একেই বলে কপাল

আজকের দিনটা বেশ স্পেশ্যাল সানির কাছে। কারণ আজ ওর বাবা মা কেউই বাড়ি নেই। দুজনেই গেছেন সানির মাসতুতো দিদির ছেলের মুখেভাতে । সানি পরীক্ষার কারনে যেতে পারেনি। মা রান্না করে রেখে গেছেন,আসার সময় ও প্যাকেট নিয়ে আসবেন কথা দিয়েছেন। সানির জন্য একটু তাড়াতাড়িই ফিরবেন । ও কে একা রেখে তো কোথাও যান না। অবশ্য বাবা মা ইচ্ছা করলে ওকে নিয়ে যেতে পারতেন ।

পরীক্ষার এখনও একমাস বাকি আছে। কিন্তু রেজাল্ট খারাপের অজুহাতে বাবা মা ওকে নিয়ে গেলেন না। সানির একটু একটু যে মন খারাপ হয়নি তা নয়। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। অন্তত একটা দিন তো ও নিজের ইচ্ছামত কাটাতে পারবে। মা বাবা বাড়ি তে থাকলেই ঝামেলা। সারা দিন এটা করিস না ওটা করিস্ না বলতেই থাকেন। এই এখন টিভি চালাবি না।
এফ.এম কেন চালিয়েছিস? পড়ার বই ছেড়ে গল্পের বই পড়ছিস? সারাক্ষণ একই কথা। তুমি মুখ বুজে সারাক্ষণ শুধু পড়ে যাও হলেই তা হলেই তুমি ভালো । তবু তো বাবা অফিস যান কিন্তু মা? তিনি তো আর অফিস যান না। সানিও খুব সিরিয়াস পড়াশোনায় । তবু কেন যে বাবা মায়ের মন ভরে না কে জানে? যাক একদিন তো ছুটি পাওয়া গেছে। আর এখন গরমের ছুটি চলছে।
মা তাকে বারবার করে বলে দিয়েছেন সে যেন টিভি না দেখে। কিংবা গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট না করে। ঠিক সময় পড়া শেষ করে স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে যেন একটু ঘুমিয়ে নেয়। তারপর আবার উঠে একটু কিছু খেয়ে নিয়ে যেন পড়তে বসে। সকালে বাবা মা অনেক বার বুঝিয়ে সুঝিয়ে বেরিয়ে যাবার পরই ও আনন্দে বিছানায় গড়াগড়ি খেল কিছুক্ষণ । তারপর টিভি খুলে বসে পড়ল ।

সোনি তে দারুন ফাটাফাটি একটা মুভি চলছে। সানি বসে পড়ল । ক্লাস নাইনের ছাত্র ও । ওর বয়সী সব ছেলে মেয়েই হিন্দি সিনেমার ভক্ত। ও নিজেও তার ব্যাতিক্রম নয়। বেশ গুছিয়ে বসে পড়ে ও। কিছুক্ষণ পরই টেলিফোন বেজে উঠলো । সানি দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করে। মা ফোন করেছেন। -কি ব্যাপার সানি? স্নান হয়েছে? টিভি চলছে মনে হচ্ছে । -হ্যাঁ মা বসে বসে খেলা দেখছি। ( খেলা দেখার অনুমতি আছে একমাত্র কিন্তু মুভি একদমই নয়।) -কিন্তু গান ভেসে আসছে কেন? খেলার মাঠে গান বাজনাও হয়? -আরে চিয়ারলিডাররা ডান্স করছে। আর কিছু নয়। আজকাল গান বাজনা সবই হয় মাঠে । নিজে যে এত গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে সেটা দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল। মা আর ও কয়েকটা কথা বলে ফোন ছেড়ে দেন। সানি টিভির সামনে এসে দেখল সেই ভীষণ সুন্দর গানটা শেষ হয়ে গেল এই মাত্র। বেশ বিরক্ত বোধ করে ও। যাক গে কি আর করা যাবে মুভিটা তো এখনও অনেকটা বাকি আছে। নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় সানি। এখন আরও সিরিয়াস সিন চলছে। নায়ক কে কত গুলো গুন্ডা তাড়া করেছে। প্রান বাঁচাতে মরীয়া হয়ে ছুটছে নায়ক। ঠিক এই সময় কলিং বেল বেজে ওঠে শব্দ করে। দূর এই সময় আবার কে জ্বালাতে এল! ওকে উঠতেই হয় ,দরজা খুলে দেখে ধোপা বউ দাঁড়িয়ে আছে। সানির হাতে একগাদা ইস্ত্রি করা জামাকাপড় ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই শারি দুখানা কুড়ি টাকা, বাবুর পাঞ্জাবি দুখান পনের , বিছানার চাদর কুড়ি ,বালিশের অয়ার আর পাশবালিসের অয়ার মিলে হল গিয়ে… তুমি যাও এখন কাল বিকেলে এসো ।

বলে নিজে জামাকাপড় গুলো নিয়ে ভেতরে আসে ধোপা বউ কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে । এবার নায়ক বেদম মার শুরু করেছে বদমাশ লোকগুলোকে। দারুন কায়দায় হাত চালাচ্ছে নায়ক। দুষ্টু লোকগুলো ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে কিন্তু না শেষ রক্ষা হয় না । একজন পেছন থেকে এসে আঘাত করে নায়কের মাথায়। চোখে অন্ধকার দেখে নায়ক। সানির চোখে জল এসে যায় । ঠিক এই সময় আবার কলিং বেল বেজে ওঠে । এবার দুটো লোক এসেছে। একজন বলল, আমরা কোম্পানি থেকে আসছি। আপনাদের ওয়াশিং মেশিনটা খারাপ বলে রিপোর্ট করেছিলেন। ওদের ওয়াশিং মেশিন খারাপ নাকি? গভীর মুখে চিন্তা করে সানি। ঠিক মনে পরে না। বলে উঠলো না না আমাদের কিছু খারাপ হয়নি আপনারা এখন আসুন। বলেই দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এখন দেখাচ্ছে নায়ক হাসপাতালে ভরতি। মাথায় ব্যান্ডেজ। মাথার কাছে চেয়ারে ছলছল চোখে মা আর নায়িকা ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে বসে আছে। সানি উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকে। আবার ফোন বাজছে। সানি টিভির ভলিউম কমিয়ে ফোন রিসিভ করে। আবার মা।   -কি রে সানি স্নান খাওয়া কমপ্লিট? -হ্যাঁ মা। এখন একটু ঘুমাবো ভাবছি। -অঙ্ক গুলো কষেছ ? আর ইংরাজিটা পড়েছ? -হ্যাঁ মা চিন্তা কোরো না। মা নিশ্চিন্ত হয়েই ফোন কেটে দিলেন। আবার ও টিভির সামনে এসে বসে পড়ে। এখন ব্রেক চলছে। সানি রিমোট টিপে অন্য চ্যানেলে চলে যায় । খবরে বলছে আজ বিকেলে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে। সানিকে অবাক করে দিয়ে বেলটা আবার বেজে ওঠে ।

 

এবার একজন ভদ্রলোক বললেন, মিটারটা একটু দেখবো । সানিকে দরজা খুলতেই হয় । মিটার দেখে ভদ্রলোক চলে যায় । সিনেমা এখনও আসেনি এখনও ব্রেক চলছে। নাহ্‌ এরাও দেখাতে বড্ড দেরী করছে। সাবান, বিস্কুট ,শ্যাম্পু, তেল, ক্রিম ,পাউডার, মাজন, হেনতেন অনেক দরকারি অদরকারি জিনিষের বিজ্ঞাপন দেখানোর পর মুভি আবার আরম্ভ হল। উফ্‌ আসল কাহিনী তো এবার। এতো দিন ভিলেন আর তার দলবল নায়কের পরিবার কে অনেক জ্বালিয়েছে এবার নায়ক তাদের যোগ্য জবাব দেবে। সানি মনে মনে ঠাকুর কে ডাকতে থাকে হে, ঈশ্বর এই ক্লাইম্যাক্সে যেন লোডশেডিং না হয়ে যায় ।কিন্তু লোডশেডিং হবার বদলে বেলটা বেজে ওঠে মিষ্টি সুরে। সানি ভীষণ বিরক্ত বোধ করে। আবার ওকে ছুটতে হয়। দরজাটা খুলেই হতভম্ব হয়ে যায় ও। এবার এসেছেন বিনয় স্যার। বাবার বন্ধু এই বিনয় স্যার। সানি ফিজিক্স পড়ে স্যারের কাছে । যেহেতু উনি বাবার বন্ধু তাই সানির প্রতি বিশেষ কেয়ার নেন ।মাঝে মাঝে বাড়ি চলে আসেন সানি কেমন পড়া করছে তা দেখার জন্য। সানির হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন, কাল তোমার বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো বললেন তোমার নাকি আলোক বিজ্ঞান চ্যাপ্টারটা বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে সেই জন্যই সময় করে আজ চলে এলাম। তোমার এখন অসুবিধা নেই তো পড়তে ? সানি ঢোঁক গিলে বলল, আজ খুব পেট ব্যাথা করছে স্যার। কিছুই মাথায় ঢুকবে না । সেকি ওষুধ খেয়েছ? তোমার বাবার সাথে একটু দেখা করে যাই । বিয়ে বাড়ি গেছেন বাবা মা। কথাটা বলেই বুঝল ও ভুল করেছে। স্যার বললেন, সেকি তোমার এরকম অসুখ তার ওপর তুমি একলা আছো বাড়িতে! তোমার কাছে একটু বসে যাই । না স্যার সেরকম কিছু নয়।

তোমার মুখ তো বেশ শুকিয়ে গেছে দেখছি। না তোমায় আজ পড়াবো না। কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকবো, বাবা মা না ফেরা পর্যন্ত ওয়েট করতেই হবে। আর দাঁড়িয়ে থেকো না চল ভেতরে চল। সানি বুঝল তার আর নিস্তার নেই। উদ্বিগ্ন মুখ করে শুয়ে পরে। টিভি টা এখন স্যার ই দেখছেন। বাংলা নিউজ চ্যানেল। স্যার বলেছেন শরীর খারাপ অবস্থায় সিনেমা দেখতে নেই তাই কি আর করা যাবে বলো? তোমারা হলে কি করতে? ওই যে কথায় আছে না অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায় । মা মাঝে মাঝে বলেন তুমি যাও বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে। সানি মনে মনে ভাবতে থাকে একেই বলে কপাল!

গোরস্থানের বধূ

একটি ভয়ঙ্কর রাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *