বাড়ি থাকলেও আজিজ সাহেবের গাড়ি নেই। শখ ছিল- গাড়ি কিনবেন, কিন্তু সেই পরিমাণ টাকা জমছে না। তাতে অবশ্য অসন্তুষ্ট নন তিনি। হাঁটতে পছন্দ করেন তিনি। কিন্তু দরকারি কোন কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার ব্যাপার এলেই মুশকিল বাঁধে। আবার দূরের কাজ হলে তো রিকসা লাগবেই। আজিজ সাহেবের একটা গুন হলো রিকসায় চড়লেই চালকদের সঙ্গে ভাব জমাতে পারেন। চড়েই গল্প জুড়ে দেন। লম্বা রাস্তা হলে গল্প অনেক গভীরে চলে যায়। অনেক চালক এরকম প্যাসেঞ্জার পছন্দ করে। শুক্রবারে তেমনি এক ড্রাইভার পেলেন আজিজ সাহেব। সচরাচর শুক্রবারে দরকারি কাজ রাখেন না তিনি। ফলে হেঁটেই যাতায়াত করেন সেদিন। কিন্তু এবারের শুক্রবারে তাকে ব্লাড রির্পোট আনতে যেতে হবে সুদূর গ্রিণ রোড। যথারীতি রিকসা খোঁজা শুরু। গলির মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ছোকরা এক রিকসাওয়ালা এলো।
ছোকরাদের রিকসায় উঠতে ভয় পান আজিজ সাহেব, তাও ডাক দিলেন, -এই-ই খালি; যাবে? -কই যাইবেন, ড্রাইভারের পাল্টা জিজ্ঞাসা। -গ্রীণ রোড। -জ্বি। চলেন। -কত? -একটু হাসলো ছোকরা; তারপর বললো, দিয়েন আপনার ইনসাফ মতো। -না, না। এভাবে হবে না। তুই চালাবি, তোকেই বলতে হবে কত টাকা লাগবে। ছেলেটি আবার হাসলো। বললো, দিয়েন ৩০ টাকা। ভাড়াটা কমই মনে হলো। -আচ্ছা চল তাহলে। রিকসায় উঠেই আজিজ সাহেব কথা বলতে শুরু করলেন। -নাম কী তোর? ছেলেটি জবাব দিল, রুহুল। -আরে- পুরো নাম। -রুহুল ইসলাম। আজিজ সাহেব কেমন যেন থতমত খেলেন। নামটা যেন কেমন। রিকসাওয়ালার নাম রুহুল ইসলাম? তারপরও বললেন, ভালো একটা নাম দিয়েছে তোর বাবা-মা। রুহুল বোধহয় একটু লজ্জা পেল। হাসিমুখে বললো, ‘ধন্যবাদ, স্যার। এ শুনে আজিজ সাহেব আরেকটু ভড়কে গেলেন। ছোকরা ধন্যবাদ দিচ্ছে। দিনকাল পাল্টাচ্ছে বটে। হঠাৎ তাঁর চোখ গেল ছেলেটির পিঠের দিকে। কালো কুচ কুচে পিঠ। হালকা ভেজা। চকচক করছে তাই।
শীত যায় যায় করেও যাচ্ছে না এবার। অথচ জানুয়ারি প্রায় শেষ। সকাল ১১ টা বাজে। চারিদিকে হালকা ঠান্ডা। কিন্তু রুহুলের নিশ্চয়ই শীত লাগছে না। কারণ ও যে পরিশ্রমের কাজ করছে। আজিজ সাহেব মৃদু কাত হয়ে ছেলেটির চেহারাটা আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। চুলগুলো ধুলোমাখা। ঘাম নামছে কানের পাশ দিয়ে। ছেলেটির বয়স কত হবে? কল্পনা করতে চেষ্টা করেন আজিজ সাহেব। পনেরো- ষোল হবে বোধহয়, মনে মনে ভেবে নেন। কী কারণে যেন তার মনটা অজান্তেই নরম হয়ে ওঠে। -থাকিস কোথায় তুই? -মোহাম্মদপুরে; কাটাসুর আছে না- সেখানে। -আরে, তা হলে তুই তো আমাদের পাড়ার ছেলে। চুপ করে গাড়ি টেনে চলে রুহুল। কিন্তু আজিজ সাহেব থামার পাত্র নন। বললেন, রুহুলরে, তুই বোধহয় বেশি দিন হয়নি-গাড়ি চালাস। রাস্তার নিয়ম-কানুন ভালো জানিস বলে তো মনে হয় না। -কি কন, স্যার। ঢাকায় একটু সমস্যা হয় আরকি। নিয়ম কানুন জানি। দুই মাস হইলো আইছি এহানে। রিকসা তো অনেকদিন ধরে চালাইতাছি।
