ওগো বিদেশিনী —- শাহনাজ মুন্নী

ইনগ্রিড মারলিন দিয়েত্রিচ-এর শ্বেত শুভ্র চেহারার ওপর ঢাকার শরৎকালের মৃদু হাওয়া যখন আলতো করে এক ঝলক স্বাগতমসূচক স্পর্শ দিল, তখন সে নীল আকাশে ভেসে চলা মেঘের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে জার্মান ভাষায় যা বলল, তার বাংলা অর্থ হল- চমৎকার, তোমাদের এ দেশটা খুবই সুন্দর।

কথাটা সে বলেছিল অনেকটা আপন মনেই, হয়তো নিজের সঙ্গেই নিজে, যদিও তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আবদুস শহীদের কানেও কথাটা পৌঁছেছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে আবদুস শহীদের এক চোখ প্যারাম্বুলেটরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত শিশুটির দিকে অন্য চোখ সঙ্গের লাগেজের দিকে, এমতাবস্থায় ইনগ্রিড উচ্চারিত শব্দবন্ধ তাকে খুব একটা আলোড়িত করে না, কেন না যে পূর্বে কখনওই বঙ্গদেশে আসেনি তার কাছে এই দেশ হঠাৎ করে সুন্দর লাগতেই পারে, কিন্তু আবদুস শহীদের মন এই দেশকে কখনও আলাদা করে সুন্দর ভাবেনি। ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আবদুস শহীদ চঞ্চল হয়ে খুঁজছিলেন তার ছোট ভাই আবদুর রহমানকে। সময়টা ১৯৫৭ সাল, আবদুস শহীদ ওয়েস্ট জার্মানি থেকে ইস্ট পাকিস্তানে এসেছেন, তার সঙ্গে বিদেশী বউ আর মাস দুয়েক বয়সী পুত্র সন্তান মার্ক, এই হঠাৎ আগমনের কারণ দেশ থেকে পাওয়া একটি টেলিগ্রাম, যেখানে লেখা আছে, মাদার ইজ সিরিয়াসলি ইল। টেলিগ্রাম পেয়ে শহীদের কেন যেন ধারণা হয়েছিল, তার বৃদ্ধা মা হয়তো আর বেঁচে নেই।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর আবদুর রহমানের ভাড়া করে আনা পুরনো ঝরঝরে মাইক্রোবাসে চেপে খুলনা যেতে যেতে যখন রহমানের কাছ থেকেই শহীদ জানতে পারল মা আসলে ছহি-সালামতে বেঁচে-বর্তেই আছেন এবং প্রেরিত টেলিগ্রামটি ছিল নেহায়েৎই শহীদকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশে পরিবারের একটি সুচিন্তিত গ্রাম্য কৌশল মাত্র, তখন প্রথমে দপ্ করে রেগে উঠলেও পরে ধীরে ধীরে তার রাগ ও উত্তেজনা থিতু হয়ে আসে, আর তখনই কেন যেন অবশ্যম্ভাবীভাবে তার মনে পড়ে হাজেরার কথা। ইনগ্রিড এবং মার্কসহ তার এই প্রত্যাগমনকে হাজেরা কিভাবে গ্রহণ করবে ভেবে শহীদ খানিকটা সংকুচিত ও বিব্রত বোধ করতে থাকে। সে দ্বিধান্বিত চোখে একবার ঘুমন্ত মার্ক আরেকবার মাইক্রোবাসের জানালায় চোখ রেখে উদাস হয়ে বসে থাকা ইনগ্রিডের দিকে তাকায়, ইনগ্রিডের চোখ বাইরের দৃশ্যে, সে মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে বলছে, শ্যোয়্নে, জে শ্যোয়েন
শহীদ ইনগ্রিডের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখতে পায় রাস্তার পাশের একটা পানা-পুকুরে একদঙ্গল বালকের সোৎসাহে বুক সমান পানিতে হুল্লোড় তুলে দাপাদাপি করা, যেমনটি থাকে মহাসড়কের পাশে, তেমন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, এলোমেলো গাছপালা। বনেদী শহর বনে জন্ম নেয়া ইনগ্রিডের নীল চোখ এ সব কিছুতেই তাহলে এত সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছে! আবদুস শহীদ খানিকটা বিস্মিত হয়, আবার ভালোও লাগে তার, ইনগ্রিডকে সে জার্মান ভাষায় বলে,
এগুলো আমাদের গ্রাম এলাকা, এমন একটা গ্রামেই আমার জন্ম
ইনগ্রিড আবার প্রশংসাসূচক কণ্ঠে বলে, ভুনদাবা! আর তখনই ঘুম ভেঙে চিৎকার করে ওঠে মার্ক। তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোলে নিয়ে তার কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইনগ্রিড। মাইক্রোবাস যমুনা নদীর ওপর ফেরিতে উঠলে পেছনের সিটে বসে থাকা আবদুর রহমান নিুকণ্ঠে প্রায় ফিস ফিস করে আবদুস শহীদকে জিজ্ঞেস করে,
বাইজান কি দ্বিতীয় পরিবার গ্রহণ কইচ্ছেননি?
আবদুস শহীদ তাৎক্ষণিকভাবে ছোট ভাইয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলে, আবদুর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেই আবার বলে…।
শহীদ একটু রুষ্ট কণ্ঠে ধমকে ওঠে, তোরে এই সব নিয়া মাথা ঘামাইতে কে বলছে? নিজের চরকায় তেল দে। বউরে এখনও আগের মতো পিটাস নাকি?
