এক ব্যবসায়ী এবং তার তিন ছেলে

পুরানো দিনের কথা। এক ব্যবসায়ীর ছিল তিন ছেলে। ব্যবসায়ী যখন বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছলো স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়লো। আগের মতো পরিশ্রম করার কিংবা শারীরিক সক্ষমতা এখন তো আর নেই। তাই ভাবলো ব্যবসার দায়-দায়িত্ব ছেলেদের কারও হাতে ছেড়ে দিয়ে তসবিহ তাহলিলে মন দেবে। তবে তার আগে ব্যবসায়ী চেয়েছিল ছেলেদেরকে একটু পরীক্ষা করে দেখতে-আসলেই তারা উপযুক্ত হয়েছে কিনা; তাদের ওপর ব্যবসার এতো বড়ো দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় কিনা। বড়ো ছেলেকেই সবার আগে ডাকলো। তাকে বললো: দেখো বাবা! আমার তো বয়স হয়ে গেছে। এখন আর কাজ করার মতো সামর্থ্যও নেই। তাই ভাবছি ব্যবসার দায়িত্বটা তোমার হাতে ছেড়ে দেবো। তবে তার আগে তুমি কতোটা পারবে কাজটা আঞ্জাম দিতে সেটা একটু নিশ্চিত হওয়া দরকার। তুমি এক কাজ করো! এই এক শ’ তুমান নাও! এ দিয়ে স্বর্ণ গয়না হোক কিংবা যা-ই হোক তুমি কিনে সেটা দিয়ে ব্যবসা করো!’

 

ছেলে তো খুশি। এক শ’ তুমান নিয়ে সে রওনা হলো বাজারের দিকে। বাজারে না পৌঁছতেই দেখা হয়ে গেল একদল বখাটের সাথে। সেও ওই দলের সাথে মিশে গেল। এরপর তো যা হবার তাই হলো। ওই এক শ’ তুমান খরচ করে খুব মজা করলো রাতভর। সকাল যখন হলো খালি হাত পা নিয়ে ফিরে গেল বাড়িতে। বাবা তো ছেলের অবস্থা দেখেই বুঝতে পেরেছে যে টাকা-পয়সাগুলো সবই উড়িয়ে এসেছে। তারপরও বাবা জিজ্ঞেস করেছে: কী করেছো?

ছেলে বললো: টাকা-পয়সা সব খরচ হয়ে গেছে।

 

এরপর যা যা ঘটেছিল ছেলে তার বাবাকে সত্য সত্য খুলে বললো। বাবা মাথা নাড়িয়ে বললো: ঠিক আছে, তুমি তোমার কাজে যাও! বুঝতে পেরেছি তুমি ব্যবসার উপযুক্ত নও!

 

বড় ছেলেকে একথা বলে ব্যবসায়ী তার গোলামকে পাঠালো মেজো ছেলেকে ডেকে আনতে। দ্বিতীয় ছেলে আসার পর বাবা তাকে বললো: গতকাল তোমার বড় ভাইকে ডেকে বলেছিলাম যে দেখো বাবা! আমার তো বয়স হয়ে গেছে। এখন আর কাজ করার মতো সামর্থ্যও নেই। তাই ভাবছি ব্যবসার দায়িত্বটা তোমার হাতে ছেড়ে দেবো। তাকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তার হাতে এক শ’ তুমান দিয়েছিলাম যাতে ঐ টাকা সে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করে। কিন্তু সে টাকাটা নষ্ট করে বাসায় ফিরে এসেছে। তাকে দিয়ে আসলে ব্যবসা হবে না। ও কাজের না। আমি ভাবছি তোমার হাতেই ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে দেবো। আমি তোমাকেও এক শ’ তুমান দিচ্ছি দেখি তুমিও তোমার ভাইয়ের মতো নাকি তার বিপরীতে কাজ কর্ম করার যোগ্য। যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারলে ব্যবসার দায়িত্ব তোমার হাতে ছেড়ে দেবো। এই বলে বাবা ছেলের হাতে এক শ’ তুমান দিলেন।

 

দ্বিতীয় ছেলে বাবার কথা মনোযোগের সাথে শুনলো এবং এক শ’ তুমান গ্রহণ করলো। টাকাটা নিয়ে রওনা হলো বাজারের দিকে। কিন্তু এই ছেলেও তার বড়ো ভাইয়ের মতোই একদল বখাটের পাল্লায় পড়ে মদ জুয়ার আড্ডায় জড়িয়ে টাকাটা ধ্বংস করে ফেললো। সকালবেলা সেও বড়ো ভাইয়ের মতোই খালি হাতে গিয়ে পৌঁছলো বাড়িতে। বাবা জিজ্ঞেস করলো: টাকাটা কী করেছিস?

