এক ঠকের পাল্লায় তিন ঠক —জসিম উদ্দিন– প্রথম পর্ব

সে অনেক দিন আগের কথা। সে কালে জাত বলে একটা প্রথা ছিল। আজকাল আর সেই প্রথা লক্ষ্য করা যায় না। সবার পোশাক-আসাক, কথা-বার্তা, চাল-চলন এক হয়ে গেছে। বাইরের চেহারা দেখে বোঝাই মুসকিল যে, কে কোন জাতের মানুষ! এমন কি, নামের দারাও জাত নির্ণয় করা এখন দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন আমরা নিচু জাত বলে কাউকে অবজ্ঞা করি না। আসলে এটা আমাদের শিক্ষার ফল। শিক্ষার দ্বারা আমরা বুঝতে পেরেছি যে, কোন মানুষই ছোট নয়। সকল মানুষই চেষ্টা এবঙ পরিশ্রমের দ্বারা সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু পূর্বে এরকমটা ছিল না। সবার মাঝে জাতের পার্থক্য ছিল। কেউ ছিল উচু জাতের কেউ বা আবার নিচু জাতের। কোন জাতের লোক ছিল বোকা আবার কোন জাতের লোকেরা ছিল খুবই বুদ্ধিমান। তেমনি নিচু  কমবুদ্ধি গোছের লোক লোক হিসেবে গণনা করা হতো জোলাদের। সবার মধ্যে তাদেরকেই সবাই বেশি বোকা বলে জানত।

বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এক জোলা পাড়া ছিল। সে পাড়ায় এক বুড়ো আর বুড়ি, মানে জোলা আর জুলি বাস করত। তাদের কোন ছেলে পুলে ছিল না। বুড়ো সারাদিন ক্ষেতে কাজ করত। আর জুলি বুড়ি ঘর-গৃহস্থালির কাজ কর্ম করত। জুলি বাড়ির পেছনে একটা সবজির বাগান করেছিল। লাউ, কুমড়া, ছীম, ডাটা ইত্যাদি জাতীয় সবজি ছিল তার বাগানে। বুড়ি একদিন লক্ষ্য করল তার লাউ গাছটায় একটা কুড়ি ফুটেছে। ক্রমে সেই লাউয়ের কুরিটা একটা ছোট লাউয়ের রূপ ধরতে আরম্ভ করল। পরদিন থেকে বুড়ি সেই গাছটার খুব যত্ন নিতে আরম্ভ করল।বুড়ির যত্নের ফলে লাউটা খুব শীঘ্রই বড় হয়ে উঠল। একদিন বুড়ি তার বুড়োকে ডেকে বলল, দেখ, আমার লাগানো লাউ গাছটায় কত বড় একটা লাউ ধরেছে। বুড়ো লাউটা দেখে খুব খুশি হয়ে বলল, বা, বেশ বেশ! খুব বড় তো! আমি আজই হাটে গিয়ে মসলাপাতি কিনে আনব। আর সেটা মজা করে রান্না করে খাব।

বুড়ি বলল, না আমরা এটা খাব না।

বুড়ো একটু হতবাগ ভঙ্গিতে বলল, খাবে না? তা কি করবে শুনি?

বুড়ি বলল, লাউটা তুমি বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করগে। তুমি তো জানো আমার ছাগল পালার কত সখ। কিন্তু আমাদের হাতে টাকা পয়সা না থাকায় আমরা ছাগলের বাচ্চা কিনতে পারছি না। আমার এই লাউটা বেশ বড় হয়েছে, এটা বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তুমি সেই টাকা দিয়ে একটি ছাগলের ছাগল কিনে আনবে। বুড়ো মুখ ভ্যাঙচিয়ে বলল, ছাগল কিনে আনব? কোথায় লাউটা রান্না করে মজা করে খাব, তা নয়, উনি বলেন এটা বিক্রি করে ছাগল কিনে আনব।

বুড়ি একটু রাগত স্বরে বলল, আমি যা বলছি তাই কর।

বুড়ো বলল, তা ছাগল কিনে এনে লাভটা কি বল? উল্টো ওটাতে আরো কাজ বাড়িয়ে দেবে। প্রতিদিন তাকে ঘাস এনে খাওয়াতে হবে। তারপর আবার মল-মূত্র ত্যাগ করে সারা বাড়ি নোংড়া করে দিবে।

বুড়ি বলল, আসলে তুমি জোলা তো জোলাই রয়ে গেলে। তুমি শুধু ছাগলের অপকারটাই দেখলে। ছাগল যে আমাদের বড়লোক করে দিতে পারে তা আর তুমি বুঝতে পারলে না। বুড়ো এবার তার গলার স্বর সপ্তমে চরিয়ে বলল, এ্যা, আমার বাপ-দাদার বংশ তুলে কথা! পরক্ষনেই সে শান্ত হয়ে বলল, তা ছাগল আমাদের কি করে বড়লোক করবে শুনি?

বুড়ি বলল, তাহলে শোন, আমরা এটা ছাগল কেনার পর তা থেকে বাচ্চা হবে। সেই বাচ্চা বিক্রি করে আমরা একটা গরুর বাচ্চা কিনব। তখন গরু বড় হয়ে আমাদের দুধ দিবে আর বাচ্চাও দিবে। তখন আমরা বাচ্চাগুলো আর দুধ বিক্রি করে অনেক টাকা পাব। এভাবে আমাদের অনেক টাকা পয়সা এবং অনেক গরু ছাগল হয়ে যাবে। তখন আমাদের আর কোন দুঃখ থাকবে না।

বুড়ো বুড়ির কথা শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, তোমার মাথায় এত বুদ্ধি! আমি আজই যাব হাটে। কুমরোটা বিক্রি করে একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসব। এরপর সে বুড়িকে বলল, দাও তো, এক্ষনি লাউটা পেড়ে দাও। আমি সেটা হাটে নিয়ে যায়।

বুড়ি তখন বটি দিয়ে লাউয়ের ডগা কেটে নিয়ে এল। বুড়ো লাউটা কাঁধে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল হাটে। এদিকে বুড়ি ছাগল রাখার জন্য সব ব্যবস্থা করতে লাগল। ছাগলের ঘাস কাটার জন্য সে একটা কাস্তেও যোগার করল। তারপর, ছাগলের বাচ্চা বড় করে, তার বাচ্চা বিক্রি করে কি কি করবে, উঠোনের এক কোনে বসে সে তা ভাবতে লাগল।

গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!