এক ভাল্লুকের গল্প–রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সে অনেক বছর আগেকার কথা। ১৯১৪ সালে ইউরোপে মহাযুদ্ধ বেধেছিলো। যুদ্ধবাধবারও কয়েক মাস আগেকার একটা গল্প বলছি। গল্পটা বানানো নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা।
সেই সময় নইনিতাল ও আলমোড়ার মাঝামাঝি রামগড় পাহাড়ে আমাদের একটা বাড়ি ছিল। সেখানে যাওয়া সহজ ছিল না, এত চড়াই ভাঙতে হয় যে সে রাস্তায় মোটর যেতে পারত না। রামগড়ে যেতে গেলে বেরিলিতে গাড়ি বদল করে ছোট রেল রাইনে পুঁচকে ট্রেনে করে কাঠগুদাম স্টেশনে নামতে হত। এখান থেকেই ঐ অঞ্চলের হিমালয় পাহাড় আরম্ভ হয়েছে। কাঠগুদাম থেকে থেকে ঘোড়ার পিঠে পাহাড়ে উঠতে হয়। যারা ঘোড়ায় চড়তে ভয় পায় তাদের জন্য ডান্ডী বলে একরকম হাতলওয়ালা আরাম-চেয়ার পাওয়া যায়, চারজন বাহক সেটা কাঁধে করে নিয়ে যায়। আমাদের বাড়িটা রামগড় পাহাড়ের উপরে ৭০০০ ফিট উঁচুতে ছিল, কাঠগুদাম থেকে ১৬ মাইল পথ উঠে যেতে হত। আমার বাবা বাড়িটার নাম দিয়েছিলেন ‘হৈমন্তী’। বেশ সুন্দর নাম নয় কি? হৈমন্তী নামের মধ্যেই পাহাড়ের ঠান্ডা ভাব যেন বেশ রয়েছে।
গরমের ছুটি পড়লে বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন রামগড়ে। শান্তিনিকেতনে তখন দারুণ গরম লু বইছে, জলের অভাবে গাছপালা মরমর। পাহাড়ে পৌঁছে সেই গরম থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বড় আরাম বোধ হল। আমরা কয়েকজন হৈমন্তীতে গিয়ে গুছিয়ে বসবার পর অনেক লোক সেখানে এসে পড়লেন। অতিথিতে বাড়ি ভরে গেল। যদিও হৈমন্তী পাহাড়ের একটা নিতান্ত নিরালা জায়গায়, লোকের বসতি বা হাট বাজার থেকে দূরে, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার অভাব হল না। বাড়ির সঙ্গে মস্ত বড় বাগান ছিল; আপেল, পেয়ারা, পীচ, চেরি প্রভৃতি ভাল ভাল ফলের গাছ ছিল বিস্তর। বাগানে সব্জীও হত প্রচুর। খুব মজা করে আমরা সেই সব ফল ও সব্জী খেতুম।
গণ্যমান্য অতিথিদের মধ্যে এলেন অতুলপ্রসাদ সেন ও সি.এফ. এনডরুজ। অতুলবাবুর নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। তিনি ছিলেন কবি-অনেক গান বেঁধেছিলেন, তাঁর গান শুনতে সকলে ভালবাসতেন। আর সি.এফ. এনডরুজ সাহেব হলে কি হয়, তিনি আমাদের দেশকে নিজের দেশ করে নিয়েছিলেন। তিনি উৎপীড়িত ও গরিবদের সর্বদা সাহায্য করতেন বলে লোকে তাঁর ‘দীনবন্ধু’ নাম দিয়েছিল। আমাদের কাছে আরো এলেন আমার ভাইপো দিনেন্দ্রনাথ ও মুকুল দে। দিনেন্দ্রনাথ খুব ভাল গান গাইতে পারতেন, বাবার সব গান তিনি জানতেন বলে লোকে তাঁকে বলত ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভান্ডারী’। মুকুল দে তখন শান্তিনিকেতন ইস্কুলের ছাত্র, তার আঁকার খুব শখ, রাতদিনই কাগজ পেন্সিল নিয়ে সকলের ছবি এঁকে বেড়াত। পরে সে আর্টিস্ট বলে নাম করেছে।
এতগুলি লোক এক বাড়িতে, আমাদের খুব জমেছিল সেবা। রোজ সকালবেলায় পাহাড়ের গায়ে একটা গুহার সামনে আমরা সকলে বসতুম। সেখান থেকে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই মনোরম দৃশ্য। কত পাহাড়-পর্বত শ্রেণী, তাতে কতরকমের গাছ। পিছ দিকে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত গভীর বন, তার ভিতর কত বিচিত্র রকমের সুন্দর অর্কিড ফুল। সবচেয়ে ভাল লাগত দেখতে বরফের পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য। সকাল বেলার রোদে বরফে ঢাকা পবর্তশিখরগুলি ঝক্ঝক্ করত আমাদের চোখের সামনে। রোজই সেখানে আমাদের গানের মজলিস বসত। কত নতুন গান বেঁধে বাবা আমাদের শোনাতেন। অতুলপ্রসাদ সেনও তাঁর অনেক শোনাতেন। অতুলবাবুর ফরমাসমত দিনেন্দ্রনাথকে বাবার পুরনো গান গাইতে হত। গানের মজলিস চলত দুপুর পর্যন্ত। বনমালীর তাগিদে তখন গান বন্ধ করে খেতে যেতে হত।
গান, গল্পগুজব, কাব্য-আলোচনা, কবিতাপাঠ নিয়ে রামগড়ের হৈমন্তী বাড়িতে আমাদের দিনগুলি খুব আনন্দে কেটেছিল। এর মধ্যে একটি ঘটনা হল- তারই গল্প তোমাদের বলব বলে লিখতে বসেছি।