 

ছেলের জবাবটা বড়ো ভাইয়ের মতোই ছিল। বাবা তাই দ্বিতীয় ছেলেকেও বললো: ঠিক আছে, তুমি তোমার কাজে যাও! বুঝতে পেরেছি তুমি তোমার বাবার ব্যবসা চালানোর উপযুক্ত নও। তোমাদের কাজের পরিণতি তোমরাই ভোগ করবে।

ব্যবসায়ী বাবা এবার তার ছোটো ছেলেকেই টার্গেট করলো। তাকে ডেকে এনে তার বড়ো দু ভাইয়ের কথা জানালো। বললো: তারা তো আমার ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার উপযুক্ত নয়। তাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে। এখন তোমার পালা। তুমি এই এক শ’ তুমান পুঁজি নিয়ে যাও, দেখো কী করতে পারো। তোমার যা খুশি কিনে অন্য বাজারে বিক্রি করো কিংবা অন্য শহরেও নিয়ে যেতে পারো। মোটকথা ব্যবসা করো’!

ছোটো ছেলে টাকাটা নিলো এবং বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। পথিমধ্যে দেখলো ক’জন লোক  একটা মৃত মানুষকে গাছের সাথে বেঁধে মারছে। ছেলেটা সামনে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে? মরা মানুষকে চাবুক মারছো কেন?

 

একজন বললো: নিজের চরকায় তেল দাও! আমার কাজে নাক গলাতে এসো না।

 

ছেলে বললো: না, নাক গলাতে চাই না। শুধু জানতে চাই ব্যাপারটা কী? হয়তো উপকারেও আসতে পারি।

তাদের একজন বললো: আমরা এই লোকের কাছ থেকে এক শ’ তুমান পেতাম। আমাদের টাকা না দিয়ে সে মরে গেছে। এখন তাই মারছি টাকাটা উশুল করতে।

ছেলে বললো: মরা মানুষ মেরে কী হবে। ওকে ছেড়ে দাও! গোসল দিয়ে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করো। তার দেনা এক শ’ তুমান আমিই দেবো।

লোকেরা তাই করলো। দাফন কাফনের কাজ শেষ হবার পর ছেলেটা এক শ’ তুমান তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে গেল।

 

বাড়ি যাবার পর যথারীতি বাবা জিজ্ঞেস করলো: কী করলে টাকা দিয়ে!

ছেলে বললো: একটা লাশকে মুক্ত করেছি।

এরপর পুরো ঘটনাটা বাবাকে খুলে বললো। বাবা সব শুনে বললো: ভালো কাজই করেছো। এই নাও তোমাকে আরও এক শ’ তুমান দিচ্ছি। এই টাকা দিয়ে এবার ব্যবসা বাণিজ্য কিছু একটা করো।

ছেলে এবার টাকাটা দিয়ে বিচিত্র ব্যবসায়িক পণ্য কিনে বাড়ি ফিরে এলো। বাবা যখন দেখলো ছেলে বেশ সক্রিয় এবং পরিশ্রমী, আরও এক শ’ তুমান দিয়ে বললো: দু’ তিনটা গোলাম কিনে নাও।

ছেলে বাজারে গিয়ে বেশ ঘুরলো কিন্তু কোনো গোলাম খুঁজে পেলো না।  অবশেষে শহরের দরোজায় দেখতে পেলো এক উলঙ্গ লোক প্রবেশ করছে আর বলছে: চাকর হতে চাই। গোলাম হতে চাই।

ছেলে ওই লোকটাকেই নিয়ে গেল বাড়িতে। বাবা উলঙ্গ লোকটাকে দেখেই বললো: এ কী করেছো! একটা উলঙ্গকে ধরে নিয়ে এসেছো কেন?

ছেলে বললো: বাবা! সারাটা দিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো গোলাম কিনতে পাই নি। এই লোকটা নিজ থেকেই ‘গোলাম হতে চাই’ বলে বেড়াচ্ছিল। আমিও ভাবলাম কাউকে যেহেতু পেলামই না, একেই নিয়ে যাই। ব্যস, নিয়ে এলাম’।

ব্যবসায়ী উলঙ্গ লোকটাকে জামা কাপড় দিলো পরার জন্য। তার নাম-ঠিকানা জানতে চাইলো। লোকটা বললো তার নাম ‘ফারামার্‌য’। ব্যবসায়ী তাকে বললো পরদিন সকালে বাণিজ্য যাত্রার জন্য মালামাল গোছগাছ করে রাখতে, নাস্তা প্রস্তুত করতে এবং সূর্য ওফার সাথে সাথে রওনা হয়ে দিতে।

এরপর কী হলো-তা জানতে আমাদের সাথে থাকতে হবে পরবর্তী আসরেও। যারা সঙ্গে ছিলেন সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!