এক অন্ধ বুজুর্গের কথা
কোন একজন বুজুর্গ বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে লোবানান পাহাড়ে তথাকার আবেদ, জায়েদ আল্লাহ ওয়ালাদের খোঁজ করছিলাম। তিন দিন একটানা পথ চলার পর আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম এবং আমার পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। অতঃপর আমি পাহাড়ের চূড়ায় বসে পড়লাম। আমার সফরসঙ্গীরা বলল, তুমি কিছুক্ষন বিশ্রাম কর, আমরা আশেপাশে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু তারা যে গেল আর তাদের কোন সন্ধান পেলাম না।
আমি সে নির্জন পাহাড়ে একাকী তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দু’দিন পর আমার অযূর প্রয়োজন হলে আমি পানির সন্ধানে পাহাড়ের নীচে নেমে আসলাম। সেখানে এক ঝর্নায় অযূ করে আমি নামাযের জন্য দাঁড়ালাম। এমন সময় কোথা হতে কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ ভেসে এল। নামায শেষ হবার পর আমি সেই শব্দ অনুসরন করে সামনের দিকে যেতে লাগলাম। পরে দেখতে পেলাম, পাহাড়ের এক গুহা হতে ঐ শব্দ ভেসে আসছে। আমি গুহায় প্রবেশ করে দেখলাম, এক অন্ধ বুজুর্গ সেখানে বসে আছেন। আমি নিকটে গিয়ে তাকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মানুষ নাকি জ্বীন? আমি বললাম, মানুষ। তিনি বললেন- বিগত ত্রিশ বছর যাবত এখানে কোন মানুষ আসেনি। আমার মনে হচ্ছে তুমি ভীষন ক্লান্ত। আগে তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, সে গুহার পাশাপাশি তিনটি কবর ছিল। আমি ঐ কবরের পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। জোহরের নামাযের সময় হলে তিনি আমাকে ডেকে তুললেন এবং বললেন, তোমার উপর আল্লাহ রহম করুন, নামাযের সময় হয়েছে। আমি তার সাথে জোহরের নামায আদায় করলাম। পরে আসরের নামায আদায়ের পর দাঁড়িয়ে তিনি এ রকম দোয়া করলেন যে, “হে আল্লাহ তুমি মুহাম্মদ (সঃ) এর উম্মতকে হেদায়েত কর, তাদের উপর রহমত নাজিল কর এবং তাদেরকে স্বচ্ছলতা দান কর”।
মাগরীব নামায আদায়ের পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি ঐ দোয়া কোথা হতে শিখলেন? তিনি বললেন, যেই ব্যক্তি এই দোয়া দিনে তিনবার পাঠ করবে আল্লাহ পাক তার নাম আবদালের অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কে শিখিয়েছেন এ দোয়া বলুন? এবার তিনি বললেন, আমি যদি সেই কথা বলি তবে, এটা তোমার ক্বলব সহ্য করতে পারবে না।
হযরত ইমাম আরফে বিল্লাহ শায়েখ আবুল হাসান শাজালী (রহঃ) এবং আরো কতিপয় বুজুর্গ বলেছেন, যেই ব্যক্তি নিম্মোক্ত দোয়াটি দৈনিক পাঠ করবে তার নাম নেক্কারদের মধ্যে গন্য করা হবে।
বুজুর্গরা বলেছেন, এটা হযরত খিজির (আঃ) -এর দোয়া। যাই হোক, তুমি কিছু খাবে কি? আমি বললাম-হ্যাঁ। তিনি বললেন, গুহায় অভ্যন্তরের দিকে আরেকটি ধাপ আছে, তুমি সেখানে গিয়ে দেখবে খাবার সাজানো আছে, তুমি ইচ্ছামত খেয়ে আস। আমি ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, সেখানে একটি পাথরের উপর আখরুট, মনাক্কা, ছেব, এবং আরো কিছু ফল থরে থরে সাজানো আছে, আমি সেখান থেকে ইচ্ছামত ফল খেয়ে ফিরে এলাম।
অতঃপর আমি লক্ষ্য করলাম বুজুর্গ রাতভর একটু ও ঘুমালেন না। গভীর রাতে বিতরের নামায আদায় করে সামান্য আহার করলেন। তারপর ছোহবে ছাদেক পর্যন্ত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে রইলেন। ফজরের নামাজ আদায়ের পর, বসে বসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়লেন। পরে সূর্য দুই বর্শা উপরে উঠার পর তিনি জাগ্রত হয়ে গুহার বাহিরে গিয়ে অযূ করে আসলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এ ফল আসে কোথা থেকে? আমি এত মজার ফল কখনো দেখিনি এবং খাইনি। তিনি বললেন, একটু পরে তুমি নিজের চোখে সব কিছু দেখতে পাবে। কিছুক্ষণ পরই সেইগুহায় একটি পাখী এসে প্রবেশ করল। পাখিটির গলার রং লাল এবং বাকী অংশটুকু সবুজ। এর দু পায়ে আখরুট এবং ঠোঁটে মহাক্কা বহন করে নিয়ে এল। পাখীর আগমনের সাড়া পেয়ে বুজুর্গ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেটা! আমার এখানে কেমন করে ফল আসে দেখছ কি? আমি বললাম হ্যাঁ। উনি বললেন, গত বিশ বছর যাবত পাখীটি এভাবে আহার যোগাচ্ছে আমার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম- পাখিটি দৈনিক কতবার আসাযাওয়া করে এখানে? তিনি বললেন, চৌদ্দবার।
আমি বললাম, আমি কিন্তু পনেরবার আসা-যাওয়া গননা করেছি। তিনি বললেন, তখন তোমার জন্য একবার বেশী আসতে হয়েছে ওর।
অতঃপর তিনি বললেন, পাখীর বিষয়ে এর বেশী তুমি আমাকে প্রশ্ন করোনা। আমি আর এ বিষয়ে প্রশ্ন করলাম না। অতঃপর লক্ষ্য করলাম বুজুর্গের গায়ের পোষাকটি গাছের ছালের।
আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনী এ পোষাক কোথায় পেলেন? তিনি উত্তরে বললেন, ঐ পাখিটি প্রতি বছর আশুরার দিন দশ টুকরো গাছের ছাল এনে দেয় আমাকে। পরে আমি সেই গাছের ছাল দিয়ে জোড়া লাগিয়ে পাজামা এবং কোর্তা বানিয়েছি। বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, আমি লক্ষ্য করলাম, সেই গুহার এক কোনে একটি বড় সুচ পড়ে আছে আর বিছানা হিসাবে তিনি গাছের ছালের কিছু পুরাতন ছেড়া টুকরা ব্যবহার করছেন। গুহার এক কোনে একটি পাথর পড়েছিল। জিজ্ঞেস করে জানা গেল মাথার চুল ভিজিয়ে উহা দ্বারা ঘর্ষণ করলে মাথার চুল উঠে যায়। অর্থাৎ উহা দ্বারা তিনি মাথা মুণ্ডানোর কাজ সমাধা করেন।
অন্য একদিনের ঘটনা, আমি তার নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় সেখানে সাতজন মানূষ প্রবেশ করল। তাদের গোটা দেহ ছিল বড় বড় পশমে আবৃত। তাদের চেহারা ছুরত দেখে আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম। বুজুর্গ সম্ভবত! আমার অবস্থা টের পেয়েছিল। তিনি আমাকে ফার্সী ভাষায় বললেন, ভয় পেয়োনা, তারা মুসলমান জ্বীন। আমার কাছে কোরান শরীফ শিখতে এসেছে। তারা সূরা ত্বহা,সুরা ফোরকান এবং সূরা রহমান পাঠ করে চলে গেল।
বর্ণনাকারী আরো বলেন, আমি সেগুহায় গমনের চব্বিশ দিন পরের ঘটনাঃ আমি বুজুর্গের সাথে আলাপ করছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, এখন তোমার নিজের কথা বল, কোথা হতে কেমন করে এখানে এলে? আমার মুখে বিস্তারিত ঘটনা শুনে তিনি বললেন, এ বিষয়ে আগেই আমাকে অবগত করলে তোমাকে এতদিন এখানে থাকতে দিতাম না। তোমার সাথীরা তোমাকে খুজে খুজে পেরেশান হচ্ছে নিশ্চয়। এখন যথাসম্ভব দূরত তাদের নিকট ফিরে যাওয়া তোমার কর্তব্য। আমি বললাম, আমি একাকী পথঘাট চিনে যেতে পারব না। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমার মনে হল, তিনি আমার ফিরে যাওয়ার উপায় খুজে বের করার চিন্তা করছেন। কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না।
সন্ধ্যায় সূর্য ডুবার পূর্বক্ষণে কোণ ভূমিকা ছাড়াই তিনি বললেন, চল। আমি বললাম, আমাকে কিছু নছিহত করুন। বুজুর্গ বললেন, আদব শিখ এবং অভুক্ত থাকতে অভ্যাস কর। আমি আশা করি শিঘ্রই তুমি তোমার স্বজনদের সাথে মিলিত হতে পারবে। অবশেষে এক ব্যক্তির আকৃতির বিবরণ দিয়ে বললেন, হজ্বের সময় তার সঙ্গে দেখা করে আমার ছালাম দেবে এবং নিজের জন্য দোয়া করতে বলবে। জমজম ও মাকামে ইব্রাহিমের মাঝে সন্ধান করলেই তার সাক্ষাৎ পাবে।
অতঃপর অন্ধ বুজুর্গ আমার হাত-ধরে গুহার বাইরে নিয়ে আসলেন। গুহার বাইরে তখন একটি নেকড়ে বাঘ দাঁড়িয়ে রয়েছিল। বুজুর্গ সেই বাঘের সঙ্গে কি যেন এক ভাষায় কথা বললেন, আমি কিছুই বুঝলাম না। তার সাথে আলাপ শেষে আমাকে বললেন, এই বাঘ তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। সে যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, সেখানেই তুমি সোজা বাম দিকে তাকালে তোমার পথের সন্ধান পাবে। একথা বলেই তিনি গুহার ভেতর চলে গেলেন।
আমি বাঘের পেছন পেছন হাটতে লাগলাম। কিন্তু কয়েক মুহুর্ত চলবার পরই বাঘ দাঁড়িয়ে পড়ল। বুজুর্গের কথামত আমি বাম দিকে ফেরামাত্র দামেশক শহর দেখতে পেলাম। তখন মাগরীবের সময়। আমি দামেশকের জামে মসজিদে গিয়ে নামায আদায়ের পর সেখানে আমার সাথীদের সাথে সাক্ষাৎ হল। আমাকে ফিরে পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না। এত দিন আমি কোথায় ছিলাম,কেমন করে সেই বুজুর্গের সন্ধান পেলাম। সেখানে কি কি দেখালাম। সেই পাখি, জ্বীন ও সবশেষে বাঘের ঘটনা ইত্যাদির বিবরণ শুনে তারা স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তিন দিন পর্যন্ত সেই পাহাড়ে তন্ন তন্ন করে খুজেও সেই গুহার সন্ধান পাওয়া গেল না।
অবশেষে তারা মন্তব্য করল, আসলে আল্লাহ পাক ঐ বুজুর্গকে তোমার সামনে প্রকাশ করেছেন আর আমাদের নজর থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছেন।
বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, পরবর্তীতে প্রতি বছরই আমি হজ্বের সময় জমজম ও মাকামে ইব্রাহিমের মাঝে সেই ব্যক্তির তালাশ করতাম, কিন্তু একবার ও তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।
পরে আট বছর পর হজ্বের সময় আছরের নামাযের পর যথাস্থানে তার সাক্ষাৎ পেলাম। আমি নিকটে গিয়ে অত্যন্ত তাজীমের সঙ্গে তাকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দেওয়ার পর আমি বললাম, আমার জন্য দোয়া করুণ। তিনি দোয়া করলেন। অতঃপর আমি বললাম, হযরত ইব্রাহিম কিরমানী আপনাকে ছালাম জানিয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার সাথে তোমার কোথায় সাক্ষাৎ হয়েছে? আমি বললাম, লোবানান পাহাড়ে। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা তার উপর রহম করুন। আমি চমকিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি মারা গেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আমি তার জানাজার নামায পড়ে সে গুহাতেই তার ভাইদের সাথে দাফন করে এসেছি। তাকে যখন গছল দিচ্ছিলাম তখন যে পাখিটি তার জন্য ফল নিয়ে আসত সেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মারা গেল। আমি তাকেও বুজুর্গের পায়ের দিকে দাফন করে দিলাম।