এক ঠকের পাল্লায় তিন ঠক —জসিম উদ্দিন– তৃতীয় পর্ব

এদিকে বুড়ো খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ির পথে চলেছে। আর মনে মনে ভাবছে, সে বুড়িকে অবাক করে দেবে যে, দশ টাকায় সে কত বড় ছাগল কিনে এনেছে। বুড়ি তাকে সব সময় অকর্মা আর বোকা বলে গালি দেয়। এবার সে দেখিয়ে দেবে যে, সে কত বড় একটা কাজ করেছে। অল্প টাকা দিয়ে কত বড় ছাগল এনেছে। এমনি খুশি মনে সে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলেছে বাড়ির দিকে। ভাদু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল সেই বটগাছটার নিকট। জোলা তার নিকট এলে সে বলে উঠল, আরে ভাই তুমি শেয়ালের বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
বুড়ো একটু অবাক এবং রাগত স্বরে বলল, কি যা তা বলছ! এটা শেয়ালের বাচ্চা হতে যাবে কেন? এটা তো ছাগলের বাচ্চা। এইমাত্র দশ টাকা দিয়ে কিনে আনলাম।
– বুঝতে পেরেছি, কেউ তোমায় ছাগলের বাচ্চা বলে এই শেয়ালের বাচ্চা দিয়ে ঠকিয়েছে। তুমি এটা ছেরে দাও, নইলে কামড় দেওয়ার সুযোগ পেলেই কামড়ে দেবে।
– তার কথা শুনে জোলা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তবে টাকার মায়ায় এবং বুড়ির ভয়ে সে ছাগল ছাড়ল না। তারপরও ভয়ে সে ছাগলের দরিটা একটু বড় করে ধরল এবং সাবধানে হাঁটতে লাগল। এবার মাঝ পথে আসতেই দেখা হল যদুর সাথে। যদু তাকে দেখে বলল আরে ভাই, তুমি দিনে দুপুরে শেয়ালের গলায় দরি লাগিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তার কথা শুনে বুড়ো এবার ঘাবরে গেল। সে ছাগলের দরিটা আরোও লম্বা করে ধরল, তবুও ছাড়ল না। সে ভাবতে লাগল আমাকে কি সত্যিই ঠকিয়েছে নাকি? যদি এটা শেয়ালের বাচ্চা নাই হবে তাহলে যেই দেখছে সেই কেন এটাকে শেয়ালের বাচ্চা বলছে? ভয় পেয়ে সে ছাগলের দরির একদম শেষপ্রান্তে ধরে হাঁটছে আর বার বার ফিরে তাকাচ্ছে কামড় দেয় কিনা?
এদিকে মধু তার বেশভূষা একটু পরিবর্তন করে প্রস্তুত হয়ে ছিল। জোলা তার নিকট ছাগল নিয়ে আসতেই সে লাফিয়ে উঠল। মধু ঘাবড়ে যাবার ভজ্ঞিতে চোখ মুখ সঙকুচিত করে বলল, আরে ভাই তুমি পাগল নাকি? একটা জলজ্যান্ত শেয়ালের গলায় দরি লাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছ!
বুড়ো অসহায় ভজ্ঞিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইরে যে দেখে সেই এটাকে শেয়াল বলছে। কিন্তু এটা যে আমি এক্ষনি হাট থেকে কিনে আনলাম। পুরো দশ টাকা দিয়ে আমি এই ছাগলটা কিনেছি।
মধু উত্তেজিত ভজ্ঞিতে বলল, আরে তুমি আহাম্মক নাকি? দশ টাকায় কেউ ছাগল পায়? এই বলে মধু আবার ছাগলটার দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ওরে বাবারে, যেভাবে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে মনে হয় এক্ষুনি ধরে খেয়ে ফেলবে। বুড়ো মধু ভাব দেখে ভয় পেয়ে ততক্ষনাৎ ছাগলের দরি ছেরে দিল। আর মনের দুঃখে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগল, হায়রে কি ঠকানোটাই না ঠকালো আমাকে। আমি বুড়ির কাছে গিয়ে কি বলল?