রহমান তাড়াতাড়ি জিহ্বা কাটে, কি যে কন বাইজান, আই কিল্লাই হেতিরে ফিডাইতাম? আর মারি ন, তওবা কইচ্ছি, আর মারতাম ন আফনে ভাবির কাছে তালাশ করি দেইখ্যেন …
রহমান হঠাৎ ভাবি শব্দটি উল্লেখ করায় আবার হাজেরার কথা মনে পড়ে আবদুস শহীদের। প্রথম যখন হাজেরাকে দেখেছিল সে, দশ বছর আগেই হবে হয়তো, কুপির স্বল্প আলোতে, বিয়ের রাতে, লাল কেরোলিনের শাড়িতে পেঁচানো তেরো বছর বয়সী কিশোরী হাজেরা খুব কাঁদছিল, চোখের কালো কাজল আর কপালের লাল কুমকুমের টিপ চোখের পানির সঙ্গে মিশে লেপ্টে গিয়েছিল সারা মুখে, কেরোলিন শাড়ির খসখসে শব্দের মধ্যে হাজেরা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল,
আই দাদির লগে ঘুমামু .. উ ..উ ..উ …আন্নে যান, আই এনো থাকতাম ন ..অ ..অ …
ওর সেই প্রবল কান্নার সামনে সেই রাতে নিজেকে ভীষণ অসহায় আর অপরাধি মনে হচ্ছিল শহীদের। সে তো আর স্বেচ্ছায় এই বিয়ে করেনি। ঘরে সহায়-সম্বলহীন বিধবা মা, ছোট ছোট ভাইবোন, অভাবের গহ্বরে ডুবতে ডুবতেও শহীদের পড়াশোনা করার অদম্য নেশা, ভালো ছাত্র হিসেবে গ্রামজুড়ে তার খ্যাতি… হাজেরার বাবা এই সুযোগটাকেই ভালো ব্যবসায়ীর মতো কাজে লাগিয়েছিলেন, শহীদের পড়াশোনা চালানোর খরচ জোগান দেয়াটা ছিল তার বিনিয়োগ, বিনিময়ে শহীদকে তার মাতৃহীন একমাত্র কন্যার জামাতা হিসেবে পেতে চেয়েছেন তিনি, শহীদের দুঃখি-অভাবি মায়ের আপত্তি করার কারণ ছিল না।
শহীদের বিএ পরীক্ষার ফল বেরুনোর আগেই হঠাৎ মারা গেলেন হাজেরার বাবা। পুরো পরিবারের দায়িত্ব আবার শহীদের কাঁধে। ভাগ্য ভালো যে তখনই খুলনা শিপইয়ার্ডে চাকরিটা হয়ে গেল শহীদের। নোয়াখালীর জয়নাগপুরে স্বামীর ভিটা ছেড়ে খুলনা শহরে আসতে রাজি হলেন না শহীদের মা। শেষমেষ স্ত্রী হাজেরা, ছোটভাই আবদুর রহমান আর ছোট এক বোন জয়নবকে নিয়ে খুলনায় আসে শহীদ। জীবনের আরেক পর্ব শুরু হয় তার।
তখন মাত্র শিপইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে, মাটি কাটার জন্য লোক দরকার, নোয়াখালী থেকে শত শত শ্রমিক এসে যোগ দিচ্ছেন মাটি কাটতে। শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে শহীদের চাকরি হয়েছে শিপইয়ার্ডের কেন্দ্রীয় অফিসে। পশ্চিম জার্মানি থেকে যখন-তখন কর্মকর্তা আর ইঞ্জিনিয়ররা আসছিলেন, তাদের নিয়ে ফিল্ডে যাওয়া, দেখভাল করা, কাগজপত্র ঠিক রাখা, শতেক দায়িত্ব তার কাঁধে… আর হাজেরারও ততদিনে বয়স বেড়েছিল, কিশোরী থেকে যুবতীতে রূপান্তরিত হয়ে বেশ যত্ন করে ঘর-সংসার সাজিয়ে বসেছিল সে, খুব ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল মা হওয়ার জন্য। একটা ছোট্ট মিষ্টি শিশু আসবে ঘরে, ঘর ভরে উঠবে আলো-হাসি-আনন্দ-গানে, এমন স্বপ্নে বিভোর ছিল হাজেরা। কিন্তু বিয়ের সাত বছরেও শিশু আসার কোনো লক্ষণ না দেখা যাওয়ায় খানিকটা যেন হতাশাতেই ভুগছিল সে।
আঁরে বালা একখান ডাক্তরের কাছে লইয়া যান চাই শহীদের কাছে এমন অনুরোধ প্রায়ই করতো সে।
আবদুস শহীদ যখন সরকারি টাকায় পশ্চিম জার্মানিতে এক বছরের ট্রেনিং-এ যাওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশিতে প্রায় আত্মহারা তখন শুধু হাজেরার হাসি-খুশি চেহারাটাই কেমন মলিন হয়ে গিয়েছিল।
বৈদেশ ন গেলে কি অয়? আঁর বালা লাগে না একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাজেরা বলেছিল, একখান পোলা-পানও যদি থাইকতো, আঁর বুকটা এমন খালি খালি লাইগতো না, আফনে চলি যাইবেন… আঁর দুক্ষের দুক্ষী ইআনো আঁই কই পাইয়ুম? …
চিন্তা করো না।
এমন সান্ত্বনার কথা বলে প্রবাসের পথ ধরেছিল শহীদ। নোয়াখালীর অজ পাড়াগাঁর ছেলের জীবনে তারপর কত ইতিহাস। কোনো দিকে না তাকিয়ে চোখ-মুখ গুজে ডকইয়ার্ড পরিচালনার জন্য জ্ঞান অর্জনের প্রাণান্ত চেষ্টা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মা-বাবা-ভাই হারানো দুঃখী মেয়ে ইনগ্রিডের সঙ্গে আকস্মিকভাবে পরিচয় হওয়া, ট্রেনিং শেষে জার্মানিতেই ভালো চাকরির অফার, হঠাৎ করে ইনগ্রিডের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়া, মার্কের জন্ম, আবদুস শহীদের সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়।
মার্কের কান্না কিছুতেই থামছে না, হয়তো নতুন জায়গার আবহাওয়া সহ্য হচ্ছে না, অথবা খিদে পেয়েছে ছেলেটার। ইনগ্রিড ওকে থামানোর নানারকম চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ছেলের মুখে ফিডার ঢুকিয়ে দিলে ও কিছুটা শান্ত হয়।
বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালন খুবই ঝামেলার কাজ ইনগ্রিড মৃদু হেসে জার্মান ভাষায় মন্তব্য করে।
২.
