রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্কুলে কিংবা মাদ্রাসায় বক্তৃতা কিংবা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নাও কিংবা বন্ধুদের অংশ নিতে দেখো তাই না? বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি প্রকৃত সত্যকে আবিস্কার করা যায়। আর তাই ইসলামে বিতর্ক বা বাহাসের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “হে নবী ! আল্লাহর পথে মানুষদেরকে ডাকুন হিকমত ও ভাল উপদেশের সাহায্যে। আর লোকদের সাথে পরস্পর বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।”
আল্লাহর এ নির্দেশের আলোকে রাসূল (সা.) মানুষকে ভাল উপদেশের মাধ্যমে ইসলামের দিকে ডাকতেন। কিন্তু এমন অনেকেই ছিলেন যারা কেবল উপদেশে বিশ্বাসী ছিল না। গোড়ামী, একগুঁয়েমী ও ভুল চিন্তাধারার অধিকারী এসব ব্যক্তির সাথে রাসূলেখোদা মুনাযিরাহ বা বিতর্কে লিপ্ত হতেন।
মুনাযিরাহ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, “তোমরা যারা ঈমান এনেছো, শত্রুদের মুকাবিলায় তোমাদের প্রস্তুতিকে ধরে রাখ৷” এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুসলমানরা অবশ্যই সকল পন্থায় শত্রুদের মুকাবিলায় প্রস্তুত থাকবে ৷ ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বিরোধীদের সাথে মুনাযিরাহ্ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন : “বিরোধীদের সাথে আলোচনা কর এবং হিদায়েতের পথকে তা তাদের সামনে উপস্থাপন কর৷ সেই সাথে তাদের গোমরাহীর পথকেও তাদের সামনে তুলে ধর৷”
বন্ধুরা, মুনাযিরাহ বা বিতর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে জানলে। এবার নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছো, রাসূল (সা.) কাদের সাথে বিতর্ক করেছেন? তোমাদের জিজ্ঞাসার জবাবে বলছি, আল্লাহর রাসূল- ইহুদী, খ্রিস্টান, মুর্তিপুজক, নাস্তিকসহ পাঁচ শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে মুনাযিরাহ বা বিতর্ক করেছেন। প্রত্যেকটি বিতর্কে তারা রাসূলের অকাট্য যুক্তি, অগাধ জ্ঞান ও প্রমাণের কাছে হেরে যায়।
একবার নাজরানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল বিতর্কে হেরে গিয়ে রাসূলকে মোবাহেলা করার প্রস্তাব দেয়। তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছো, মোবাহেলা আবার কি? মোবাহেলা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি অভিশাপ দেয়ার অনুষ্ঠান। রাসূলের যুগে পরস্পর বিরোধী দু’টি পক্ষ একটি স্থানে একত্রিত হয়ে একে অপরের প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত অভিশাপ দিত যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের এক পক্ষকে ধ্বংস না করতেন।
২৬ শে জিলহাজ্ব হচ্ছে ঐতিহাসিক মোবাহিলার দিন। ১০ই হিজরীর এই দিনে নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলেখোদার মোবাহেলা সংঘটিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই দিনটি সম্পর্কে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। এ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে এক ইরানি বন্ধু।
ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে একটি পার্বত্য অঞ্চলের নাম নাজরান। নাজরানের ৭৩টি ছোট শহরে প্রায় ৪০ হাজার খ্রিস্টান বাস করতো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দশম হিজরীতে মহানবী (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেনের নাজরান এলাকায় একদল মুসলমানকে পাঠিয়েছিলেন। ঐ দাওয়াত পাওয়ার পর নাজরানের খ্রিস্টান পোপ এ ব্যাপারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সেখানকার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেন। মিটিংয়ের পর তিনি রাসূল (সা.)এর সাথে আলোচনার জন্য মদীনায় একটি প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ সদস্যের ঐ খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন পোপ আবু হারিসা নিজে । তারা মদীনায় গিয়ে রাসুল (সা.)’র সাথে হযরত ঈসা (আঃ)’র ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। কিন্তু তারা যুক্তি ও সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। নাজরানের প্রতিনিধিরা দেখলো, তারা যতই জিজ্ঞাসা করছে রাসূল (সা.) ততই সুন্দরভাবে যুক্তি ও দলিল দিয়ে কথা বলছেন তখন তারা নিশ্চিত পরাজয় জেনে মুনাযিরাহ বা বিতর্ক বন্ধ করে দিল।
মুনাযিরাহ বন্ধ করে তারা বলল : এ সব যুক্তিতর্ক আমাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না ৷ আমরা মোবাহেলা করতে চাই ৷ এ সময় রাসূল (সা.) ওপর সূরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াত নাজিল হলো। মহান আল্লাহ বলেন, (তেলাওয়াত)
অর্থাৎ-“যখন ঈসা সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পরেও তারা আপনার সাথে ঝগড়া করছে তখন আপনি বলুন, এসো! আমি আমার মহিলাদেরকে নিয়ে আসবো, তোমরাও তোমাদের মহিলাদেরকে নিয়ে আসবে,আমি আমার সন্তানদেরকে নিয়ে আসবো তোমরাও তোমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে আসবে, আমি আমার নফসকে নিয়ে আসবো তোমরাও তোমাদের নফসকে নিয়ে আসবে,তারপর মোবাহেলা করবো এবং আল্লাহর লানতকে মিথ্যাবাদিদের উপর বর্ষণ করবো।”
পবিত্র কোরআনের এ আয়াত নাজিল হবার পর রাসূল (সা.) খ্রিস্টানদের বললেন, “তোমরা তোমাদের পুত্র, নারী ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে আসো। আর আমরাও একই কাজ করে জনসমাবেশে এসে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণের জন্য প্রার্থনা করবো।” রাসূলেখোদার এ আহবানের পর খ্রিস্টানদের পোপ তার দলের অন্যান্য সদস্যদের বললো, মোবাহেলার প্রস্তাব মেনে নাও। কিন্তু যদি দেখ, মুহাম্মদ তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে মোবাহেলার জন্য উপস্থিত হয়, তাহলে তোমরা তা করা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনভাবে আপোস করবে।
এ সিদ্ধান্তের পর মুসলিম-খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন অধির আগ্রহে মোবাহেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে যিলহজ্জ মাসের ২৪ মহানবী (সা.) তার পরিবারের মাত্র চার জন সদস্যকে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। এই চার জন হলেন, রাসুল কন্যা ফাতেমা (সা.), জামাতা হয়রত আলী (আ.) এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন (আ.)। রাসূলের সাথে এ চারজনকে দেখে খ্রিস্টানদের দলনেতা বললো, আমি এমন কিছু চেহারাকে দেখতে পাচ্ছি যে, যদি তাঁরা দোয়া করেন, তাহলে পাহাড় টলে যাবে এবং যদি আমাদের ওপর অভিশাপ দেন, তাহলে আমরা একজনও জীবিত থাকবো না। সুতরাং তোমরা মোবাহেলা বন্ধ কর। পোপের পীড়াপীড়ি নাজরানের প্রতিনিধিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো। এক ধরনের অস্থিরতা তাদেরকে ঘিরে ধরলো। দ্রুত তারা একজনকে প্রতিনিধিকে পাঠালো রাসূল (সা.)-এর কাছে। ঐ প্রতিনিধি রাসূলের সাথে দেখা করে মোবাহেলাহ্ বন্ধ করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানালো এবং শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিল।
খ্রিস্টানদের প্রস্তাব পেয়ে মহানবী (সা.) তাদের উপর অনুগ্রহ করলেন এবং আলীকে নির্দেশ দিলেন চুক্তির শর্ত লিখতে। চুক্তির শর্ত নির্ধারিত হওয়ার পর খ্রিস্টানরা তা মেনে নিয়ে নাজরানের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওনা হল। এভাবে খ্রিস্টানদের ওপর মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হল। #
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।