ছাগলটা ছাড়া পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর তিন ঠাক ভাদু, যদু আর মধু একত্রে হয়ে ছাগলটা ধরে ফেলল। এদিকে বুড়ো কিন্তু ছাগলের দরি ছেড়ে দিয়ে, বুড়ির ভয়ে বাড়ি ফিরে যায় নি। সে দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাগলটাকে দেখছিল। আর মনে মনে ভাবছিল এটা যদি সত্যিই শেয়াল হয় তাহলে তো জজ্ঞলে চলে যাবে। আর ছাগল হলে জজ্ঞলে যাবে না। দুরে দাঁড়িয়ে সে এইসব ভাবছিল। তখনই দেখল যে, তিনটা লোক ছাগলটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর সংগে সংগেই সে মধুকে চিনে ফেলল। এদের তিনজনই ছাগলের বাচ্চাকে শেয়ালের বাচ্চা বলেছিল। তৎক্ষনাৎ সে বুঝে ফেলল যে, ওরা তিনজনেই তাকে ঠকিয়েছে। বুড়ো কিন্তু এবার আর বোকামি করল না, সে চুপি চুপি পেছন পেছন গিয়ে তাদের বাড়ি চিনে এল।
বুড়োকে অমন শুকনো মুখে আসতে দেখেই বুড়ি অনুমান করল যে, সে বোধহয় আবার ঠকেছে। সে জিঙ্গেস করল, কি হয়েছে, ছাগল কই?
বুড়ো শুধু একবার বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা হেট করে বসে পরল। বুড়ি এবার ধমকের সুরে বলল, কি হয়েছে, বলবে তো।
বুড়ো কাচুমাচু হয়ে ভাঙা গলায় সবিস্তারে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল। বুড়োর সকল ঘটনা শুনে বুড়ি একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারন করে বলল, আমি কি সাধে তোমায় হাদারাম বলি। কোনটা ছাগলের বাচ্চা আর কোনটা শেয়ালের বাচ্চা তাও তুমি চেন না। কিন্তু আমি আমার টাকা উসুল করেই ছাড়ব।
– কিভাবে? আমি কিন্তু আর তাদের কাছে যাব না। বুড়ো ভয়ে ভয়ে বলল।
– তোমাকে দিয়ে যে কোন কাজ হবে না, তা আমি ভাল করেই জানি। আমি আমার বাবার দেশের বাড়ি যাব।
– সেখানে গিয়ে কি হবে? খুব উৎসুক হয়ে বুড়ো জানতে চাইল। বুড়ি বলল, সেখানে আমার এক দূর সম্পের্কর ভাই আছে। সেও এক নম্বরের ঠক। তার কাছে এরা কিছুই না। আমি তাকে গিয়ে বলল সব ঘটনা।
পরদিনই বুড়ি রওয়ানা হয়ে গেল তার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তারপর সেই ঠকের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে খুলে বলল সব ঘটনা। সব শুনে ঠক বলল, বেশ আমি তাদের কাছ থেকে তোমার টাকা আদায় করে দেব। কিন্তু ঐ দশ টাকার পর যত কামাই হবে সব আমার। বুড়ি সাঁয় দিয়ে বলল, আমাদের ঐ দশটা টাকা পেলেই হল।
– বেশ তোমার জোলাকে কাল আমার এখানে পাঠিয়ে দিও। তারপর যা করার আমিই করব।
– ঠিক আছে, আমি কালকেই বুড়োকে পাঠিয়ে দেব। এই বলে বুড়ি বাড়ি ফিরে এল। পরদিন বুড়ো এলে ঠক বলল, তুমি কি কোন জায়গা হতে একটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারবে?
– বুড়ো বলল, ঘোড়া আমি কোথায় পাব।? তবে হ্যাঁ নবাব বাড়িতে অনেক ঘোড়া আছে। কিন্তু তা তো আমি এমনি এমনি আনতে পারব না। ঠক বলল, তুমি এই পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে যাও। দেখ তাতে কোন ঘোড়া টোরা পাওয়া যায় কি না। বুড়ো পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে নবাব বাড়িতে গেল। সেখান থেকে একটা টিংটিঙে এক পাঁ খোরা একটা ঘোড়া নিয়ে এল। ঠক বলল, এটাই আমাদের চলবে। বুড়ো জানতে চাইল যে, এই ঘোড়া দিয়ে কি হবে। ঠক বলল, শোন আমি একজন দরবেশের সাজ পরব আর তুমি হবে আমার সাগরেদ। তারপর আমরা দরবেশ সাগরেদ এর বেশ ধরে তাদের গ্রামে যাব। তারপর সেখানে গেলেই তুমি সব বুঝতে পারবে।

গল্পের চতুর্থ পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!