
১ এপ্রিল । পশ্চিমা দেশগুলোতে এ দিনটি পালন করা হয় মানুষকে বোকা বানানোর দিন বা এপ্রিল ফুল হিসেবে। এ দিন মিথ্যা বলে, ধোঁকা কিংবা কষ্ট দিয়ে এবং প্রতারণা করে হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় । দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাশ্চাত্যের কায়দায় মুসলিম দেশগুলোতেও প্রতি বছর কিছু লোক এপ্রিল ফুল ডে পালন করে যাচ্ছে। তো এপ্রিল ফুল ডে উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।
এপ্রিল ফুল মানে হচ্ছে, এপ্রিলের বোকা। কিন্তু কারা ছিল এপ্রিলের বোকা? কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করাকে কেন্দ্র করে এপ্রিল ফুল ডে’র সুচনা হয়। ঐ ক্যালেন্ডারে ১লা এপ্রিলের পরিবর্তে ১লা জানুয়ারীকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কিছু লোক তার বিরোধিতা করে। যারা পুরনো ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১লা এপ্রিলকেই নববর্ষের ১ম দিন ধরে দিন গণনা করে আসছিল, তাদেরকে প্রতি বছর ১লা এপ্রিলে বোকা উপাধি দেয়া হতো। এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন। তিনি বলেছেন, এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের শাসনামলে। হাসিঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল গোপাল ভাঁড় জাতীয় লোক একবার সম্রাটকে কৌতুক করে বলল,জাহাপনা, আমরা আপনার চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবে। এ কথা রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হলেন। রাজা গোপাল ভাঁড়দের সরদার কুগেলকে এক দিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিলো যে, প্রতি বছরের এই দিন অর্থাৎ ১লা এপ্রিল সবাই মিলে হাসি-তামাশা করবে। ব্যাস, তখন থেকেই চালু হয়ে যায় এপ্রিল ফুল ডে।
ইতিহাসের পাতায় এপ্রিল ফুল ডে’র উৎপত্তি সম্পর্কে নানা হাস্যরস,কৌতুক আর আমোদপ্রমোদের কথা থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে শোক ও বেদনার এক কালো পাহাড়। বেদনায় ভরা ঐ ইতিহাস জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন রিয়াদের নেতৃত্বে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করেন। মুসলিম শাসকদের সুশাসনে স্পেন হয়ে উঠে ইউরোপসহ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের একটি কেন্দ্র। শক্তির দিক থেকেও স্পেন ছিল অপ্রতিরোধ্য। একটানা ৭০০ বছর শাসন করার পর মুসলমানরা স্পেনের পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান শাসকদের চক্রান্তের শিকার হয়।
স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করার ঘোষণা দিয়ে পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে ৷ বিয়ের পর দু’জন মিলে সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলে স্পেন আক্রমণের। ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলমানদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এর আগেই রাজা ফার্ডিনান্ড মুসলমানদের হাত থেকে কর্ডোভাসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে নেয়। বাকি ছিল শুধু গ্রানাডা। গ্রানাডার শাসনকর্তা ছিলেন হাসান। খ্রিস্টানরা তার উপর চাপ সৃষ্টি করছিল, আত্মসমর্পনের জন্য। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তাকে আত্মসমর্পনে রাজি করাতে না পেরে খ্রিস্টানরা তার পুত্র আবু আবদুল্লাহকে সিংহাসনে বসানোর লোভ দেখিয়ে হাত করে ফেলে। আবদুল্লাহ তাদের কথায় রাজি হয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং এক সময় বাদশাহ হাসান পুত্রের সাথে যুদ্ধ করার গ্লানি এড়ানোর জন্য তার এক ভাইয়ের হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে দেশান্তরী হন।
আবু আব্দুল্লাহ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তার সেনাপতি মহাবীর মুসাসহ অনেক মুসলমান ফার্ডিনান্ড বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এর আগে কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্ডিনান্ড এবার পা বাড়ায় ভিন্ন পথে ৷ তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৷ অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে গ্রানাডা শহরে ৷ দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন প্রতারক ফার্ডিনান্ড ঘোষণা করে, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে ৷সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল ৷ গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিয়ে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক ৷ সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে ৷ শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয় ৷ এরপর একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা ৷
সেদিন লক্ষ লক্ষ নারী,পুরুষ ও শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত পুড়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর ৷ অসহায় মুসলমানদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী করে তোলে- তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা ! শত্রুর আশ্বাস কেউ কি বিশ্বাস করে?’ সেই থেকে খ্রিষ্টান জগত প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে- April Fool মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসএব ৷ বন্ধুরা, গ্রানাডা ট্রাজেডিই কিন্তু শেষ এপ্রিল ফুল নয়। খ্রিস্টান ও ইহুদিরা এখনও নানাভাবে মুসলমানদের এপ্রিল ফুল বানিয়ে চলেছে। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল গ্রানাডা ট্র্যাজেডির ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেনে এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশ্ব খ্রিষ্ট সম্প্রদায় ৷ সেখানে তারা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে একচ্ছত্র খ্রিষ্টীয় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে ‘হলি মেরি ফান্ড’৷ আর এরই ধারাবাহিকতায় âগোটা খ্রিষ্টান বিশ্ব’ নানা অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে ৷
এপ্রিল ফুল ডের এ মর্মান্তিক ইতিহাস জানারও পর কি আমরা এ দিনটিকে আমোদ-প্রমোদ কিংবা আনন্দের দিন হিসেবে পালন করতে পারি? কক্ষনোই না। এ দিনটি আসলে হওয়া উচিত আমাদের শোকের দিন, ইসলামের শত্রুদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন। আরেকটা কথা। মানুষকে ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা এসব কিন্তু ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। ১লা এপ্রিলে যেভাবে মিথ্যা বলে রসিকতা করার চেষ্টা করা হয় তা কোনভাবেই মুসলমানদের সংস্কৃতি হতে পারে না। রাসূলে খোদা বলেছেন, আমি রসিকতা করি ঠিক কিন্তু কখনো মিথ্যা বলি না। তিনি আরও বলেছেন, ধ্বংস তার জন্য- যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সুতরাং এপ্রিল ফুলের নামে আমরা কেউই কাউকে প্রতারণা করবো না এবং মিথ্যার আশ্রয় নেবো না-এই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার।