আজ তিরিশে কার্তিক। অগ্রহায়ণ আসছে। বাংলাদেশের নবান্নের কাল। বাতাসে শীতের টান। ভোরবেলা পায়ের কাছের কাঁথাটা টেনে নিতে হয়। ফুটপাতে ঝরে পড়ে থাকা ভোরের শিউলিতে টলমল করে শিশিরবিন্দু। আদিগন্ত বিস্তৃত ধানখেতের সবুজে সোনালির আভাস।
গতকাল ১৩ নভেম্বর ছিল হ্ুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তিনি নেই, কিন্তু তিনি আছেন, এবং আছে তাঁর জন্মদিনের উৎসবও।
একবার আমরা হ্ুমায়ূন আহমেদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম নেত্রকোনায়। ঢাকা থেকে একটা মাইক্রোবাসে রওনা দিয়েছি। সঙ্গে বাংলা কথাসাহিত্যের এক প্রধান পুরুষ হাসান আজিজুল হক। নেত্রকোনায় পৌষমেলা হয়। সেখানেই তাঁরা সন্ধ্যাবেলায় সংবর্ধনা দিলেন তাঁদের এলাকার কৃতী সন্তান হ্ুমায়ূন আহমেদকে।
তারপর রাতে আমরা থেকে গেলাম নেত্রকোনা সার্কিট হাউসে। নৈশভোজের সময় হ্ুমায়ূন আহমেদ স্যার খুব তদারকি করছিলেন অতিথিদের, যেন কোনো অসুবিধা না হয়। এটা-ওটা গল্প হচ্ছে। আমি বললাম, স্যার, এবার আপনি তো খোঁজখবর নিচ্ছেন। গতবার কী হয়েছিল শুনুন।
স্যার আমাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খাচ্ছেন, গল্প করছেন আর গল্প শুনছেন।
আমি বলে চলেছি, গতবার সংবর্ধনা ছিল কবি হেলাল হাফিজ ভাইয়ের। ঢাকা থেকে এসেছিলাম আমি আর কবি ফরিদ কবির। দুপুর ১২টার দিকে মাইক্রোবাস ঢাকা থেকে আমাদের তুলে নিয়ে এল। সন্ধ্যার আগে আগে নেত্রকোনা পৌঁছালাম। হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান খুব ভালো হলো। কথা ছিল, অনুষ্ঠান শেষে রাত নয়টার দিকে আমাদের আবার একই মাইক্রোবাস ঢাকা নিয়ে আসবে। আমরা রাত একটা-দুইটার দিকে ঢাকা পৌঁছে যাব। কিন্তু রাতের বেলা আর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। কাজেই আমরা খুবই উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেলাম। বাসায় বলে এসেছি, রাতেই ফিরব। যাহোক, রাতের বেলা যথারীতি আমরা সার্কিট হাউসে রয়ে গেলাম। রাত ১২টার দিকে এলেন কবি ইয়াসিনুর রহমান। নেত্রকোনার ছেলে। জাতীয় কবিতা পরিষদ করেন। আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘যাত্রা হচ্ছে, দেখতে যাবেন নাকি।’ আমরা বললাম, চলো, খানিকক্ষণ দেখে আসি।
গেলাম সেই মাঠে। কিসের কী যাত্রা। আসলে বসেছে জুয়ার আসর। নানা ধরনের জুয়া খেলা চলছে। তবে জুয়ার শ্রেষ্ঠ যে জুয়া, সেটা এখনো শুরু হয়নি। সেটা হলো, একটা গোল বোর্ডে একটা তির ছুড়ে মারতে হবে। বোর্ডটা ঘুরবে। যে ঘরে যা লেখা আছে, সেই অনুযায়ী বাজির টাকা বাড়বে, বা হারাতে হবে। তো এটার উদ্বোধন করবেন এই জুয়ার আসরের আধিকারিক নিজে। তিনি একটা জলচৌকির ওপরে বসে আছেন চোখ বুজে। তাঁর সামনে ধূপধুনা জ্বলছে। পুরো জিনিসটার মধ্যে একটা রহস্য, একটা সম্ভ্রম জাগানোর চেষ্টা।
তারপর আওয়াজ উঠল হুঁশিয়ার। ক্লিয়ার ক্লিয়ার। পথ পরিষ্কার করতে দুই পাশে দাঁড়িয়েছে দশাসই প্রহরীরা। তারা বলছে, ক্লিয়ার ক্লিয়ার। আধিকারিক তখন তাঁর আসন ছেড়ে উঠলেন। চোখ প্রায় বন্ধ করেই গেলেন সেই জুয়ার ঘুরন্ত চাকতির সামনে। একটা তির তিনি ছুড়ে মারলেন ওই বোর্ডে। ব্যস, উদ্বোধন হয়ে গেল। তিনি আবার ক্লিয়ার ক্লিয়ার ধ্বনির মধ্যে তাঁর সেই চৌকিতে এসে বসলেন।
আমাদের মেজবান কবি ইয়াসিনুর রহমান গেলেন সেই আধিকারিকের কাছে। গিয়ে বললেন, ‘ঢাকা থেকে দুজন সাংবাদিক এসেছেন।’ সেই আধিকারিক তখন তাঁর গনগনে লাল চোখ দুটো মেললেন। বললেন, ‘ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছে, কত চায়’ বলে তিনি তাঁর জলচৌকির ওপরে বিছানো শতরঞ্জি তুললেন। তার নিচে শুধু টাকা আর টাকা। এক খাবলা টাকা তিনি মুঠোয় তুললেন। আমি আর ফরিদ কবির জিবে কামড় দিয়ে পালিয়ে এলাম।