এখানে তো কেউ নিয়ম মানে না, আমি কী করুম, স্যার। আজিজ সাহেব ভাবলেন, ছেলেটা তো ভালো। মিথ্যা কথা অন্তত বলছে না। ব্যবহারও ভালো। পুরানোগুলোর মতো ফাজিল নয়। ফলে কথার উৎপাতও বেড়ে যায়। -তোর দেশ কোথায়? -ফরিদপুর। -ঐ খানেও রিকসা চালাইতি? -জি, স্যার; ফরিদপুর টাউনে চালাইতাম। -ঢাকা আসলি কার সঙ্গে? -চাচার সঙ্গে। বিরাট জ্যাম পড়েছে রাস্তায়। আজিজ সাহেব তাই ভালো মতো কথার সুযোগ পেলেন। রুহুলও গামছা দিয়ে ঘাড়টা মোছার ফাঁকে উত্তর দিয়ে চলে। -তোর বাড়িতে কে কে থাকে? -বাবা-মা আছে। পাঁচটা ভাই-বোনও আছে। এ কথা বলেই খানিকটা উদাস হয়ে পড়ে কিশোর ড্রাইভারটি। বোধহয় বাড়ির কথাই মনে পড়েছে। ফরিদপুরে তো ভালোই ছিল ওরা। কেন যে এখানে এলো। মনে মনে ভাবে রুহুল। নিজের উপরই কিছুটা বিরক্ত। তারপরও আপন মনে বলে ওঠে, -ঢাকা দেখার খুব শখ ছিল। -তা, কেমন লাগছে এ শহর? -ভালো না, স্যার।
অফিস সময় রাস্তায় আমার ভয় লাগে। আর হরতালে যেভাবে আগুন লাগে, বাবা রে বাবা। -কিন্তু পয়সা তো ভালোই পাচ্ছ। ফরিদপুরে তো এত টাকা ভাড়া নিশ্চয়ই পাও নাই? মাথা নাড়ে রুহুল। আজিজ সাহেবের কথা স্বীকার করে। -কিন্তু পয়সা তো থাহে না। জ্যাম ঢিলা হয়ে আসে। রুহুল প্যাডেলে জোরে চাপ দিতে দিতে বলে যায়, – গরিব মানুষের স্যার খাওয়া খরচ অনেক। সারাদিন খাটুনির পর কম খাইলে তো হয় না। জিনিসপত্রের দাম অনেক এখানে। মানুষেরও দয়ামায়া নাই। আমি স্যার এখানে থাকুম না। কয়েকদিন পরে চইল্যা যামু। রুহুলের চলে যাওয়ার কথা শুনে আজিজ সাহেবের মায়া লাগে। তিনি ভাবছেন, কেন যে এসব কথা তুললাম। আজিজ সাহেব তখন অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে দেন। জিজ্ঞাসা করেন- রুহুল, তুই রিকসা চালানোর আগে কি করতিস? -স্কুলে পড়তাম। আজিজ সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এই উত্তরের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। নিজের আশ্চার্য হওয়া দেখে আবার নিজে থেকে বিস্মিতও হলেন।
একটা ছেলের তো স্কুলেই যাওয়া উচিত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলও আরও বেড়ে গেল। ছেলেটা তা হলে কোন বিপদে পড়ে রিকসা চালাচ্ছে না কি? -সত্যি বলছো তুমি? – হ, হাছাই। – কোন ক্লাশ পর্যন্ত পড়েছ? নিজের অজান্তেই আজিজ সাহেব ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে চলে এলেন। – কেলাস সেভেন পর্যন্ত। -এর পর আর পড়লে না কেন? – রুহুল চুপ। কোন উত্তর দিচ্ছে না। কিন্তু আজিজ সাহেব তো কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না। কেন রুহুল আর পড়তে পারলো না- এটা তাকে তো জানতেই হবে। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা এই বিকালের জন্য আজিজ সাহেবের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। শেষ পর্যন্ত রুহুলও পেটে কথা রাখতে পারলো না। আজিজ সাহেবের জানার ক্ষুধার কাছে আত্মসমর্পন করতে হলো তাকে। কাহিনীটি সংক্ষেপে এরকম যে, স্কুলে গেলেও ফোর-ফাইভ থেকে রুহুল ক্লাশে খারাপ করছিল।
ফাইভ অতিক্রম করেই সে আর ক্লাশে তাল রাখতে পারছিল না। সিক্সে রুহুল ফেল করে। ওর বাবা স্কুলের স্যারদের বলে কয়ে ক্লাশ সেভেনে প্রমোশনের ব্যবস্থা করেন। সেখানেও ও ফেল করে। একই ক্লাশে পরপর দু’ বছর থাকে সে। নিচের ক্লাশের ছেলেদের সাথে পড়তে খারাপ লাগছিল। -কিন্তু কি করবো, স্যার? মধুমতি নদী আমাদের ক্ষেত প্রায় সব ভাইঙ্গা নিয়া গেছে। বাড়িতে অনেক বেলায় কোন রান্নাও হইতো না। ভাই- বোনগুলার চেহারা মলিন হইয়া থাকতো। এর মাঝে কি লেহাপড়া অয়? স্কুলে আমার এই অবস্থায় বাবা-মাও দুঃখ পাইতো। তাই এক সময় বাড়ি চাইরা ফরিদপুর টাউনে চইলা আইলাম। হেআনে রিকসা চালাইলাম কিছু দিন। আমাদের গ্রামের এক মাইনসের মাধ্যমে বাড়িতে টাহাও পাঠাইতাম। ওরে বলছিলাম আমি কি করি হেইডা বাড়িতে না কইতে। কিন্তু কিভাবে যেন গ্রামে ব্যাপারটা জানা-জানি হইয়া গেল। তহন ফরিদপুর থেইক্কা ঢাকা চইলাম আইলাম। -কিন্তু ঢাকা একটুও ভালো লাগছে না, স্যার। এই বলে রুহুল ডায়গনস্টিক সেন্টারের সামনে গামছায় চোখ মুছতে শুরু করলো।
আজিজ সাহেব এখানে এসেছেন তাঁর ব্লাড পরীক্ষার রিপোর্ট নিতে। সকালে এসেছিলেন ব্লাড দিয়ে যেতে। রুহুলকে টাকা না দিয়ে রাস্তার এক পাশে বসতে বললেন তিনি। অর্থাৎ আবার যাবেন। ব্লাডের রিপোর্ট নিয়ে দুপুর থেকে তাঁর টেনশন ছিল। কিন্তু রুহুলের গল্প শুনে সেই টেনশন এখন প্রায় হাওয়া। রুহুলের কাহিনী তার মন খারাপ করে দিয়েছে। রুহুলের রিকসাতেই আবার মোহাম্মদপুর এলেন তিনি। পথে রুহুলকে আবার লেখাপড়ার অনুরোধ করলেন। এও বললেন, তিনি সাহায্য করতে রাজি আছেন। কিন্তু রুহুল রাজি হলো না। -এখন আর স্যার, হইবো না। মাঝখানে কতদিন হইয়া গেছে। পুরানো কিছু আমার মনেও নাই। বই-পুস্তকের সঙ্গে সম্পর্ক নাই অনেক দিন। ঐডা আমার কপালে নাই, স্যার।
অহন একটা ভালো কাম দরকার। বাব-মা রিকসা চালানো পছন্দ করে না। আজিজ সাহেবের ১০৬ কাটাসুরের দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো রিকসা। রুহুলকে শিগগির আরেকদিন আসার অনুরোধ করে বাসায় ঢুকলেন তিনি। হাতে ব্লাড রিপোর্টের খাম। খোলাই হয়নি এখনো। খুললে তিনি দেখতে পেতেন, সকালের ফাস্টিংয়ের ব্লাড সুগার তাঁর এখন ২২। খারাপ লক্ষণ। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আজিজ সাহেবের। চেয়ারে বসেই ভাবতে শুরু করলেন, ছেলেটার জন্য কী করা যায়! আজীবনের পুরানো দুঃখটা আবার বুকের পাশে চিন চিন করে ওঠে। আজিজ সাহেবের কোন ছেলে নেই।