এক বিষন্ন বিকেলে

বাটালি হিলের সব থেকে উঁচুতে টাওয়ারের কাছে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে এই মুহুর্তে কেউ নেই। থাকলেও সে দেখতে পেত কিনা সন্দেহ। এখন কোনো কিছু দেখার মত অবস্থায় আসলে সে নেই। কিছুক্ষণ পর যে জীবনটাকে সে শেষ করে দিতে যাচ্ছে, সেই দেহের ভিতরের ‘কোনো কিছু দেখে’ বা উপলব্ধি করে যে অর্গানটি, সেটা এই মুহুর্তে ভীষণ ডিস্টার্বড… বড় বেশী এলোমেলো! সুইসাইডের অনেক পথ থাকলেও এই উপর থেকে পড়েই থেতলানো মৃত্যু তার কাছে সহজ মনে হয়েছে। সহজ? মৃত্যুকে যেন সে কত অনুভব করেছে! তবে ইদানিং এতোটা নীচে সে নেমে গেছে যে, শেষ যাত্রাটা সে অনেক উপর থেকে শুরু করতে চায়। একটা প্রচন্ড গতি যেন সব কিছুকে শেষ করে দেয়। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর কয়েক পা এগোলেই এই জীবনের সমাপ্তি। শেষবারের মতো এতো উপর থেকে ওর প্রিয় শহরটিকে দেখে। আহ! কত সুন্দর এই শহর। এখান থেকে পুরো চট্টগ্রামকে দেখা যায়। ওর শহর… যেখানে মিজানকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে… কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, আনন্দঘন মুহুর্ত!! আর এরপরে বিষাদের এক ঝড়ো হাওয়া আজ ওকে এই পাহাড়চূড়ায় টেনে এনেছে সব খেলা শেষ করে বাড়ী ফেরার জন্য। তবে এর জন্য যে সে নিজেই দায়ী। এটা বুঝতে পারছে বলেই এতো সহজে সব কিছু মেনে নিয়েছে রুনা।

নাফিসের সাথে বেশ ঘটা করেই রুনার বিয়েটা হয়েছিল। ওদের বন্ধু সার্কেলেই ছিল নাফিস। অবশ্য পড়ালেখাটা একসাথে করেনি অন্যদের মত। সে ছিল আলাদা। চিটাগং কলেজের। আর রুনার সকল বান্ধবীরা নাসিরাবাদ উওমেন কলেজের। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মিজানের সাথে পরিচয়ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিচয়… বন্ধুত্ত এবং এই দুটোর গন্ডী ছাড়িয়ে আরো অনেক কিছুই ছিল মিজানের সাথে। জীবনের অনেক ‘প্রথম কিছু’ রুনা মিজানের সাথে শেয়ার করেছে। হৃদয়ের সাথে সাথে শরীরের লেনদেনও হয়েছে দুজনের ইচ্ছেতেই। সেখানে তখন মনের সায়টাই ছিল বেশী। সবকিছুই ঠিকমত চলছিল। অন্য সবার মত নাফিসও রুনা-মিজানের প্রেমের কথা জানত। বন্ধুদের আড্ডায় সেও থাকত। তখন তো ওর ভিতরে রুনা কোনোরকম ইর্ষা বা অন্য ধরণের গোপন ইঙ্গিত দেখতে পায়নি।

তবে রুনার আব্বার স্ট্রোক এর পরে তিনি একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এর ভিতরে রুনা ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে একটি বেসরকারী সংস্থায় জয়েন করেছে। কিন্তু মিজান তখনো পর্যন্ত কোনো জব যোগাড় করতে পারেনি। সেদিক থেকে নাফিস ওদের পারিবারিক ব্যবসাটা সেই চিটাগং কলেজ থেকে মাস্টার্স করার পর দেখে আসছিল। রুনারা সেসন জটে আটকে থেকে চার বছরের কোর্স আট বছরে শেষ করে যখন বের হল, নাফিস তখন একজন সফল বিজনেসম্যান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিন পারিবারিকভাবেই রুনা ও নাফিসের বিয়েটা হয়ে গেলো। মিজান শুধু বুকে কষ্ট নিয়ে বন্ধু হিসাবে ওর বিয়েতে অন্যদের সাথে এলো… হাসি-ঠাট্টার ভিতর দিয়ে নিজের কষ্টকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে রইলো। তবে সবাই বুঝতে পারলেও এটা এমন এক বাস্তবতা যে কারো কিছু করার ছিল না। মিজানের চোখের সামনে দিয়ে রুনা নাফিসের হাত ধরে নতুন জীবনে প্রবেশ করল। কষ্ট কি রুনার ও কম হয়েছিল সেদিন? কিন্তু ওর আব্বার কথা চিন্তা করে সে নিশ্চুপ থেকেছিল। বিয়ের দিনেও… কথা পাকা হবার সময়গুলোতেও। না হলে সে ইচ্ছে করলে মিজানকে নিয়ে কোর্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু বাবা-মেয়ে এবং প্রেমিক-প্রেমিকা’র ভিতরের ভালবাসাটা নিক্তির বিচারে বাবা’র দিকে একটু বেশী হেলে পড়ায় সে নাফিসের সংসারকেই বেছে নিয়েছিল।

প্রায় আট বছর কাটিয়ে দিল নাফিসের সাথে। এই দীর্ঘ সময়টাতে নাফিস কখনো ওর আর মিজানের সম্পর্ক নিয়ে কোনো ধরণের কথাই বলেনি। না কোনো কঠাক্ষ কিংবা অনুযোগ। তবে রুনা এখন পর্যন্ত নাফিসকে মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারে নাই। একজন স্ত্রী হিসেবে নাফিসের যত না কাছে এসেছে, একজন দেহপসারিণীর ভূমিকাই বেশী নিয়েছে সে। একটু থেমে গেল রুনা এই চিন্তাটা মাথায় আসাতে। কেন এভাবে ভাবছে সে? এতোটা চিন্তার দৈন্যতা ওর ভিতরে কেন? হয়ত মনের মিল ওদের ভিতর ছিল না… ওদের না বলে ওর নিজের ছিল না। নাফিস কখনোই ওকে অবহেলা করে নাই। বরং সে ই নাফিসকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে। একজন পুরুষ যখন একই বিছানায় একজন যুবতির সাথে থাকে… আর সে যদি তার বউ হয়- কিভাবে জৈবিক দেনাপাওনা থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু রুনা অসংখ্য রাত নাফিসকে শরীর ভালো লাগছেনা কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ নাফিস এতোটাই ভদ্র যে ফিরে গেছে, কিন্তু ঠোটের কোনায় হাসিটাকে পর্যন্ত মলিন হতে দেয় নাই।

আর এই আট বছরে যে ক’বার ওদের ভিতরে কিছু হয়েছে, সেই উত্তাল সময়গুলোতে রুনার মন ও মগজে নাফিসের পরিবর্তে মিজানই বিরাজ করেছিল। মাথার উপর দিয়ে কর্কশ শব্দ করে একট নাম না জানা কি পাখী উড়ে গেল। রুনার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। বিকেলটাকে আরো মলিন মনে হচ্ছে এখন। একটু হাসে সে। এটাই ওর জীবনের শেষ বিকেল। সেটা আলোকোজ্জ্বল হলেই বা কি যায় আসে? আচ্ছা ফাঁসির আসামিকেও তো তার শেষ যে কোনো একটা ইচ্ছে পুরণ করার সুযোগ দেয়া হয়। তার নিজের কি কোনো শেষ ইচ্ছে আচ্ছে? এটা ভাবতেই একটা হাহাকার নতুন করে আবার ওকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।

ভার্চুয়াল

জীবনের অঙ্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *