ করতেন। সেই থেকে খৈয়াম শব্দটি তাদের নামের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে। ওমর খৈয়াম বিরাট পন্ডিত লোক ছিলেন। তিনি জ্ঞানের যে তাঁবু তৈরী করেছেন তাতে আশ্রয় নিয়ে বহুলোক পান্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
ওমর খৈয়াম বিশ্বের অন্যতমসেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি এক সাথে অংক শাস্ত্রবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি ও আবেগে চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন। এসব কবিতা রুবাইয়াত নামে খ্যাত। ইউরোপের মানুষ তাকে কবি হিসেবে চেনে ও জানে। তার কবিতাগুলো তার ইন্তেকালের ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেন।
ফলে তিনি ইউরোপের লোক জনের কাছে কবি হিসেবে পরিচিত হন। ওমর খৈয়ামের মনের খেয়ালে রচিত কবিতা বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে তাকে অন্যতম সেরা কবির আসনে সমাসীন করেছে।
ছোট বেলা থেকেই ওমর খৈয়াম খুবই মেধাবী ও বুদ্ধিমান। পড়াশুনার প্রতি তার গভীর মনযোগ তার অসামান্য সাফল্যের অন্যতম প্রধান কার। তাঁর স্মরণ শক্তি ছিল খুবই প্রখর। যেকোন দর্শন গ্রন্থ বা বিজ্ঞানের কঠিন ও জটিল গ্রন্থগুলো কয়েকবার পড়লেই তার মুখস্থ হয়ে যেত।
তার পারিবারিনক আর্থিক অবস্থা ভল ছিল না। জ্ঞান চর্চার জন্য আমীর আবু তাহির তাকে কিছু আর্থিক সহায়তা কনে এবং রাজ্যের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল হয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য পেয়ে তিনি ভোগ বিলাসে তা’ ব্যবহার করেননি। তিনি রাষ্ট্রীয় সাহায্য জ্ঞান ও সাধনা গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল জ্যোতিবির্জ্ঞান, বীজগনিত ও জ্যামিতি। দর্শন শাস্ত্রে তিনি ছিলেন মস্তবড় পন্ডিত। এত বড় পন্ডিত হয়েও তার মনে কোন অহংকার ছিল না। বরং মনের মধ্যেছিল আল্লাহর ভালবাসা। তিনি প্রতিটি কাজে কর্মে আল্লাহর স্মরণ রাখতেন। একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য তার জীবনের মুল্যবান সময় অতিবাহিত করেন। জ্ঞান চর্চার প্রতি তিনি এতই মনোযোগী ছিলেন যে কোন বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করতেন।
ওমর খৈয়াম ছিলেন সে যুগের সেরা বিজ্ঞানী। সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের অনুরোধে তিনি রাজকীয় মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই এর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। এসময় সুলতান তাকে একটি সঠিক সৌরবর্ষপঞ্জি তৈরীর অনুরোধ জানান। ওমর খৈয়াম মাত্র ৭জন সহকর্মী বিজ্ঞানী নিয়ে অতি অল্পদিনে সাফল্যের সাথে ও নিখুঁতভাবে একটি সৌরপঞ্জি চালু করেন। তিনি সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের নাম অনুসারে এর নাম দেন আততারিখ আল জালালী অব্দ। এই জালালী বর্ষপঞ্জিতে ৩৭৭০ বছরে মাত্র ১দিনের ভ্রান্তি ছিল। আর গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জিতে ভ্রান্তি ছিল ৩৩৩০ বছরে মাত্র ১দিন। জালালী অব্দ হিজরী ৪৭১ সালের ১০ই রমজান থেকে শুরু হয়। ওমর খৈয়াম একটি নতুন গ্রহও আবিস্কার করেন।
বীজগনিতেই ওমর খৈয়ামের অবদান বেশী। তিনিই প্রথম বীজগণিতের সমীকরণ গুলো শ্রেণী বিন্যাসের চেষ্টা করেন। জ্যামিতির সমাধানে বীজগণিত এবং বীজগণিত সমাধানে জ্যামিতি পদ্ধতি তারই অভূতপূর্ব আবিষ্কার। ভগ্নাংশীয় সমীকরণের উল্লেখ ও সমাধান করে ওমর খৈয়াম সর্বপ্রথম বীজগণিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর বীজগণিত সম্পর্কিত গ্রন্থের নাম ‘ফি আল জাবের’ ওমর খৈয়াম সর্বপ্রথম বীজগণিতের ক্ষেত্রে বাইনোমিয়াল থিউরাম’ আবিষ্কার করেন। অথচ নিউটনকে এর আবিষ্কারক মনে করা হয়। তাঁর শত শত বছর আগে বিজ্ঞানী ওমর খৈয়ামই প্রথম তা আবিষ্কার করেন।
গণিতে ওমর খৈয়ামের অবদান কম নয়। গণিত শাস্ত্রে এনালিটিক জিওমেট্রিক কল্পনা তিনিই প্রথম করেন। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন গণিতবিদ একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞানেও তার অবদান রয়েছে। ওমর খৈয়ামের মেধা ও চিন্তা শক্তি অনেক গভীর ছিল। একদিন ইমাম গাজ্জালী (র) ওমর খৈয়ামকে প্রশ্ন করলেন, কোন গোলক যে অংশের সাহায্যে অক্ষের উপর ঘুরতে থঅকে, গোলকের সমস্ত অংশ এক প্রকার হওয়া সত্ত্বেও এ অংশটি অন্যান্য অংশ থেকে কিভাবে আলাদা রূপে জানা সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে ইমাম গাজ্জালী (র) সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, সত্যের সন্ধঅন পেয়ে মিথ্যার যবনিকা অপসারিত হল। এর আগে এ বিষয়ে আমার ধারণা সঠিক ছিল না।
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বহু গ্রন্থ রচনা করেন যান। তিন বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১। রুবাইয়াত (মরমী কবিতা) ২। মিজান-উল-হিকাম (রসায়ন বিজ্ঞন) ৩। নিজাম উল-মূলক (রাজনীতি) ৪। আল জাবরা ওয়াল মুকাবিলা (বীজগণিত), ৫। মুশকিলাত (গণিত শাস্ত্র) ৬। নাওয়াযিম আসবিনা (ঋতুপরিবর্তন বিষয়ক) ৭। আল কাউল ওয়াল তাকলিক (মানুষের নৈতিক দায়িত্ব) ৮। রিসালা মুকাবাহ ৯। তার ইলমে কুল্লিয়াত ১০। নওরোজ নামা।
ওমর খৈয়াম যেমন পন্ডিত ছিলেন- তেমনিই আল্লাওয়ালা লোক ছিলেন। তিনি নিজের প্রচার করতেন না। সাদাসিধেভাবে জীবন কাটাতেন। এর ফলে তার দেশের লোকেরাও তাকে চিনতে পারেনি। তিনি যে কত বড় জ্ঞানী লোক তা অনেকেই জানতনা
বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম ১২২৩ খৃস্টাব্দে ৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার ছাত্রদের শেষ বারের মত বিশেষ উপদেশে দানের জন্য আহবান জানান। এরপর তিনি ভালভাবে ওজু করেন এবং এশার নামায আদায় করেন। এসময় তিনি ছাত্রদের নসিহত করার কথা ভুলে যান। নামাজের শেষের সেজদায় গিয়ে তিনি কাঁদতে থাকেন। আর জোরে জোরে বলতে থাকেন, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি। তোমার দয়া ও করুনার গুণে আমাকে মাফ করে দাও। এরপর তিনি আর মাথা তোলেননি। সেজদা অবস্থাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন।