এখন দোকানে লোকজন হয় না৷ স্থানীয় কিছু বুড়ো, আর বাড়ির কাজের মেয়েরা, যারা ঝাঁটা ব্যবহার করে৷ ওরা একটা করে লাড্ডু নিয়ে যায়৷ জন্মাষ্টমীর দু’দিন আগে সুদামের ছেলে জন্মায়৷ সিজার করতে হয়েছিল৷ সুদামের বাবার কী রাগ৷ কেন সিজার করে বাচ্চা পেট থেকে বের করা হল? আর দুটো দিন পরেই তো জন্মাষ্টমীর দিনে জন্মাত৷ এরপর হরিদাসের গোঁ, নাতির নাম রাখবে শ্রীকৃষ্ণের নামে কানাই৷ হার্গিস না৷ এসব নাম চলে নাকি? হরিদাস কৃষ্ণের নামেই রাখবে৷ সুদাম একজনকে ফ্ল্যাট কিনিয়ে দিয়েছিল, বাংলা পড়ায়, কলেজে৷ ওকে বলেছিল কৃষ্ণ বোঝায় এমন একটা ঝিনচ্যাগ নাম বেছে দিতে৷ সে বলেছিল, পার্থসারথি চলবে? তেমন ঝিনচ্যাগ হল না, কিন্তু কানাই, গোপাল, কুঞ্জবিহারীর চেয়ে ভাল৷ হরিদাস যদিও গোপাল বলেই ডাকে৷ স্কুলে পার্থসারথি৷ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে৷ আর দুটো রাইস দাও বলে মাকে৷ রাস্তায় যেতে যেতে সুদামও ছেলেকে ইংরেজি শিখিয়েছে৷ কুকুর দেখে ভৌ ভৌ বললে সুদাম বলেছে, ওটা ডগ৷ গরুকে হাম্বা বললে সুদাম বলেছে, ওটা কাউ৷ পাড়ায় নতুন গজানো হনুমান মন্দিরের ঠাকুরকে দেখে ছেলে জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটা কি মাংকি বাবা? এসব ফেস করেছে সুদাম৷ ছেলে এখন ফোর৷ ভাল ইস্কুল৷ গাড়ি আসে৷ টিফিনে স্যান্ডুইচ ৷ সব দালালি করেই হয়েছে৷ বাবার দোকান থেকে ইলেকট্রিক খরচাটাও হয় না৷ বলে বলে হাল্লাক হয়ে গেছে বাবা উনুন হটাও, ঝাঁটা হটাও, নিয়ে এসো জ্যাম — জেলি — সস — পেস্ট্রি ৷ নিয়ে এসো কর্নফ্লেক্স’, চিজ — পনির — বাটার ৷ শ্যাম্পু, লিপস্টিক, ন্যাপকিন৷ দেখছ না সূর্যতোরণ — আকাশ প্রদীপ — ছায়ানীড়…৷ কোনও কথাই কানে যায় না৷ স্ত্রী বিয়োগের পর একটু যেন পাগলাটে হয়ে গেছেন হরিদাস৷
একলা বৈশাখ
‘মাছও ধরবেন জিমও করবেন’ — এমন অঞ্চলের একটি দোকানের নাম ‘জয়নিতাই ভাণ্ডার’ রেল লাইনের ধারে জলাভূমি, ঝোপ, এখনও মাছরাঙা, পলিথিন ছাওয়া ঝুপড়ি, যেখানে চুল্লুর ঠেক, লাইনের ধার দিয়ে কাঁধে গামছা ফেলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে মাঠ সারতে যায় ঝোপসন্ধানী মানুষ৷ প্রভাত আলোয় বিক্ষিপ্ত গজিয়ে ওঠা উঁচু উঁচু বাড়ির ব্যালকনি থেকে নেচার দেখতে দেখতে চা খাওয়া মানুষরা দেখে কর্তাল বাজাতে বাজাতে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে৷ লোকটার নাম হরিদাস সাহা, গলায় কন্ঠি৷ সকাল সাতটা সাড়ে সাতটাতেই দোকানটা খুলবে, যে দোকানটার নাম ‘জয়নিতাই ভাণ্ডার’৷ নিজেদের বাসস্থানের সামনের ঘরেই এই দোকানটা করেছিলেন হরিদাস৷ টালির ঘর৷ তখন বাগজোলা খালের জল এত কালো ছিল না৷ খালধারে লম্বা লম্বা ঘাস গজাত, কাশফুল ফুটত, সেই ঘাসের ঝাঁটা তৈরি করত স্বামী — স্ত্রীতে৷ তারপর শুধু ঝাঁটা নয়, উনুনও৷ নানা রকমের বালতি উনুন, কড়াই উনুন, জোড়া উনুন, কেরোসিন স্টোভ, মাটির হাঁড়ি — কলসিও৷ যখন মানুষ আর মাটির হাঁড়ি কেনে না, তখনও দোকানে মেটে হাঁড়ি৷ এখানেই সুদামের আপত্তি৷
সুদাম ছোট ছেলে৷ বড় ছেলে সুবল কম বয়সেই মারা গেছে৷ সুদাম দেখে, ওর বাবা দোকানটা গুদাম করে রেখেছে৷ সুদাম ওর বাবাকে বহুবার বহুভাবে বলেছে, দোকানের আইটেম পাল্টাও৷ এখন এসব আদিম সভ্যতার জিনিসপত্র চলে না৷ বলে কোনও লাভ হয় না৷ সুদামের বাবা হরিদাসও পাল্টায় না৷ এখনও মুড়ি — বাতাসা, ধুতি — ফতুয়া, দেখা হলে জয়নিতাই৷ সুদাম বলে, দোকানটা আমায় ছেড়ে দেন, আমি ভোল পাল্টে দেব৷ এই চুম্বক জায়গায় দোকান, ঠিকঠাক আইটেম রাখলে সংসারের হাল ফিরে যাবে, তোমাকে মার্বেল বসানো মন্দির বানিয়ে দেব৷ হরিদাস বলে এই দোকান আমার লক্ষ্মী৷ এই দোকান করেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, তোকেও বিয়ে দিয়েছি বাপ, ডাল — ভাতের ব্যবস্থা তো হয়ে যায়৷ বোষ্টমরা এমন গোঁয়ার হয়? পাড়ার তোলাবাজদের শিখিয়ে দিয়েছিল, বাবার থেকে দশ হাজার টাকা ডিমান্ড কর৷ সেটাও হয়েছিল৷ হরিদাস মাতৃভাষায় বলেছিল, দিমু না যাও৷ কী করবা? দোকানে আগুন দিবা?
সুদাম একটা কারখানায় চাকরি করত৷ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷ দেওয়ালের বাণী সত্যি হল ওর জীবনে৷ কারখানাটা বন্ধ হওয়ার পরই ওর রোজগারপাতি বাড়ল৷ মেট্রো রেল বারাসত পর্যন্ত যাবে ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই জমির দাম বাড়তে লাগল ঝটাক ঝটাক৷ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হতে লাগল চারদিকে৷ বেদিয়া পাড়া জেলিয়া পাড়া আমড়াবাগানের ভিতরে সূর্যতোরণ, মেঘমল্লার, আগমনী, আকাশ প্রদীপ৷ ছায়ানীড় নামে একটা বড় প্রজেক্ট’ও হয়েছে জিটূ ১০ — এর ছটা টাওয়ার৷ সুদাম ইট বালি সিমেন্ট সাপ্লাই করে, ফ্ল্যাট ভাড়া এবং বিক্রির দালালিও৷ গাছের গায়ে টিনের পাতে, খালপোলের গায়ে, বাজারের দর্মার বেড়ায় সুদাম সাহার নাম আর মোবাইল নম্বর লেখা, সেই সঙ্গে ‘বাড়ি, জমি ও ফ্ল্যাটের সন্ধানের জন্য যোগাযোগ করুন’…৷ সুদামের নিজস্ব অফিসঘর এখনও হয়নি৷ কালীপদর চায়ের দোকানটাই ওর অফিস৷ একটা চুম্বক পজিশনে ফালতু জয়নিতাই ভাণ্ডার পড়ে আছে৷ কী পাওয়া যায়? ঝাড়ু৷ খুব রাগ হয় বাপের ওপর৷ ঝাড়ু মেরে ফোটাতে ইচ্ছে করে৷ মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর….৷ এই গানটা সুদামের বাবার খুব প্রিয়৷ প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে এই গানটা বার বার বাজে জয়নিতাই ভাণ্ডারে৷ হালখাতা হয় যে…৷
এই হালখাতা ব্যাপারটা হরিদাসের একটা পার্বণ৷ সুদাম যখন ছোট, তখন হরিদাস সবাইকে নিয়ে সকালবেলা গঙ্গায় যেত৷ নিম — হলুদ বাটা মাখতে হত গায়ে৷ সুদামের দিদি ছিল শ্যামলা ও একটু বেশি করে গায়ে ঘষত৷ সুদামকে বলত, একটু ফর্সা লাগে নারে ভাই! বাড়ি ফিরে শত্রু বলি দিতে হত৷ শত্রুবলি মানে, একটা মানুষের দেহ আঁকতে হত কাঠকয়লা দিয়ে৷ তারপর ওই মানুষটার মুখে একটা কাঁচা আম বসিয়ে দিয়ে একটা কাটারি হাতে নিয়ে মম্তর পড়তে হত — জলের শত্রু ফলের শত্রু দূর যা৷ আমার শত্রু দূর যা৷ কোপ কোপ কোপন, শত্রু হল নিধন৷ এবার আমটাকে কোপ মেরে দু ভাগ করতে হত৷ বাড়িতে বামুন এসে গণেশ পুজো দিত, সেই গণেশ মাথায় করে দোকানে যেত৷ আগের দিন সারা দুপুর ধরে নারকেল কুরে সন্দেশ বানানো৷ দোকানের হালখাতায় যারা আসত, তাঁদের একটা করে নারকোলের সন্দেশ৷ পরে, সেই সঙ্গে নিমকি, লবঙ্গলতিকা, এই সব৷ কাগজের বাক্সে৷ ক্যালেন্ডারও হয়েছিল কয়েক বছর৷ রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি, কিংবা গৌরনিতাই ৷ কিংবা জগন্নাথদেব৷ স্থানীয় লোকজন ছাড়াও শেয়ালদার পাইকাররাও আসত৷ হালখাতা এখনও হয়৷ গত বছরও হয়েছিল৷ সুদামের ছেলেটার খুব উৎসাহ৷ দোকানে বসে থাকে৷ ওর দাদুর সঙ্গে খুব ভাব৷ দাদু ওকে কোকের বোতল দেয়, চিপসের প্যাকেটও৷
সাপ্লাই লাইনে কিচাইন লেগেছে৷ অনেক রকম দাদা৷ মাল্লু দিতে হয়৷ দালালি লাইনেও কম্পিটিশন৷ নতুন নতুন ছেলেরা আসছে৷ সবার পেছনেই খুঁটি৷ ঝামেলা চলছে৷ একদিন বেশ বড় রকমের গণ্ডগোল৷ গুলিও চলল৷ কেউ মারা যায়নি৷ একজনের পায়ে লেগেছিল৷ সুদামকে ধরে নিয়ে গেল পুলিস৷ হাজতে পুরল৷ পুলিস বাড়িতে এলো সার্চ করতে৷ এ বাড়িতে পিস্তল খুঁজতে এসেছে৷ পিস্তল৷ এখানে পিস্তল? এ বাড়িতে গৌরনিতাই, তুলসী গাছ৷ মুড়ি — বাতাসা, কন্ঠিমালা৷ পুলিস খাটের তলা দেখে, শুধু সুদামের ঘর কেন, হরিদাসের ঘরেও৷ গৌরনিতাইয়ের সিংহাসনের তলাতেও লাঠি ঘোরায়৷ বলে আসন সরাও, কিছুই পায় না, কিন্তু সেই দিনই শুয়ে পড়ে হরিদাস, কথা বন্ধ৷ ছেলে হাজতে৷ সুবলের বউ খেতে ডাকে, ওঠে না, ধাক্কা দেয়, সাড়া দেয় না, পাশের বাড়ির লোক ডাকে, তারপর হাসপাতাল, জানা যায় সেরেব্রাল স্ট্রোক৷ দোকানটা এখন সুদামের৷ বাবার দেওয়া জয়নিতাই ভাণ্ডারের ‘জয়’টা রেখেছে, নাম দিয়েছে এনজয়৷ সিমেন্ট বালি সাপ্লাইয়ের খতরনাক কাজটা ছেড়ে দিয়েছে৷ দালালিটা রেখেছে৷ একটা ফ্ল্যাট বেচতে পারলেই টু পার্সেন্ট ৷ মানে তিরিশ লাখে ফ্ল্যাট বেচলে ষাট হাজার টাকা৷ এনজয়টাই অফিসঘর৷ দোকানে হরেক আইটেম৷ কেক পেস্ট্রি বার্গার ওধারে, এপাশে টিস্যু পেপার, নানা ধরনের ন্যাপকিন, কসমেটিক’৷ এ ছাড়া সি ডি — ও৷ নানা ধরনের সি ডি ৷ কেউ এসে তিনটে আঙুল তুলে দেখালে সুদাম একটা থ্রি এ’ দিয়ে দেয়৷ সুদামের বাবা হরিদাস হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল৷ বাঁ দিকটা প্যারালিসিস হয়ে যায়৷ তারপর আয়া, ফিজিওথেরাপি, একগাদা টাকা বেরিয়ে গেছে৷
এখন হাতে লাঠি নিয়ে একটা পা টেনে একটু একটু হাঁটতে পারে৷ কিছুদিন আগে একটা গাড়িতে বহুত কষ্ট করে চাপিয়ে দোকানটা দেখাতে এনেছিল সুদাম৷ গৌরনিতাইয়ের ছবিটা একই জায়গায় আছে দেখে খুশি হয়েছিল৷ মাথা ঘুরিয়ে দোকানটা দেখছিল৷ সুদাম জিজ্ঞাসা করেছিল, ভাল হয়েছে তো বাবা? হরিদাস ঘাড় নাড়িয়েছিল৷ ওটা হ্যাঁ নাকি না, বোঝা যায়নি৷ ট্র্যাডিশনটা নষ্ট করেনি সুদাম৷ ঝাঁটাও রাখে৷ ‘ডাস্টার’ও বলে কেউ কেউ৷ পালকের ঝাড়ু আছে গাড়ি ঝাড়ার, কম্পিউটার ডাস্টারও, আর ফুলঝাড়ুগুলো ঘাসের নয়, নরম প্লাস্টিকের৷ হালখাতাও করে৷ নতুন খাতাটা নিয়ে কালীঘাট যায় সকালে৷ গত বছরই তো প্রথম হালখাতাটা হল৷ গণেশ পুজোও হয়েছিল৷ অন্যবারের মতো শত্রুবলিটাও হয়েছিল৷ শত্রুবলির রিচুয়ালটা করতে পার্থর খুব মজা লাগে৷ একটা এনিমি এঁকে ওর মুখের ওপর কাঁচা আম খ্যাচাৎ, তোমার এনিমিও ফিনিশ৷ সত্যি সত্যি কী হয় এসব? এগুলোকে বলে সুপারস্টেশন৷ দাদু যেমনভাবে নিত্যানন্দ প্রভু দাদুর পায়ে টাচ দিয়েছিল বলে দাদু হাঁটতে পারছে৷ তবে নিয়মিত ওষুধ খায়৷ প্রেসারটা বেশি৷ গতবার ক্যালেন্ডারও করল সুদাম৷ অন্যরকম৷ ক্যালেন্ডারের লোক ক্যাটালগ নিয়ে এসেছিল৷ গোপিনীদের বস্ত্রহরণই সিলে’ করেছিল সুদাম৷ আট বস্ত্রহীনা গোপিনী লজ্জাস্থান আড়াল করছে ৷
এই তো আবার বৈশাখ মাস আসছে৷ এবার ভাল প্যাকেট করবে৷ দোকানটা খুব চলছে৷ সুদাম বাড়িটা সাজিয়ে নিয়েছে৷ নিজের একটা প্রাইভেট ঘর৷ ওখানে কম্পিউটার, ছোট টিভি, চেয়ার — টেয়ার৷ স্কুলে সি বি এস সি — র সিট পড়েছে৷ পার্থর ছুটি৷ পার্থর মায়ের ভুরু দুটো নাকি কেমন সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো হয়ে গেছে৷ ও দুটোকে ফার্স্ট ব্র্যাকেটের মতো বানাতে গেছে৷ পার্থ ওর বাবার ঘরে ঢুকে কম্পিউটার অন করে৷ গুগুল খুলে ‘কৃষ্ণ’ সার্চ দিয়ে একটা সাইট খোলে৷ ওখানে সব ছবি৷ দু’হাতে একটা পাহাড়কে উঠিয়ে ধরেছে, সাপের ফণার ওপর দাঁড়িয়ে নাচ্ছে, দু’হাতে বকের দুই ঠোঁট ফাঁক করে চিরে দিচ্ছে কৃষ্ণ…৷ দাদুকে ডাকে পার্থ, টেনে নিয়ে যায়৷ দ্যাখো দাদু দ্যাখো…৷ পার্থ ওর দাদুকে দেখাতে থাকে ননীচোরা গোপাল, ঝুলন, রাসের ছবি৷ দাদু বলে, তুই এত কিছু শিখে গেছিস গোপাল আমার…৷ পার্থ বলে, আরও কত কী জানি৷ এই দেখো না, তোমার নাম লিখছি, কতরকম অক্ষর, এই দ্যাখো– বড় করে দিচ্ছি, ছোট করে দিচ্ছি৷ সিডি চালাব? সিনেমা দেখবে? —স্বপ্নময় চক্রবর্তী