বাড়ি পৌঁছানোর পর ইনগ্রিড ও মার্ককে দেখে হাজেরার মধ্যে সহিংস বা অহিংস কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা যায় না। সে শুধু একবার নীরবে এসে আবদুস শহীদের পা ছুঁয়ে সালাম করে, তারপর পরনারীর মতো ঘোমটায় মুখ ঢেকে দূরে সরে যায়। নিঃশব্দে চলাফেরা করে, ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম করে আর আবদুস শহীদের চোখের আড়ালে ননদ-দেবরদের কাছে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তর বাই যে বৈদেশী বউ আইনবো, আঁই জানতাম, আঁর মনে আগেই ডাক দিছিল … আঁই বুজি, আঁরে হেতাইনের পছন্দ না, এই লই আঁর কুনু দুক্ষু নাই … দুক্ষু করি কি কইত্তাম, আঁর কফালে আছে …
আবদুর রহমান যে এখন ডক-ইয়ার্ডে শ্রমিক সুপার-ভাইজারের কাজ করে, সে, সম্ভবত ভাইয়ের দোষ কাটানোর জন্যই বলে, ভাইজানের আর দুষ কি? যুদ্ধ করি জার্মানির বেকগুন বেডা মরি গেছেগই, হেতানরার মাইয়ারা বিয়া করনের লাগি পুরুষ পায় না, আঁর ভাইছাবরে দেখ্্ছে সহজ-সরল মানুষ, হেতারে খপ্্পাত করি আটকাই হালাইছে। কথা বুঝছেননি ভাবি?
হাজেরা কোনো উত্তর না দিয়ে উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে তরকারি কোটে। আহ্্হারে, বাবা কতো হাউশ করে শিক্ষিত জামাই দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, আজ বাবা নেই, বেঁচে থাকলে তিনি দেখতে পেতেন, তার হাউশের জামাই ঘরে কেমন বিদেশী সতীন এনে তুলেছে- মৃত বাবার কথা মনে করেই বোধ হয় হাজেরার চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ননদ হাজেরার পিঠে হাত বুলায়, নরম স্বরে বলে, কান্দিয়েন না ভাবি, কান্দিয়েন না, কান্দি আর কি লাভ অইবো?
কেঁদে যে লাভ হবে না, তা তো হাজেরা ঠিকই বোঝে। কিন্তু এই পোড়া চোখের পানি সে আটকাবে কি করে? বিলাতি সতীনের কোল আলো করে এসেছে একটা সুন্দর বাচ্চাও। তার কপাল এমনই ফাটা যে, স্বামী-সন্তান কিছুই জুটলো না। জীবনের এই সব অপ্রাপ্তির কথা মনে করে বুক দুমড়ে-মুচড়ে আরও কান্না বেরিয়ে আসে তার। হাজেরা হাঁটুতে মুখ গুজে ফুলে ফুলে কাঁদে। হাজেরার কান্নার সঙ্গে তাল দিয়েই নাকি পাশের ঘরের ভেতর থেকে সতীনের ছেলেটাও চিৎকার করে কান্না শুরু করে।
হাজেরা এবার নিজের চোখ মুছে, কৌতূহলী দৃষ্টিতে ইনগ্রিডের ঘরের দরজায় উঁকি দেয়।
পোলাগ্যা কিল্লাই কান্দে?
ঘরে আবদুস শহীদ নেই, সে ভোরবেলাতেই নোয়াখালীর জয়নাগপুরে গেছে, মায়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সেরে ওখানকার জমিজমার বিলিব্যবস্থা করে রাতের মধ্যেই ফিরে আসবে বলে। ইনগ্রিড একা একা তার ঘরে ছেলেকে সামলাতে গিয়ে বিপর্যস্ত প্রায়। আনাড়ি ভঙ্গীতে এক হাতে ছেলেটাকে উঁচু করে ধরে ঘরের ভেতর থেকে কলের পারে নিয়ে আসে ইনগ্রিড, তারপর সেই অবস্থাতেই এক হাতে ছেলেকে ঝুলিয়ে রেখে অন্য হাতে পানির বদনা নিয়ে তাকে পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে ইনগ্রিডের প্রায় গলদঘর্ম অবস্থা, ওদিকে ছেলেটাও সমানে চিৎকার করেই যাচ্ছে। হায় হায়, বেডি করে কি? এক হাতে এই কচি ছেলেকে ডানা ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে? কচি ছেলেটা তো হাতের ব্যথাতেই কাঁদছে, আর বেআক্কেল মা সেটা বুঝতেই পারছে না? হাজেরা আর নিজেকে সামলাতে পারে না,
আরে, কইচ্ছো কি? পোলাগ্যাইর হাতটা তো ভাঙি যাইবো। বলেই সে ছুটে গিয়ে একরকম ছোঁ মেরে ইনগ্রিডের কাছ থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নেয়। তারপর ওকে সুন্দর করে ধুয়ে-মুছে ভালো করে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে মার্কের কান্নাও থেমে যায়। সে গুটিশুটি মেরে হয়তো হাজেরার বুকের উষ্ণতা উপভোগ করে, আর কিছুক্ষণ পরপর চোখ মিটিমিটি করে সামান্য তাকায়, হাজেরা খুব কাছ থেকে বিস্মিত হয়ে দেখে সাদা চামড়ার ছেলেটির চোখের মণি নীল রঙের, বিদেশী বাচ্চাটির প্রতি অভূতপূর্ব এক মমতা হঠাৎ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, যেন সহস বছর ধরে এই শিশু তার বুকজুড়ে আছে, শিশুটিও খানিকক্ষণের মধ্যেই যেন খুব নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় তার সৎ মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। ইনগ্রিড প্রথমে হাজেরার আচরণে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল, ওর কথা তো বুঝতে পারছিলই না, ছেলেকে হঠাৎ কেন সে কেড়ে নিচ্ছে তাও ভেবে পাচ্ছিল না ইনগ্রিড। তবে একটু পরই হাজেরা যেভাবে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিল আর তার দুরন্ত ছেলেটিও যেভাবে শান্ত হয়ে পড়ল, তা দেখে খুশি হয়ে যায় ইনগ্রিড, সে হাত ইশারায় হাজেরাকে জানায়, শিশুটি তার কাছেই থাকুক, ইনগ্রিড এখন একটু ঘুমুতে যাবে। কাল প্রায় সারা রাত ছেলের সঙ্গে জেগে থাকতে হয়েছে তাকে।
মার্ককে বুকে জড়িয়ে ধরে হাজেরা তার ভাষাতেই জানায়, ইনগ্রিড নিশ্চিন্তে ঘুমুতে যেতে পারে, ছেলে তার কাছে যতেœই থাকবে। ইনগ্রিড ঘুমুতে যাওয়ার পর হাজেরা আবার আপন মনেই বলে, হেতিরা বিলাতি মাইয়া, পোলাপাইন কেমনে পালন লাগে হেতিরা জানে নি?
সত্যি সত্যিই পরের কয়েকটা দিন সন্তান লালন-পালনের জন্য ইনগ্রিডকে আর চিন্তা করতে হয় না। হাজেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মার্কের সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। গোসল, খাওয়া-দাওয়া, পায়খানা-পেশাব পরিষ্কার করা কোনো কিছু নিয়েই ইনগ্রিডের উদ্বিগ্ন হতে হয় না। মার্কও যেন হাজেরার যত্নআত্তি পেয়ে দারুণ খুশি, ফলে ইনগ্রিডও খানিকটা ভারমুক্ত, সে নিশ্চিন্তে বঙ্গদেশের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করে, এমনকি একবার মার্ককে হাজেরার কাছে রেখে সে দুদিনের জন্য আবদুস শহীদের সঙ্গে নোয়াখালীতে তাদের গ্রামের বাড়িও ঘুরে আসে। শহীদ ঠাট্টা করে বলে, মার্কের আসল মা কোনজন, আমি তো বুঝতে পারি না…
হাজেরা এবং ইনগ্রিড দুইজনই হাসে। কিছু না বুঝে মার্কও ফোকলা হাসি হাসে। একটা ছোট্ট শিশু পরিবেশটাকে কেমন স্বাভাবিক করে দিয়েছে ভেবে শহীদ মনে মনে বিস্মিত হয়।
হাজেরা মার্কের গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে, মাক টাক বুঝি ন, আই এর নাম রাইখছি, আবদুল কাদির,… ইয়া আঁর কাদির… আঁর কইলজার টুকরা, আঁর দুই চউক্ষের মণি, আঁর আন্ধাইর ঘরের মানিক …
এই আঁধার মানিকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে হাজেরা। শিশুটি যেন তার সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে, সব শূন্যতাকে ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্বভাবতই হাজেরার এই সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কারণ দেখতে দেখতে ইনগ্রিড আর আবদুস শহীদের জার্মানিতে ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে। প্রথম কয়েক দিন হাজেরা নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করে, থাকি গেলে কি অয়? এই দ্যাশে কি মানুষ থায়ে নানি? থাকি যান …বিদেশে কি আর মধু আছেনি কোনো?
কিন্তু হাজেরার এ সব কথায় আবদুস শহীদের কোনো বিকার হয় না, তাদের থেকে যাওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যায় না। ইনগ্রিড তার সদ্য শেখা ভাঙা ভাঙা বাংলা আর ইশারা ভাষা প্রয়োগ করে জানায়, জার্মানিতে তাকে এবং আবদুস শহীদকে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। বললেই তো আর থেকে যাওয়া যাবে না। তবে তারা আবার আসবে। এই দেশ খুব সুন্দর, এই সুন্দর দেশকে সে বেশিদিন ভুলে থাকতে পারবে না।
হাজেরা এবার গোঁ ধরে বসে, আবদুস শহীদ আর ইনগ্রিডের যদি যেতেই হয়, তো তারা যাক্, তাদের কেউ বাধা দেবে না, শুধু আবদুল কাদিরকে, তার বুকের মানিককে ওরা এই দেশে রেখে যাক্, হাজেরা তাকে বুকের মধ্যে রেখে বড় করে তুলবে।
আকস্মিক হাজেরার এই উদ্ভট প্রস্তাবে আবদুস শহীদ এবং ইনগ্রিড দুইজনই হতবাক। হাজেরার কি মাথা ঠিক আছে? সে কি যা বলেছে তা জেনে-বুঝে-ভেবে বলেছে? কোনো মা কি তার বাচ্চাকে অন্য দেশে, অন্য কারো কাছে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে? আবদুস শহীদ নরম সুরে হাজেরাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মার্ককে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে হাজেরা তার অবস্থানে অনড় এবং স্থির। এই ছেলেকে সে দেবে না। একে তার কাছে রেখে যেতে হবে। এটি তারই ছেলে। হয়তো সে একে পেটে ধরেনি, কিন্তু বুকে তো ধরেছে। ইনগ্রিড যদি পারে নিক তো দেখি তার বুক থেকে একে ছিনিয়ে… হাজেরা যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়… তার চোখে তখন উন্মাদের দৃষ্টি, চুল এলোমেলো, কাপড়-চোপড় অবিন্যস্ত, যেন সে এক আহত বাঘিনী, যেন সে শাবক হারানো সিংহী মাতা।
এই পুলারে ছাড়ি হেতি বাঁইচতো ন… ভাইজান… হেতি মরি যাইবো…
হাজেরার অবস্থাদৃষ্টে আবদুর রহমান মন্তব্য করে। আবদুস শহীদ রেগে যায়,
তোরা একবার ইনগ্রিডের কথা ভাবছিস না, নিজের ছেলেকে এখানে রেখে গিয়ে ও কিভাবে বাঁচবে, বলতো দেখি? এটা কখনও হয়? মা কখনও তার সন্তান ফেলে যেতে পারে?
হাজেরা এবার কান্নাজড়ানো কণ্ঠে হাতজোড় করে,
আন্নেরা আঁরে পোলাগ্যা ভিক্ষা দেন, আঁই আন্নের পাও ধরি, আঁর বুকখান খালি করি দিয়েন না, আই ভিক্ষা চাই, কাদিররে আঁই মাথাত করি রাইখমু, কাদিররে ছাড়ি আঁই বাঁচতুইন্ন …
ইনগ্রিড এতক্ষণ চুপ করে এ সব কান্না, চিৎকার, পারস্পরিক কথা-বার্তা শুনছিল। তার চেহারা ছিল প্রস্তরমূর্তির মতো ভাবলেশহীন। হাজেরার ভাষা সে বোঝেনি, তবে তার অসম্ভব চাওয়ার কথা, তার আকুতির ভাষা সে বুঝেছে। অনেকক্ষণ পর ইনগ্রিড মুখ খোলে। হাজেরার কান্না থেমে যায়, শহীদ রাগ সম্বরণ করে। ইনগ্রিড ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
লাস সি মাচেন, ওয়াজ সি উইল, ও যা চায় তাই হোক। আমি মার্ককে ওর কাছেই রেখে যাচ্ছি।
ইনগ্রিডের ঘোলাটে নীল চোখ থেকে রঙহীন দুফোঁটা অশ্রু তার গালের ওপর গড়িয়ে পড়ে শুকিয়ে যায়।
২.
ইনগ্রিডের মার্ক বা হাজেরার আবদুল কাদির বড় হয়ে উঠছিল পুঁই মাচায় যেভাবে লকলক করে বেড়ে উঠে লালচে সবুজ ঝকঝকে পুঁই ডগা তেমনই উজ্জ্বল নমনীয় প্রাণবন্ত এক কোমল বিরুৎ যেন। সমবয়সী আর দশটা ছেলের মধ্যে দাঁড়ালেও তার স্বাতন্ত্র্য সহজেই আলাদাভাবে নজর কাড়ে। ধবধবে সাদা গায়ের রং, জ্বলজ্বলে নীল চোখ, একমাথা লালচে কালো নরম রেশমী চুল, পাতলা গোলাপি ঠোঁটে হৃদয়কাড়া হাসি… ছেলের দিকে তাকিয়ে হাজেরার শূন্য বুকটা ভরে যায়। তার মনে হয় আবদুস শহীদের ঔরসে সেই জন্ম দিয়েছে আবদুল কাদিরকে। শহীদের সঙ্গে বিবাহপরবর্তী উথালপাতাল রাতগুলোর কথা মনে পড়ে তার, একটি সন্তানের জন্য কী উদগ্রীব অপেক্ষা! হায়, সেই কষ্টের কঠিন দিনগুলো তবে শেষ হয়েছে। অবশেষে সে পেয়েছে, হ্যাঁ, সে পেয়েছেই তো, সন্তান পেয়েছে, স্বামীকে হারিয়ে সে স্বামীর সন্তানকে পেয়েছে। নাকের বদল নরুণ পেলাম, তাক ডুমা ডুম ডুম। এখন এই ছেলে তার।
ও বাপ, এমি আয়, এমি আয়, আম্মা কই ডাক দে ছাই বাজান, ডাক আম্মা
আবদুল কাদির কচি কণ্ঠে ডাক দেয়, আম্মা, আম্মা
হাজেরার চোখে পানি এসে যায়। সে আবদুল কাদিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে,
ও বাপ, তুই আঁরে ছাড়ি কুনুক্ষাণে যাবি না
দুই বছরের শিশু আবদুল কাদির হাজেরার নরম আলিঙ্গনের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আবার বলে, আম্মা, আম্মা
আঁর বাজান, আঁর কলিজার টুকরা, আঁর চউক্ষের মণি, আঁর আন্ধাইর ঘরের মানিক, আঁর বুকের ধন …
আরও কত কিছু আবোল-তাবোল যে বলে হাজেরা, বলে বলে তার আর আঁশ মেটে না। কাদিরের নরম তুলতুলে গোলাপি গালে আর ঠোঁটে শত সহস বার চুমু দিয়েও যেন নিজের অপত্য স্নেহ আর অসীম ভালোবাসার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারে না হাজেরা। তার এই আকুলতা দেখে হাসে বাড়ির লোকজন। তবে প্রকাশ্যে কেউই কিছু বলে না। থাক্, আল্লাদ করুক, পোড়া-কপাইল্যা মাইয়া মানুষ, বাইচ্চাটারে লই যদি খুশি থাকে তো থাকুক।
আবদুর রহমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে হাজেরার কাণ্ড-কারখানা দেখে। তারপর বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দেয়, সন্ধ্যায় ভাইজান ট্রাঙ্কল কইরবো, কাদিররে লই মহাজনের গদিত্্ আই পড়িয়েন ভাবি।
মহাজন তার গদির ভেতরের দিকে একটা রুমে বসার জায়গা করে দেয় হাজেরাকে। টেলিফোনের রিং বাজে নির্ধারিত সময়েই। হাজেরার বুক দুরূ দুরূ কাঁপে। সে যেন কল্পনার চোখে দেখতে পায় টেলিফোনের অপর প্রান্তে আবদুস শহীদ আর সাদা চামড়ার ইনগিড বসে আছে। ইনগ্রিড কি তার ফেলে যাওয়া সন্তানের জন্য কাঁদছে? হাজেরা তার বুকে লেপ্টে থাকা আবদুল কাদিরকে আরও জোরে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে।
প্রথমে কিছুক্ষণ শহীদ ছোট ভাই আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে, মায়ের শরীর স্বাস্থ্যের খবর নেয়। জমি-সম্পদের বিলি-ব্যবস্থা সম্মন্ধে জানতে চায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, ছেলের কথা। আবদুর রহমান হে হে করে হাসে, বলে, আন্নে কুনু চিন্তা করিয়েন না ভাইজান, হেতে বালা আছে, ভাবি হেতেরে মাথাত তন নামায় না, পিঁপড়া ধইরবো কইরা… হ, হ, ভাবি ইয়ানোই আছে। কথা কন চাই ভাবির লগে …
আবদুর রহমান ফোনের রিসিভারটা হাজেরার দিকে এগিয়ে দেয়। হাজেরার বুকের ধুক্ধুকানি আরও বেড়ে যায়। সে ডান হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা কানে লাগায়। কানের মধ্যে প্রথমে কেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায়। হাজেরা আবদুর রহমানের মতো করে অনভ্যন্ত ভঙ্গিতে বলে, হ্যালো
ভালা আছোনি হাজেরা?
