এক ব্যবসায়ী এবং তার তিন ছেলে (২য় পর্ব)

বৃদ্ধ ব্যবসায়ী তার ব্যবসার দায়িত্ব ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দ্বীনী কাজে মনোনিবেশ করার চিন্তা করেছেন। দায়িত্ব দেওয়ার আগে তিনি ছেলেদের যোগ্যতা যাচাই করার চেষ্টা করলেন। বড়ো দুই ছেলে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে নি। ছোটো ছেলে পরীক্ষা দিতে শুরু করেছে। গত আসরে শেষ হয় নি গল্পটি।

ছোটো ছেলে বাজারে কোনো গোলাম কিনতে না পেরে অবশেষে ‘ফারামার্‌য’ নামের এক উলঙ্গ লোককে নিয়ে বাসায় ফিরলো। ব্যবসায়ী উলঙ্গ লোকটাকে জামা কাপড় দিলো পরার জন্য। পরদিন সকালে বাণিজ্য যাত্রার জন্য মালামাল গোছগাছ করে রাখতে এবং নাস্তা প্রস্তুত করতে বললো। আরও বললো সূর্য ওঠার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়তে হবে। ফারামারয তাই করলো। ভোরে ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে পঞ্চাশটা খচ্চর নিয়ে এলো। বোঝাগুলো তুলে দিয়ে মনিবের জন্য নাশতার আয়োজন করলো এবং মনিবকে জাগিয়ে তুললো।

 

মনিবের ঘুম ভাঙতেই দেখলো সবকিছু প্রস্তুত। ফারামারয্‌কে বললো: ‘চমৎকার! বোঝাই যাচ্ছে তুমি কাজের মানুষ। সবকিছুই ঠিকঠাকমতো করতে পারবে তুমি’। তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলো। বাবা তাকে উপদেশ দিয়ে বললো: তুমি যে পথে যাচ্ছো, ওপথে সরাইখানা পড়বে। ওর পাশেই পানির আধারও আছে একটা। মনে রাখবে ওই সরাইখানা কিংবা পানির আধারের কাছে বাসা নেবে না। ওখান থেকে আরও উপরে কোনো একটা জায়গায় যাত্রাবিরতি করো।

ছেলে বাবাকে কথা দিয়ে বিদায় নিয়ে ফারামারযের সাথে রওনা হলো বাণিজ্য যাত্রায়।

 

 

যেতে যেতে যেতে সেই সরাইখানায় গিয়ে পৌঁছলো তারা। ফারামারয মালামাল নামালো নীচে। কিন্তু ব্যবসায়ীর ছেলে বললো: ‘কী ব্যাপার, ভুলে গেছো, বাবা বলেছিল সরাইখানায় না থামতে’? ফারামারয বললো: কিচ্ছু হবে না, এতো ভেবো না তো! ছেলেটাও কিছু আর বললো না। ফারামারয রাতের খাবার প্রস্তুত করলো। খচ্চরগুলোকে বেঁধে রেখে খাবার খেলো। খেয়েদেয়ে দিলো ক্লান্তির ঘুম। ফারামারয্‌ও মালামালের বস্তার ওপর শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল দূর থেকে একটা আলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ফারামারয উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো খচ্চরগুলোর মাঝে একটা দুষ্ট এবং হিংস্র খচ্চর ঘুমিয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি তার দড়ি খুলে দিলো এবং আলোর দিকে পাঠিয়ে দিলো।

 

ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল যে আলোটা ঘনিয়ে আসছিল সেটা নিভে গেল এবং দুষ্টু খচ্চরটা মাথায় মুখে রক্তমাখা অবস্থায় ফিরে এলো। ফারামারয উঠে খচ্চরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো, তাকে একটু মিষ্টিও খাওয়ালো। মোটকথা অনেক আদর যত্ন করলো এবং সবশেষে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে সরাইখানার বাইরে গিয়ে দেখে চল্লিশটা লাশ পড়ে আছে। ভয়ে আঁতকে উঠে সে তার মনিবকে জাগিয়ে তুললো। নাশতার আয়োজন করলো। মনিব যখন খচ্চরকে রক্তমাখা অবস্থায় দেখলো ফারামারযকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে ওর, রক্ত এলো কোত্থেকে? ফারামারয মনিবের হাতটা ধরে বাইরে নিয়ে গেল এবং লাশগুলো দেখালো। মনিবের চোখ তো চড়কগাছ। হতবিহবল হয়ে গেল সে।

 

ফারামারয তার মনিবকে বললো: জানেন এসব লাশ কাদের? মনিব বললো: না, এরা কারা? কী হয়েছে? কে মেরেছে ওদের?

ফারামারয বললো: এরাই সেই চোরের দল যাদের ভয় পাচ্ছিলেন আপনার বাবা। একথা শুনে ব্যবসায়ীর ছেলে স্বস্তি পেল। খুশি হলো সে। ফারামারযকে বললো: মাল সামান ঠিকঠাকমতো বেঁধে রওনা হতে। তাই করলো ফারামারয। কাফেলা যেতে যেতে একসময় সেই পানির হাউজের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। মালের বোঝাগুলো নীচে নামিয়ে ফারামারয যাত্রাবিরতির চিন্তা করলো। কিন্তু ব্যবসায়ীপুত্র এবারও ফারামারযকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললো: মনে নেই, বাবা বলেছিলেন এখানে রাত কাটানো যাবে না?

 

 

ফারামারয বললো: মনে আছে। কিচ্ছু হবে না। চিন্তা করবেন না।

 

এবারও সেই সরাইখানার মতোই মালের বোঝা বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করলো। রাতের খাবারের আয়োজন করলো। মনিব খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ফারামারযও বস্তার ওপর ঘুমালো। ঘণ্টাখানেক পর ফারামারয দেখতে পেলো একটা নেকড়ে এবং একটা শেয়াল এসে হাজির ওই চৌবাচ্চার কাছে। নেকড়ে শেয়ালকে জিজ্ঞেস করলো: হে শেয়াল, এখানে কী করছো? শেয়াল জবাবে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো: তুমি কী করছো এখানে?

 

নেকড়ে বললো: আমি প্রতিরাতেই এখানে শিকারের সন্ধানে আসি। ঘটনা হলো এখানে খুব কাছেই দুম্বার পাল আছে। কিন্তু রাখাল একটা বিরাট কুকুর পালে। ওই কুকুরের কারণে কাছে ঘেঁষতে পারি না।

 

আজ রাতেও আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। আজও আমি শহরের আশেপাশে গেছি। দেখলাম বেশ কিছু লাশের কাটা মাথা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কী করেছিল এই হতভাগারা। জবাবে শুনলাম: ওই শহরের বাদশার মেয়ে নাকি পাগল হয়ে গেছে। যত ডাক্তার কবিরাজ ছিল সবাইকে ডেকে আনা হয়েছে। কিন্তু যে-ই তার রোগ সারাতে ব্যর্থ হলো তাকেই জীবন দিতে হলো। তারই মাথা কেটে মিনারের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হলো।

ফারামারয শেয়াল ও নেকড়ের সব কথা শুনলো এবং অপেক্ষা করতে লাগলো ভোরের আশায়।

 

সকাল হবার পর ফারামারয মনিবের জন্য নাশতা পানির ব্যবস্থা করলো। নাশতা দিয়ে ফারামারয কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বলে গেল দ্রুত ফিরে আসবো। ফারামারয গেল সেই রাখালের কাছে। গিয়ে বললো: তোমার কুকুরটা বিক্রি করবে? রাখাল বললো: এই কুকুর না থাকলে দুম্বাগুলো হারাতে হবে। ফারামারয বললো: দুম্বাগুলোর দাম কতো? রাখাল বললো: এক শ’ তুমান। ফারামারয রাখালকে এক শ’ তুমান দিয়ে বললো: এই হলো তোমার দুম্বার দাম। নেকড়ে যদি দুম্বা শিকারও করে এখন আর তো অসুবিধা নেই। টাকা তো পেয়েছো। আর যদি নেকড়ে হামলা না চালায় তাহলে দুম্বাগুলো তোমার লাভ। রাখাল এবার কুকুরটা দিতে বাধ্য হলো। ফারামারয কুকুরটাকে সামান্য দূরে নিয়ে তাকে খাবার দিলো এবং হাত বুলিয়ে দিলো তার পিঠে।

 

ফারামারয  একটা পাথর নিলো। কুকুর যখন ঘুমিয়ে পড়লো পাথরটা জোরে মারলো তার মাথায়। কুকুরের মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে এলো। সেই মগজ রুমালে পেঁচিয়ে পকেটে নিয়ে ফারামারয রওনা হলো সেই শহরের দিকে যে শহরের শাহজাদি পাগল হয়ে গিয়েছিল। শহরে ঢুকে বাদশার প্রাসাদে ঢোকার দরোজায় গিয়ে পরিচয় দিলো: আমি একজন ডাক্তার, এসেছি শাহজাদির চিকিৎসা করতে।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!