পরের দিন ভোরবেলা। প্রথম বাসে আমরা ফিরব। ঘন কুয়াশা। অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমরা হাজির হলাম বাসস্ট্যান্ডে। ছয়টায় একটা বাস আছে। সেটাতেই উঠব। সেটা স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। তবে দেখি, বাসস্ট্যান্ডে কাঠের চুলার ওপরে টগবগ করে ফুটছে পানি আর তাতে চা-পাতা ছাড়া মাত্র চায়ের গন্ধে ওই এলাকাটা ম-ম করে উঠল। ফরিদ কবির ভাই বললেন, ‘পরের বাসটা ছয়টা ১৫ মিনিটে। চলো, চা খেয়ে পরের বাসে যাই।’ আমি বললাম, তথাস্তু।
আমরা চা খেয়ে দ্বিতীয় বাসে উঠলাম। কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে একটু ঘুম ঘুমও পেয়েছে। আধঘণ্টা পরে দেখি আমাদের বাস একটা জায়গায় থামল। কী ব্যাপার! আমাদের আগের বাসটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। কুয়াশার মধ্যে কিছু দেখতে না পেয়ে আগের বাসের চালক একটা ট্রাকের পেছনে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছেন। আর আমরা দেখতে পেলাম, ওই দুর্ঘটনাকবলিত বাস থেকে যাত্রীরা নামছে। তাদের প্রত্যেকের নাক কাটা। কারণ, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ধাক্কায় তাদের সবাই সামনের সিটের রডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। সবার নাক কেটে গেছে।
আমি বললাম, স্যার, এক কাপ চা সেদিন আমাদের নাক বাঁচিয়েছিল। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ স্যার হাসছেন না। তিনি হঠাৎ রেগে গেলেন। ‘গতবার কে এই আয়োজন করেছিল। কেন তোমাদের রাতের বেলা মাইক্রোবাস দেয়নি। কেন পরের দিন সকালে তোমাদের বাসে তুলে দিল।’ আমি যত বলি, স্যার, বাদ দিন, আমি এটা অভিযোগ হিসেবে বলিনি, হাসির গল্প হিসেবে বলেছি, স্যার তত রেগে যান, ‘না, আমি নেত্রকোনার মানুষ, নেত্রকোনার মানুষ খুবই অতিথিবৎসল। কারা নেত্রকোনার অতিথিদের যত্ন করেনি, এটা আমাকে বের করতেই হবে।’
আচ্ছা, হ্ুমায়ূন স্যারের প্রসঙ্গ থেকে সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে আসি। আমরা শুনেছিলাম, ওই জুয়ার আসর থেকে স্থানীয় প্রশাসনের দুই কর্তার কাছে রোজ যথাক্রমে পাঁচ হাজার ও তিন হাজার টাকা যায়। আর আমরা সাংবাদিক শুনেই জুয়ার আসরের মালিক প্রথমেই যা ভাবল, তা হলো, আমরা ওখানে গিয়েছি টাকা আদায় করতে। সে অনেক দিন আগের কথা। ১৮–১৯ বছর বোধ হয় পেরিয়েই গেল তারপর। সাংবাদিকদের সম্পর্কে কি এখনো মানুষের এই রকমই ধারণা?
আমার মনে হয়, দিন পাল্টাচ্ছে। সাংবাদিকেরা এখন বেতন ভালো পান। কেউ কেউ গাড়িও চড়েন। প্রথম আলোয় নৈতিকতার প্রশ্নে জিরো টলারেন্স। অভিযোগ পাওয়ামাত্র তদন্ত। অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলেই চাকরিচ্যুতি। তার প্রতিদানও মানুষ প্রথম আলোকে দিচ্ছে। রোজ প্রচারসংখ্যা বৃদ্ধি একটা প্রমাণ। কিন্তু তার চেয়েও বড় হলো মানুষের ভালোবাসা। এই তো সেদিন রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল বানিয়েছেন যিনি, ময়মনসিংহের জয়নাল আবেদীন, আমার হাত ধরে বলছিলেন, ‘কতজনেই তো আমারে নিয়া কত ভালো ভালো কথা লিখল, প্রথম আলোয় লেখা হইলে সারা দুনিয়া থেকে ফোন আসে, লোকে দেখতে আসে, সাহায্য দেয়, এইটা তো অন্য কেউ লেখলে হয় না। দোয়া করি ভাইজান…প্রাণ থেকে দোয়া করি।’
কার্তিকের সকালে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। রোদ এসেছে পড়েছে শিরীষগাছের চূড়ায়। কচি পাতা প্রথম পাতে, কী কথা কয় আলোর সাথে…
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।