জ্বি, আন্নেরা আছেননি ভালা?
হ্যাঁ, ভালাই। নাও, ইনগ্রিডের সঙ্গে একটু কথা বলো, মার্কের খবর জানার জন্য ও অস্থির হয়ে আছে।
একটু পরই ফোনের ওপাশ থেকে ইনগ্রিডের গলা। ভাঙা ভাঙা বাংলায় সে প্রশ্ন করে,
আমার ছেলে কেমন আছে বুবু?
ইনগ্রিডের মুখে আমার ছেলে শব্দটা ধ্বক করে বুকে এসে লাগে হাজেরার। তবে তাৎক্ষণিক সেটাকে আমলে না নিয়ে হাজেরা ইনগ্রিডকে আশ্বস্ত করে, হেতে ভালোই আছে। সুছতো আছে, চিন্তা করিয়েন না …
ওপাশ থেকে ইনগ্রিড একের পর এক জানতে চায়, ও কি হাঁটতে শিখেছে? ও কি কথা বলতে শিখেছে? ও কি ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করে? ও কখন ঘুমায়? কি খায়?
হাজেরা হু, হ্যাঁ করে উত্তর দেয়। ইনগ্রিড আরও জানায়, সে শিগগিরিই তার মার্ককে দেখতে দেশে আসছে। আর হাজেরা যদি অনুমতি দেয় তাহলে মার্ককে এবার সে সঙ্গে করে জার্মানিতে নিয়ে যাবে। কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়ে দেবে। আরও কি কি যেন বলে ইনগ্রিড। হাজেরা তার অর্ধেক শোনে অর্ধেক শোনে না, কিছু বোঝে কিছু বোঝে না। সে দ্রুত রিসিভার আবদুর রহমানের হাতে দিয়ে দেয়।
হাজেরার এখন মাথা ঘুরছে, টেলিফোনের পেঁচানো তার বেয়ে এ সব কি কথা কানে এসে বাজলো তার? ইনগ্রিড এসে তার বুকের ধন, চোখের মণিকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে? তাহলে কি নিয়ে আর বেঁচে থাকবে হাজেরা? কাদিরকে ছাড়া তার জীবন তো অর্থহীন। চোখের পানি মুছতে মুছতে মহাজনের গদি থেকে বাড়ি ফেরে হাজেরা। আবদুর রহমান স্বান্তনা দেয়,
কি আর কইরবেন ভাবি, মন শক্ত করেন, জোর করি কি হেতেরে ধরি রাইখতে পারবেন? যার হোলা, হে তো আইজ নয় কাইল লই যাইবই …
এ সব কথায় হাজেরার বুক চাপা কান্না আরও বেড়ে যায়।
আবদুস শহীদ বেশ কয়েকবার ট্রাংক কল করে, চিঠি লিখে জানিয়ে দিল তাদের দেশে আসার সব প্রস্তুতিই প্রায় সম্পন্ন। ইনগ্রিড তার ছেলের জন্য আকুল হয়ে গেছে, আবদুর রহমান যেন হাজেরাকে বুঝিয়ে বলে, যেন হাজেরা এবার আর পাগলামি না করে, যেন এবার গেজেল তার ছেলেকে জার্মানিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কাদিরের কচি মুখটার দিকে তাকালেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে হাজেরার। হায়, এই শিশুটিকে সে আর দেখবে না, আর স্পর্শ করবে না, আর তার কচি মুখের আধো আধো কথা শুনবে না। আর কত চোখের পানি ফেললে আর কত আহাজারি করলে কাদির তার হবে?
দেহি বাজান, এমি আয়
তর্জনীতে কাজল নিয়ে কাদিরের কপালে নজর ফোটা লাগায় হাজেরা। ফর্সা চামড়ার ওপর কালো কাজলের টিপ জ্বলজ্বল করে। কি যে সুন্দর দেখায় ছেলেটাকে! মানুষের নজর না লাগি যায়! থু থু করে ছেলের গায়ে থুতু দেয়ার ভঙ্গি করে হাজেরা। মানুষের চোখও যেমন, কাদির যেখানে যায়, যেদিকে যায়, সেদিকেই মানুষের চোখ যায়। কেউ কেউ তো সামনা-সামনি বলেই বসে,
আরে, পোলাডারে তো সাহেবের বাচ্চার মতো লাগে!
মানুষের কৌতূহলকে আড়াল করতে হাজেরা কতবার যে কাদিরকে আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কতবার মনে মনে বলেছে, যারা নজর দেয় তাদের খারাপ চোখ পুড়ে খাক্ হয়ে যাক্। আলাই বালাই দূরে যাক, আমার কাদির ভালো থাক্।
আরে তোমার কাদির তো ভালোই থাকবে। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সাহেবের বাচ্চা সাহেবের ঘরে থাকাই ভালো। কাকের ঘরে কোকিলের ছাও রেখে আর কি হবে, শেষ পর্যন্ত তো সে জাতের মতোই রাও করবে
শহীদ আর ইনগ্রিডকে আনতে ঢাকা যাওয়ার আগে আবদুর রহমান হাজেরাকে নিজস্ব ভঙ্গিতে এসব কথা বলে যায়। হাজেরা পাথর। সে চুপচাপ শোনে হ্যাঁ, না কিছুই বলে না।
কি বলবে? বলে কী লাভ? তার পক্ষে তো কেউ নেই। সবাই বলে, সন্তানকে যে পেটে ধরেছে সেই জন্মদাত্রী মায়ের দাবিই নাকি আগে। কাদিরকে সে পেটে ধরেনি, বুকে ধরে রাখবে কিভাবে? যত কষ্টই হোক, এই মায়া কাটাতে হবে তার।
পরদিন সন্ধ্যার পরে রাস্তায় মাইক্রোবাসের শব্দ শোনা যায়। হাজেরা ঘুমন্ত কাদিরের পাশ থেকে ওঠে হারিক্যান হাতে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমে বড় একটা স্যুটকেস হাতে আবদুর রহমান প্রবেশ করে। তার পেছনে আবদুস শহীদ। হাজেরা তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে শহীদকে সালাম করে, তারপর হারিকেন হাতে দরজার দিকে যায়, ইনগ্রিড বুঝি পেছনে পড়ে গেছে, হাজেরা যায় তাকে এগিয়ে আনতে।
কারে খুঁজেন ভাবি? হেতি আয়ে নাই
আবদুর রহমান বলে। ইনগ্রিড আসে নাই? কেন আসে নাই? হঠাৎ এমন কি হল ইনগ্রিডের? সে কি তবে তার ছেলেকে নিয়ে যাবে না? একসঙ্গে এরকম অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় করে হাজেরার মনে। জামা-কাপড় পাল্টে থিতু হয়ে বসে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয় শহীদ। ইনগ্রিড আসতে চেয়েছিল, প্লেনের টিকিটও কাটা হয়েছিল, কিন্তু রওনা দেয়ার আগের দিন হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে সিঁড়ির ওপর পড়ে যায় সে, বেকায়দাভাবে পড়ে পা এমনভাবে মচকে যায় যে এক পা হাঁটার ক্ষমতাও নেই ওর। ডাক্তার বলেছে, পুরোপুরি বেড রেস্টে থাকতে। বেচারি বিছানায় শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজাচ্ছে এখন। শহীদকে বলে দিয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মার্ককে নিয়ে যেন জার্মানিতে ফিরে আসে।
ও, আসতে পারে নাই তো কি হয়েছে? ছেলের দাবি ছাড়ে নাই সে। বলে দিয়েছে পিতা যেন পুত্রকে নিয়ে যায়।
যাও বাবা, হেতি তোমার আব্বা, যাও হেতির কোলো যাও… হেতি তোমারে লই বিদেশ যাইবো, কত মজা কিনি দিবো, যাও…
সকালবেলা কাদিরকে প্ররোচিত করে হাজেরা। আবদুস শহীদও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ছেলেকে বুকে নেয়ার জন্য। কিন্তু কাদিরের যে কি হল! সে একদম জোঁকের মতো সেঁটে রইল হাজেরার কোলে। কিছুতেই শহীদের কোলে গেল না। হাজেরা একটু জোর করেই শহীদের কোলে দিতে চাচ্ছিল, অমনি শুরু হল তার গগণবিদারী চিৎকার।
শহীদ ছেলের মন ভুলাতে বিদেশ থেকে আনা দামি চকলেট দেয়, রঙিন খেলনা দেয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ছোট্ট দুই হাতে হাজেরার গলা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, শহীদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে কাদির।
হেতি বুজি গেছে, আন্নে হেতিরে নিতে আইছেন, আন্নের হোলার যে বুদ্দি …
হাজেরা রসিকতার ভঙ্গিতে বলে। আবদুস শহীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এরকম হলে এই ছেলেকে নিয়ে এত লম্বা ভ্রমণ সে করবে কীভাবে? এদিকে হাতেও তো সময় বেশি নেই। শহীদ চিন্তিত ও বিব্রত বোধ করে।
ঠিক হই যাইবো। চিন্তা করিয়েন না
আবদুর রহমান এমন আশ্বাস দিলেও আবদুস শহীদ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে টেলিফোনে জার্মানিতে ইনগ্রিডের সঙ্গে কথা বলে।
না, না, তুমি যেভাবে পারো ওকে নিয়ে এসো
ইনগ্রিড শিশুদের মতো কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, আমি শুনেছি প্রাচ্যদেশীয় নারীরা জাদু জানে, হাজেরা আমার পুত্রকে জাদু করেছে, যেভাবে পারো তার কাছ থেকে আমার মার্ককে আলাদা করো তুমি।
ইনগ্রিডের পরামর্শ অনুযায়ী একদিন হাজেরার কাছ থেকে প্রায় জোর-জবরদস্তি করে ছেলেকে নিয়ে বাইরে বের হয় শহীদ। এখানে-সেখানে নিয়ে ঘোরে, এটা-সেটা দেখায়, মার্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আবার খানিকক্ষণ কাঁদে। কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘণ্টা দুয়েক পর শহীদ যখন কাঁধের ওপর নেতিয়ে পড়া ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরে তখন নাকের সর্দি, কপালের কাজল আর চোখের পানি সব মিলে আবদুল কাদিরের চেহারা অদ্ভুত করুণ দেখায়, হাজেরা ছেলেকে বুকে নিয়ে আঁতকে ওঠে। হায় হায়, জ্বরে ছেলের দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে।
পরবর্তী তিনদিন হাজেরার অন্যরকম এক চেহারা দেখল আবদুস শহীদ। এই চেহারা বাংলাদেশের চিরন্তন মায়ের অসুস্থ সন্তানের পাশে বসে থাকা আহারহীন, তৃষ্ণাহীন, নিদ্রাহীন অক্লান্ত চেহারা। আবদুস শহীদের মনে হল, হাজেরা যেন তার পরিশ্রমী মমতা দিয়ে ইনগ্রিডের গর্ভের সন্তানকে জয় করে নিল, নিজের জন্য অর্জন করে নিল। এখন এই শিশুকে সে কিভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ইনগ্রিডের কাছে? তার গর্ভধারিণী মায়ের কাছে? আবার না নিয়ে গেলে সে কিভাবে শান্ত করবে ইনগ্রিডকে? কি স্বান্তনা দেবে তাকে? একদিকে হাজেরার দুঃখি সরল-অসহায় অভিব্যক্তি অন্যদিকে ইনগ্রিডের উৎকণ্ঠিত, তৃষ্ণার্ত, ব্যাকুল চেহারা, দুইয়ের মাঝখানে নিজেকে কেমন দিশেহারা লাগে শহীদের কাছে। এই দুই নারীর মধ্যে কাকে খুশি করবে সে?
জ্বর থেকে সেরে ওঠার পর হাজেরার আবদুল কাদির কিংবা ইনগ্রিডের মার্ক- হাজেরাকে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। রোগে ভুগে তার শরীর আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে, মেজাজও হয়ে গেছে খিটখিটে, অসুস্থতার পর সব শিশুরই যেমনটা হয় আরকি। এদিকে হাজেরা সামান্য চোখের আড়াল হলেই কেঁদে সারা বাড়ি মাথায় তোলে সে।
এমতাবস্থায় দিনকতক পর একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশুটিকে হাজেরার কাছে রেখে একা একাই জার্মানির উদ্দেশে রওনা দেয় আবদুস শহীদ। ফলে হাজেরা অনেকটা পাকাপোক্তভাবেই আবদুল কাদিরকে নিজের কাছে রাখার সুযোগ পেয়ে যায়।
-৩
পরেরবার যখন ইনগ্রিড বাংলাদেশে আসে তখন আবদুল কাদিরের বয়স ছয় পেরিয়ে গেছে। ইনগ্রিডেরও তখন কোল খালি নেই। তার এবং আবদুস শহীদের কোলজুড়ে জমজ সন্তান, এক ছেলে আর এক মেয়ে। হাজেরা প্রাণ উজাড় করে সতীনের নতুন দুই শিশুর সেবা-যত্ন করে। হাজেরার কাণ্ডকারখানা দেখে ইনগ্রিড জার্মান ভাষায় কিছু বললে আবদুস শহীদ অনুবাদ করে নোয়াখালীর ভাষায় হাজেরাকে ঠাট্টা করে বলে, তোমার এই আদর-যতœ দেখে ইনগ্রিড তো ভয় পাইতেছে, তুমি না আবার তার এই দুই সন্তানকেও মায়ার বাঁধনে বেঁধে নিজের কাছে রেখে দেও।
কথাটা ঠাট্টা হলেও এর মর্মার্থ হাজেরার বুকে গিয়ে বিঁধে। বিদেশী হলে কি হবে তাকে খোটা দিতে তো ছাড়ল না ইনগ্রিড।
হাজেরা এখানে-ওখানে পালিয়ে থাকা লাজুক আবদুল কাদিরকে ধরে এনে ইনগ্রিডের সামনে দাঁড় করায়। বলে,
শরম করিচ্ছা, হেতিও তোর আম্মা লাগে, দেখছাই, বাজান, বালা করি চাই দেখ্, আঁই তোঁয়ার কালা আম্মা আর হেতি তোঁয়ার ধলা আম্মা,
ছোট্ট আবদুল কাদির হাজেরার ময়লা শাড়ির ভেতরে মুখ গুজে পড়ে থাকে। তার কাছে সব ব্যাপারটাই ধাঁধাঁর মতো মনে হয়। সে দূর থেকে ধলা আম্মার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে।
আর মার্কের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে যেন তৃষ্ণা মেটে না ইনগ্রিডের। এই তার প্রথম সন্তান, তার স্বপ্নের শিশু, এই শিশুকে সে পেয়েছিল বহু কষ্টের বিনিময়ে, কিন্তু তাকে নিজের বুকে রাখতে পারেনি। এই মার্ক তার গর্ভজাত, তারই রক্তবিন্দু বইছে এর শরীরে, সে তার কত কাছের তবু কত দূরের। না, এখন আর হাজেরাকে দোষী মনে করে না ইনগ্রিড। এটা হয়তো নিয়তি নির্ধারিত। এই সন্তানের ভালোবাসা তার কপালে নেই, এই সন্তানকে ঈশ্বর তার পেটে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এ আসলে হাজেরারই সন্তান, হাজেরার মানসপুত্র।
বাবা, তুমি আমার সঙ্গে জার্মানি যাবা?
ইনগ্রিড নিজের চোখের পানি মুছে ভাঙা ভাঙা বাংলায় তার সন্তানকে জিজ্ঞেস করে। আবদুল কাদির কিছু বলে না, শুধু তার বড় বড় নীল চোখ মেলে ইনগ্রিডের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। সম্ভবত সে আন্দাজ করতে পারে না এর উত্তরে তার কি বলা উচিত। জার্মানি কোথায়? কেনইবা এই সাদা মহিলা তাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়? আম্মাকে ছেড়ে কখনও কোথাও যাবে না কাদির। কাদির যদি চলে যায় তাহলে তো আম্মা মরে যাবে। না, সে আম্মাকে কথা দিয়েছে তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। ধলা আম্মা যত সুন্দরই হোক, যত ভালোই হোক, তার কাছে কালো আম্মাই আপন, কালো আম্মাই ভালো।
ইনগ্রিড তার স্যুটকেস ভরে ছেলের জন্য উপহার এনেছিল। বুকের মধ্যে ছবি আঁকা রঙিন গেঞ্জি, নানা রকমের খেলনা, রং পেন্সিল আর মজার-স্বাদের চকলেট পেয়ে কাদির ভেতরে ভেতরে খুশি, কিন্তু সেই খুশিও সে প্রকাশ করছে পরিমিতভাবে, পাছে না আবার ধলা আম্মা তাকে এ সব জিনিসের লোভ দেখিয়ে জার্মানি নিয়ে চলে যায়।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!