এক জীবনের অপেক্ষায়…

অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে দুধটা গরম হয়ে এসেছে। ফুটে উঠবে আরেকটু পরেই। দুধের স্তরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, সরের আস্তরণ কুঁচকে যাচ্ছে। গ্যাসটা বাড়িয়ে দিলেই ফুলে উঠবে। রাগ হলে ঠিক এইরকমই হয়। চেপে রেখে রেখে, গুমরে গুমরে থেকে একসময় ফুলে ফেঁপে উথলে বেরিয়ে আসে চিৎকার হয়ে। বেরতে বেরতে একসময় ফুরিয়ে যায়। কমতে কমতে ছেড়ে যায় শরীরের কানাচ।

রাগটা বেরিয়ে যাবার পর খুব ক্লান্ত লাগে দেবযানী’র। একটু বসে জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। আজকাল অবশ রাগের উপশম একটা খুঁজে দিয়েছে টুয়েলভে পড়া ছেলে। ক্যান্ডি ক্রাশ। টাচ স্ক্রীনে আঙুল চালিয়ে নানা রঙের নানা আকৃতির ক্যান্ডি খচমচ করে ক্রাশ করে যান দেবযানী। একসঙ্গে তিনটের বেশি ক্যান্ডি ভাঙতে পারলেই টুংটাং বাজনার মধ্যে লেখা ভেসে ওঠে ‘ডেলিশিয়াস’। পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠে ‘টেস্টি’। একের পর এক লেভেল ক্রস করে গেলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, আনন্দ, উল্লাস হয়। রান্না ভালো হলে কিম্বা সিরিয়ালের দজ্জাল শ্বাশুড়ি প্রতিবাদী পুত্রবধূর হাতে শায়েস্তা হলেও তেমনটা আর হয় না আজকাল। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে হাতের কাজ সেরে গভীর রাত অবধি বসার ঘরের সোফায় বসে চলে ক্যান্ডি ভাঙার খেলা।

শোবার ঘরেই খেলত আগে। কিন্তু গেমের উজ্জ্বল আলোয় অস্বস্তি হয় কত্তার। অগত্যা বসার ঘরেই আসতে হয়। কিন্তু সব সময়ই যে ভালো দিন যায় তা না। এক একটা লেভেল এমন কঠিন হয়, পাঁচ মিনিটেই পাঁচখানা লাইফ শেষ হয়ে যায়। তখন আবার আধঘন্টার অপেক্ষা। আধঘন্টা পর পর একটামাত্র লাইফ বরাদ্দ। এই সময়ে খুব অস্থির লাগে। কোন কিছুতেই মন বসে না। মাইক্রোওয়েভের বাঁশি বেজে বেজে থেমে যায়, খেতে দিয়ে জল দিতে ভুলে হয়ে যায়। বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে আর কতক্ষণ বাকি আধঘন্টা হতে। ক্যান্ডি ক্রাশের লাইফ টাইমার পেছন দিকে হাঁটে। তিরিশ, উনতিরিশ, আঠাশ, সাতাশ হয়ে পিছিয়ে আসতে থাকে দেবযানীকে আরও একটা জীবন উপহার দেবে বলে। আরও একবার আঙুল দিয়ে ঠেকে ঠেলে লাল হলুদ কমলা বেগুনি ক্যান্ডি ভাঙার নির্মল সুযোগ করে দেবে বলে।

ছোট্ট রান্নাঘরে জ্বলন্ত গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে দুধের বাটির দিকে নজর রেখেছেন দেবযানী। যে কোনো মুহুর্তেই ফুটে উঠবে। ডান হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে এক রঙিন প্রান্তর, যার ওপরে বাঁদিকে একটা ঘড়ি পেছন দিকে হাঁটছে। সেকেন্ডের কাউণ্ট কমে আসছে দশ নয় আট সাত… যেকোনো মুহুর্তেই ফুটে উঠে উথলে যাবে বাটির দুধ। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ওপারেই দেবযানীর জন্য অপেক্ষা করছে একটা নিটোল তাজা জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…