এক আবেদের শেষ আবেদন
শায়েখ আবূ আমের (রঃ) বলেন, একবার আমি মসজিদে নববীতে বসা ছিলাম। এমন সময় এক হাবশী গোলাম এসে আমার হাতে একটি চিরকুট দিল। এতে লিখা ছিল-
ভাই! আল্লাহ্ পাক তোমাকে দ্বীনের ফিকিয়ে দৌলত নসীব করেছেন এবং যাবতীয় গাফলত ও অবহেলা হতে মুক্ত রেখে নির্জনে ইবাদত বন্দেগী করার তৌফিক দান করেছেন। আবূ আমের আমি তোমার একজন তরীকত পন্থী ভাই! আমি অধির আগ্রহে তোমার সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষা করছি। কিন্তু হায়! আমি যে অপারগ। তোমার সাক্ষাত এবং তোমার সাথে কথা বলার তীব্র বাসনা আমার অন্তরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। আমি তোমাকে আল্লাহ্র কসম দিচ্ছি, তোমার কদমবুছী হতে আমাকে বঞ্চিত করো না।
আবূ আমের বলেন, আমার প্রতি লেখকের অনুরাগ ও ভালবাসা দেখে পত্র বাহকের সাথেই আমি তার সাথে দেখা করতে যাত্রা করলাম। দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর আমরা কোবা শহরে পৌছার পর পত্রবাহক আমাকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে নিয়ে গেল। আমি ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, ঘর-দোর একেবারেই জীর্ন শীর্ণ। ঘরের এক কোণে এক অসুস্থ বৃদ্ধ কেবলামুখী হয়ে বসে আছেন। প্রথম দর্শনেই অনুমান করা যায় যে, দীর্ঘ যাতনায় তার দেহের সকল শক্তি সামর্থ্য নিঃশেষ হয়েছে। আমি নিকটে গিয়ে তাকে সালাম করার পর দেখলাম, তিনি একাধারে অন্ধ এবং অর্ধাঙ্গও বটে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি বললেন, আবূ আমের! আল্লাহ্ পাক তোমার অন্তরকে যাবতীয় পাপাচার হতে পবিত্র রেখেছেন। তোমার সাক্ষাত লাভ এবং তোমার মুখের পবিত্র মসীহত শোনার তীব্র আকাংখা আমার অন্তরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। আমার আত্মার এমন একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যে, কোন মানুষের নসীহত দ্বারাই এর কোন উপশম হচ্ছে না। অবশেষে আমি জানতে পারলাম, আমার আত্মার সেই জখম তোমার দ্বারাই দূর হতে পারে। অনুগ্রহ পূর্বক তুমি আমার আত্মার চিকিৎসা কর, তা যতই কঠিন ও তিক্ত হোক আমি তা সহ্য করতে পারব।
হজরত আবূ আমের বলেন, শায়খের বক্তব্য শুনে আমার অন্তরে ভাবান্তর সৃষ্টি হল। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আমি তাকে বললাম, হে শায়খ! কিছুক্ষণের জন্য আপনার অন্তরের চক্ষুকে আলমে মালাকুত বা ফেরেশতা জগত এবং জান্নাতের বাগানের দিকে নিবন্ধ করুন। তখন আল্লাহওয়ালাদের জন্য রক্ষিত জান্নাতের নেয়ামতসমূহ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। অতঃপর আপনি জাহান্নামের দিকে নজর দিলে দেখতে পাবেন, গুনাহাগারদের জন্য আল্লাহ্ পাক কত ভয়াবহ আজাবের ব্যবস্থা করেছেন। উভয় দৃশ্য দেখার পর আপনি পাপ ও পূণ্যের অনুভব করতে পারবেন।
আবূ আমের বলেন, আমার এ বক্তব্য শুনে সেই বৃদ্ধ দীর্ঘস্বাস ফেলে অনেকক্ষণ কান্না করার পর বললেন, আবূ আমের! আমি আল্লাহ্র শপথ করে বলছি তোমার চিকিৎসায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভ করেছি। আল্লাহ্ পাক তোমার উপর রহমত বর্ষণ করুন।
অতঃপর আমি বললাম, হে শায়খ । আল্লাহ্ পাক সকল অবস্থায় আপনপর জাহের বাতেন দেখছেন। আপনপর গোপন কার্যকলাপও তিনি দেখতে পান। একথা শুনেই তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, এমন কে আছে যে, আমার দারিদ্রতা নিবারণ করতে পারবে? হে আল্লাহ্! আপনিই আমার সকল হাজত পূরণ করতে পারেন। আর আপনিই একমাত্র ক্ষমাকারী। একথা বলার সাথে সাথে তিনি মাঠিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন।
বৃদ্ধ প্রাণ ত্যাগ করার পর এক যুবতী মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির পরনে একটি পশমী জুব্বা ও মাথায় ছিল একটি উড়নী। কপালে সিজদার চিহ্ন ছিল সুস্পষ্ট। সে আমাকে বলল, যে আল্লাহ্র ওলী! আপনি বড় ভালকার্য্য করেছেন, আল্লাহ্ পাকের নিকট এর বিনিময় লাভ করবেন। মৃত শায়েখ আমার পিতা, দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ এ অবস্থায় নামায পড়তে পড়তে অর্ধাঙ্গ হয়ে গেছেন, আর কাঁদতে কাঁদতে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন। কতকাল যাবৎ তিনি আপনার সাক্ষাত পাবার জন্য আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করেছেন। তিনি বলতেন, একবার আমার সুযোগ হয়েছিল আবূ আমেরের মসলিশে উপস্থিত হওয়ার। তার বয়ান শুনে আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়, যদি জীবনে আবার তার সাক্ষাৎ পেতাম, তবে আমার জীবন ধন্য হত। মেয়েটি বলল, আল্লাহ্ পাক আপনাকে উত্তম, বিনিময় দান করুন। একথা বলেই সে তার মৃত পিতার নিকটে এসে তার কপালে চুম্বন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আব্বা! তুমি বড় ভালো মানুষ ছিলে। গুনাহের ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে তুমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলে। তুমি সর্বদা আল্লাহ্কে ভয় করতে এভাবে সে পিতার নেক আমলের কথা উল্লেখ করে কান্না করছিল।
হযরত আবূ আমের বলেন, আমি তাকে বললাম, বেটা! তুমি এত কাঁদছ কেন? তোমার পিতা জান্নাতবাসী হয়ে স্বীয় নেক আমলের বদলা লাভ করেছেন। এ কথা শুনামাত্র সাথে সাথে সে একটি চিৎকার দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করল। আমি তাদের উভয়ের নামাযে জানাজা পড়লাম।