সাদা পায়জামা, পায়েঁর গোড়ালি পর্যন্ত জুব্বা, মাথায় পাগড়ি এবং মুখে ইয়া লম্বা সাদা দাড়ি লাগিয়ে ঠক, পীরবাবা সাজল। আর ছেঁড়া-টেরা কাপড় দিয়ে একটি পুটিলি বানিয়ে বুড়ো কাধেঁ লটকিয়ে দিল। তারপর ঠক পীরবাবা ঘোড়ায় চেপে বসল আর জোলাকে বলল, তুমি ঘোড়ার মুখের লাগাম ধরে টেনে টেনে নিয়ে চল। এখন তাকে দেখে বোঝাই মুশকিল যে সে আসল পীর নয়। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা সেই তিন ঠকের গ্রামে এসে পৌঁছল। ভাদু যদু আর মধু পথের ধারেই একটা গাছের নিচে বসে আলাপ করছিল। বুড়ো দূর থেকে দেখেই তাদের চিনতে পারল। সে ঠককে বলল, ঐ যে যারা তিন জন বসে গল্প করছে তারাই আমায় ঠকিয়েছে। ঠক বলল আচ্ছা তুমি আমাকে তাদের সামনে দিয়ে নিয়ে চল।
ওরা গল্প করতে করতে দেখতে পেল যে, একজন কামিল পীরসাহেব এদিকে আসছে। তাকে দেখে ভাদু বলল, এই দেখ, একজন পীরসাহেব আসছে এই রাস্তা দিয়ে। উনার চাঁদমুখখানা দেখেই আমার পরকালের কথা মনে পড়ে গেল। আমরা তো জীবন ভর মানুষকে ঠকিয়েই খেলাম। এখন পীরসাহেব স্বয়ং আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, চল আমরা তার কাছে মুরিদ হই। তওবা পড়ে সব পাপ মোচন করি।
যদু বলল, তুই ঠিকই বলছিস রে। আল্লাহ বোধহয় আমাদের ভাল করার জন্যই উনাকে পাঠিয়েছেন। মধু বলল, তুই ঠিকই বলেছিস। আমারো তাই মনে হয়। তবে চল আমরা তিন জনই তার কাছে তওবা করে মুরীদ হয়ে যায়। এই বলে তারা তিন জনই পীরবাবার ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মধু বলল, বাবা আপনাকে দেখেই আমরা বুঝতে পেরেছি আপনি একজন কামেল দরবেশ। বাবা আমরা অনেক পাপ কাজ করেছি এ জীবনে। আজ আপনার কাছে তওবা পড়ে আমরা আপনার মুরীদ হব বাবা। আজ রাতে আপনি আমাদের বাড়িতে দাওয়াত গ্রহন করুন বাবা।
ভাদুও তার সাথে যোগ করল, হ্যাঁ বাবা আপনাকে দেখার পরই আমাদের মনের পরিবর্তণ হয়েছে। আজ রাতে আপনি দয়া করে আমাদের বাড়ীতে তাসরীপ গ্রহণ করুন।
পীরবাবা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, তা বাবারা আমাদেরকে যে অনেক দূরে যেতে হবে। তা তোমরা যখন এত করে বলছ, তবে চল, আজ রাতটা না হয় তোমাদের এখানেই থাকি।
তারা তিনজন খুব খুশি হয়ে পীর বাবাকে নিয়ে এলে তাদের বাড়িতে। খুব যত্ন করে ভাল ভাল খাবার খাওয়ালো তারা পীরবাবাকে। আবার রাতে ঘুমানোর জন্য পীর বাবার জন্য একটা ঘরে সুন্দর করে বিছানা তৈরি করা হল। সব ঠিক হয়ে গেলে পীরবাবা বললেন, আমার ঘোড়াটা কোথায় থাকবে?
– কেন বাবা, সেটা গোয়াল ঘরে রেখে আসব।
– সংগে সংগে পীরবাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, হেক মওলা বলে। চোখ দুটো সে লাল করে বলল, না এই ঘোড়া আমার সাথেই থাকবে। এটা যেমন তেমন ঘোড়া নয়।
তারা তিন জনই একটু ভয় পেয়ে গেল। মধু ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা বেয়াদবী নিবে না। আমরা না জেনে ও কথা বলেছি। ঘোড়াও আপনার সাথেই থাকবে। তা বাবা এ ঘোড়ার বিশেষত্ব কি? না মানে জানতে চাচ্ছিলাম যে সাধারণ ঘোড়া থেকে এ ঘোড়া আলাদা কেন তাই জানতে চাচ্ছিলাম আর কি।
পীরবাবা তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, আছে বৈকি! এ ঘোড়ার আশ্চর্য এক ক্ষমতা আছে।
তারা তিনজনই খুব উৎসুখভাবে জানতে চাইল কি ক্ষমতা বাবা? আমাদের বলবেন কি?
পীর সাহেব বললেন, তোমরা আমার কাছে মুরীদ হয়েছ। তোমরা আমার ছেলের মতো। তোমাদের আমি অবশ্যই বলল সে কথা। শোন তবে, আমার এ ঘোড়া অন্য সব সাধারণ ঘোড়ার মত নয় এর একটা অসাধারণ ক্ষমতা আছে। আর তা হল, এই ঘোড়া প্রতিদিন সকালে দুটি করে কাঁচা পয়সা দেয়। মধু আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল কিভাবে বাবা?
পীরসাহেব বললেন, সে প্রতিদিন তার মলের সাথে দুটি করে টাকা দেয়।
পীর সাহেবের কথা শুনে তারা তিনজনই তো অবাক। যদু বলল, এটা কি করে সম্ভব? একটি ঘোড়া তার মলের সাথে প্রতিদিন দুইটা করে কাঁচা পয়সা দিবে। এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। ভাদু তার কথা শুনে বলল, পীর বাবার কথা কখনো অবিশ্বাস করতে নেই, তাহলে পাপ হয়। মধু বলল, আচ্ছা আমরা সকালে চুপি চুপি দেখব যে ঘোড়া সত্যি সত্যি কাঁচা পয়সা দেয় কিনা।
এদিকে ঠক পীরবাবা রাতে তার ঘোড়াকে খাওয়ানোর সময় ঘাসের সাথে দুটি কাঁচা পয়সা খাইয়ে দিল। তারপর ভোর হতেই পীরবাবা জোলাকে বলল, তুমি একটি পায়লা নিয়ে ঘোড়ার মলগুলো নিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে ধুয়ে আন। আর চুপি চুপি সে জোলাকে বলল, আমি কিন্তু জানি যে ওরা লুকিয়ে আমাদের এই ঘোড়ার কাঁচা পয়সা পাওয়ার ব্যবাপারটা দেখবে। তুমি মল পরিস্কার করার সময় পয়সাগুলি ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে আর ধোয়ার সময় বেশি করে বাজাবে। জোলা তার কথা মতো পায়লায় করে ঘোড়ার মল তুলে নিয়ে চলল পুকুর ঘাটে।
এদিকে তারা তিনজনই কিন্তু উত্তেজনায় সারারাত ঘুমালো না। ভোর হবার আগ হতেই তারা জেগে বসে ছিল। যেই তারা দেখল যে, পীরবাবার সাগরেদ ঘোড়ার মল নিয়ে যাচ্ছে তখনি তারা চুপি চুপি তার পেছন পেছন চলল। বুড়ো পুকুর ঘাটে নেমে গেলে তারা পাড়ের কাছে লুকিয়ে সব দেখতে লাগল। বুড়ো তখন ঘোড়ার মল ধোয়ার সময় দেখতে পেল দুটি কাঁচা পয়সা। পয়তা তো থাকারই কথা। কারণ কাঁচা পয়সা তো আর হজম হয় না। বুড়ো তখন পয়সা দুটো তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে খুব ভাল করে ধুতে লাগল। ঘোড়ার মলের ভিতর পয়সা দেখে তাদের সকলেরই চক্ষু স্থির। অতি বিস্ময়ের সাথে তারা একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। ভাদু বলল, দেখলি তো, পীরবাবা সত্যিই একজন খাটিঁ পীর। তা না হলে, একটা সামান্য ঘোড়া কিভাবে দুটি করে কাঁচা পয়সা দিতে পারে!