মুকুল কারো কাছ থেকে শুনেছিল রামগড় পাহাড়ের আশেপাশে অনেক বুনো জন্তু জানোয়ার আছে। সাহেবরা এখানে শিকার করতে প্রায়ই আসে। সেই শুনে অবধি তার শিকারের ভারি লোভ হল। আমাদের রাত দিন অনুরোধ করত, “চলুন, শিকারে যাই; দাদা, আমাকে শিকারে নিয়ে চলুন।” তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম- শিকার করতে গেলে বন্দুক লাগে, এখানে শিকার করতে আসি, বেড়াতে এসেঠি, বন্দুক আনা হয় নি। এই কথা শুনে সে চুপ করে গেল, ক’দিন আর কিছু বলে না। আমিও নিশ্চিন্ত হলুম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেহাই পেলুম না। একদিন ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে মুকুল আমাকে বলে, “দাদা, উঠুন, চলুন- সব ঠিক আছে।” দেখলুম ঠিকের মধ্যে একটি মান্ধাতা আমলের গাদা বন্দুক। আমাদের বাড়ি তদারক করে যে মুন্সী, তার কাছ থেকে বন্দুক জোগাড় করেছে কেবল নয়, তাকে সুদ্ধু ধরে নিয়ে এসেছে।
মুকুল বললে, “মুন্সীকে নিয়ে এসেছি। সে আমাদের পথ দেখাতে পারবে, জঙ্গলে আমরা হারিয়ে যাব না।”
মুকুল নাছোড়বান্দা। না গিয়ে উপায় নেই। পকেটে কিছু খাবার নিয়ে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা গেলেই বন। গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লুম। সেখানে আদ্যিকালের বুড়ো বুড়ো ‘ওক’ গাছ। তাদের ডালপালা শ্যাওলার মত ‘মস্’ দিয়ে ঢাকা। গাছের তলায় এত অন্ধকার যে যেতে গা ছম্ছম্ করে। ‘ওকে’র বন শেষ হল ত পাইনের বন আরম্ভ হয়। পাইনের পাতা সুতোর মত সরু লম্বা বলে ইংরেজিতে ‘নীডলস্’ (সূচ) বলে। শুকনো সেই পাতা পড়ে মাটিতে পুরু হয়ে বিছিয়ে থাকে। তার উপর দিয়ে হাঁটা বড় মুশকিল, পা হড়কে যায়। প্রত্যেক গাছের গায়ে একটি করে মাটি ভাঁড় বাঁধা থাকে, গাছ থেকে যে আঠা বেরয় তাই ধরবার জন্য। পাইনের আঠা থেকে রজন ও তারপিন তৈরি হয়। তাই পাইনের বন সুগন্ধে ভরা।
এইরকম কত বন, কত পাহাড়, কত ঝরনা পার হয়ে আমরা চললুম। সমস্ত দিন ঘুরে বেড়ালুম, না একটা বাঘ, না একটা ভাল্লুক, এমন কি না একটা শেয়াল দেখতে পাওয়া গেল। কোথাও উপরের পাহাড় থেকে ঝিরঝির করে জল নেমে আসে। জল দেখলেই মুকুল থমকে দাঁড়ায়। জলের ধারে পায়ের কোনো দাগ দেখতে পেলেই কানে কানে আমাকে বলে- ‘দাদা, আছে, আছে, বাঘের পায়ের দাগ দেখেছি, চলুন দাগ ধরে এগিয়ে যাই।”
আবার চলতে থাকি। কিন্তু জ্যান্ত কোন জীবেরই সন্ধান পাওয়া গেল না। পেলে যে কী বিপদ তা আমি বঝুতে পারছিলুম। সঙ্গে একটিমাত্র বন্দুক, তাও সিপাহী বিদ্রোহ আমলের হবে। ভগবানের দয়ায় বাঘ-ভাল্লুকরা দেখা দিল না।
সন্ধ্যা হয়ে আসে, মুন্সীকে বললুম এখন বাড়ি ফেরবার পথ দেখিয়ে দাও। হৈমন্তী থেকে অনতিদূরে একটি মস্ত বড় ‘ওক’ গাছ ছিল। সমস্তদিন ওঠা-নামা করে অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ছিলুম। পা আর চলে না। আমরা তিন জনে বসে পড়লুম সেই গাছতলায় গাছের গুঁড়ি ঠেসান দিয়ে। যেই বসে একটু আরাম করছি, মাথার উপরে ডালপালার মধ্যে খড়খড় শব্দ হল, ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। দাঁড়িয়েছি আর মেটে রঙের একটা ভাল্লুক ঝুপ করে পড়ল মাটিতে ঠিক আমাদের সামনে। নেমে পড়েই দু’পা তুলে আমাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমার পিছনে একটি গোঙানির শব্দ শুনতে পেলুম। বন্দুক তুলতে যাব- কে আমাকে জাপটে ধরল। বন্দুকটা তার থেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য টানহেঁচড়া করছি- এমন সময় ভাল্লুকটা মুখ ফিরিয়ে হুড়মুড় করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমার মনে হল চলে যাবার সময় তার মুখে যেন একটু বিদ্রুপ-হাসি দেখা গেল। ভাল্লুক কি হাসতে পারে? কে জানে! আমাদের কান্ডকারখানা দেখে সে কি সত্যি কৌতুক বোধ করল? কি জানি, তবে চলে গেল তাই রক্ষে। আমরা আর দেরি করলুম না, বিশ্রাম করা চুলোয় গেল- ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলুম পা চালিয়ে।
যতদিন তারপর আমরা রামগড়ে ছিলুম, মুকুল আমার কাছে শিকারের কথা ঘুণাক্ষরেও আর তোলেনি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!