মধু বলল, আচ্ছা ভাদু-যদু, আমরা যদি কোন রকমে পীর বাবার এই ঘোড়াটা রাখতে পারি, তাহলে আর আমাদের কোন অভাব থাকবে না, আর আমাদের কোন কাজও করতে হবে না।
– তা তুই ঠিকই বলেছিস। এই ঘোড়াটি যদি আমরা রাখতে পারি, তাহলে আমাদের আর মানুষকে ঠকিয়ে খেতে হবে না। কিন্তু পীর বাবা কি ঘোড়াটা আমাদের দেবেন? মধু বলল, আমরা যদি অনেক আকুতি মিনতি করি তবে তিনি অবশ্যই দিবেন। আর উনি যত দামই চাইবেন আমরা তত দামই দিব।
– বেশ তবে চল, আমরা তিন জনই তবে পীরবাবার কাছে গিয়ে বলি। এই বলে তারা তিনজনই পীরবাবার নিকটে গিয়ে বিনয়ে সাথে বলল, বাবা আপনার কাছে আমাদের একটি আরজি আছে।
– পীর সাহেব বললেন, তোমরা আমার ছেলের মতো। তোমরা যে কোন আরজি আমার কাছে করতে পার। এই বলে পীর সাহেব মনে মনে বলতে লাগলেন আমি তো জানিই তোমরা কি বলবে।
মধু বলল, বাবা আপনি তো চলেই যাবেন তো আপনার স্মৃতি স্বরূপ আপনার এই ঘোড়াটা আমাদেরকে দিয়ে যান। বিনিময়ে যদি টাকা পয়সা লাগলে আমরা তাও দিব। বাবা আপনি না করবেন না। সবাই একসাথে বাবার নিকট জোরহাত করে বলতে লাগল।
পীর বাবা মুখটা একটু গম্ভীর করে বললেন, আমার এই ঘোড়াটা যে একটি অসাধারন ঘোড়া তা তো তোমাদের আগেই বলেছি। এই ঘোড়া একটি অমূল্য ঘোড়া। দশ হাজার টাকা দিলেও এর উচিৎ মূল্য হবে না। তবে তোমরা যেহেতু এত করে বলছ তবে আমি তোমাদের এই ঘোড়া দিয়ে দিলাম। তবে হয়েছে কি আমি তো দরবেশ মানুষ দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায় সে জন্য একটি ঘোড়া আমার সব সময়ই লাগে।
মধু তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, বাবা এই একটির বদলে দুইটি ঘোড়া কিনার সমান দাম দিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তারা তিনজন মিলে হাজার দশেক টাকা যোগাড় করে পীর বাবাকে দিল। পীর বাবা মনে মনে মহাখুশি হয়ে তাদেরকে ঘোড়া দিয়ে দিলেন। আসার সময় পীরবাবা তাদেরকে তার বাড়ির ঠিকানাও দিয়ে দিলেন আর বললেন, যদি তোমাদের কোন প্রশ্ন থাকে তবে অবশ্যই আমার কাছে আসবে। এই বলে ঠক জোলাকে সাথে নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
পথে জোলা ঠককে জিঙ্গেস করল, আচ্ছা আপনি ওদেরকে আপনার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আসলেন কেন? যখন দেখবে যে ঘোড়ার পেট হতে পয়সা বের হয় না তখন তো তারা আপনাকে মারতে আসবে। ঠক মুচকি হেসে বলল, সে ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার দশ টাকার বদলে বিশ টাকা নিয় বাড়ি চলে যাও। জোলা এত কিছু না বুঝে বিশ টাকা পেয়ে খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেল।
ওদিকে ভাদু, মধু আর যদুর সে কি আনন্দ। তারা একে অপরকে বলতে লাগল। আমরা জীবনে এই প্রথম একটা কাজের মতো কাজ করেছি। ভাদু বলল, আমাদের আর কোন চিন্তা নেই। ঘোড়া প্রতিদিন সকালে পয়সা দিবে। আমরা এখন টাকার খনি পেয়ে গেছি। তারা তিনজনই সারাদিন ঘোড়ার খুব যত্ন করল। ভাল ভাল ঘাস বাছাই করে ঘোড়াকে খুব করে খাওয়ালো। রাতের বেলা তারা ঘোড়াকে তাদের শোবার ঘরেই রাখল। তাও আবার সুন্দর বিছানা করে। তিনজনই ঘোড়ার পাশে বসেই রাত কাটিয়ে দিল। ভোর হতেই তারা অপেক্ষা করতে লাগল কখন ঘোড়া মল দেবে। সারাদিন খুব খাওয়ার পর ঘোড়া সকালে অনেক বেশি মল ত্যাগ করল। তিনজন মিলে দুইটি পায়লাতে করে সেই মল নিয়ে নাচতে নাচতে গেল পুকুর ঘাটে। মহা উৎসাহের সহিত তারা মল ধুতে লাগল। কিন্তু এ কি মল ধুতে ধুতে তো প্রায় শেষ হয়ে এল কিন্তু পয়সা কোথায়! দু পায়লা মলের সব ধুয়ে শেষ হয়ে যাবার পরও যখন পয়সা পেল না তখন তারা সকলেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। মধু বলল, আচ্ছা আমরা কি কোন ভুল করে ফেলেছি নাকি। যদু বলল নারে আমার মনে হয় পীরবাবা আমাদেরকে ঠকিয়েছে। মধু বলল চল আমরা এখনি পীর বাবার কাছে যাব। এই বলে তখনই তারা তিনজন রওয়ানা হয়ে গেল পীর বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
গল্পের পঞ্চম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।