সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি , বউ-বউ খেলিয়াছি । তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন , “ আহা, দুটিতে বেশ মানায় । ”
ছোট ছিলাম , কিন্তু কথাটার অর্থ একরকম বুঝতে পারিতাম । সুরবালার প্রতি যে সর্বসাধারণের অপেক্ষা আমার কিছু বিশেষ দাবি ছিল , সে ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল । সেই অধিকারমদে মত্ত হইয়া তাহার প্রতি যে আমি শাসন এবং উপদ্রব না করিতাম তাহা নহে । সেও সহিষ্ণুভাবে আমার সকলরকম ফরমাশ খাটিত এবং শাস্তি বহন করিত । পাড়ায় তাহার রূপের প্রশংসা ছিল , কিন্তু বর্বর বালকের চক্ষে সে সৌন্দর্যের কোনো গৌরব ছিল না — আমি কেবল জানিতাম , সুরবালা আমারই প্রভুত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে , এইজন্য সে আমার বিশেষরূপ অবহেলার পাত্র ।
আমার পিতা চৌধুরী-জমিদারের নায়েব ছিলেন । তাহার ইচ্ছা ছিল , আমার হাতটা পাকিলেই আমাকে জমিদারি-সেরেস্তার কাজ শিখাইয়া একটা কোথাও গোমস্তাগিরিতে প্রবৃত্ত করাইয়া দিবেন । কিন্তু, আমি মনে মনে তাহাতে নারাজ ছিলাম । আমাদের পাড়ার নীলরতন যেমন কলিকাতায় পালাইয়া লেখাপড়া শিখিয়া কালেক্টার সাহেবের নাজির হইয়াছে , আমারও জীবনের লক্ষ্য সেইরূপ অত্যুচ্চ ছিল — কালেক্টারের নাজির না হইতে পারি তো জজ-আদালতের হেডক্লার্ক হইব , ইহা আমি মনে মনে নিশ্চয় স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম ।
সর্বদাই দেখিতাম , আমার বাপ উক্ত আদালতজীবীদিগকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন — নানা উপলক্ষে মাছটা তরকারিটা টাকাটা-সিকেটা লইয়া যে তাঁহাদের পূজার্চনা করিতে হইত তাহাও শিশুকাল হইতে আমার জানা ছিল, এইজন্য আদালতে ছোটো কর্মচারী এমন-কি, পেয়াদাগুলাকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে খুব একটা সম্ভ্রমের আসন দিয়াছিলাম । ইঁহারা আমাদের বাংলাদেশের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটির ছোটো ছোটো নূতন সংস্করণ । বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইঁহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নির্ভর ঢের বেশী- সুতরাং পূর্বে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল , আজকাল ইঁহারাই তাহা সমস্ত পাইয়া থাকেন ।
আমিও নীলরতনের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া একসময় বিশেষ সুবিধাযোগে কলিকাতায় পালাইয়া গেলাম । প্রথমে গ্রামের একটি আলাপি লোকের বাসায় ছিলাম , তাহার পরে বাপের কাছ হইতেও কিছু কিছু অধ্যয়নের সাহায্য পাইতে লাগিলাম । লেখাপড়া যথা নিয়মে চলিতে লাগিল ।
ইহার উপরে আবার সভাসমিতিতেও যোগ দিতাম । দেশের জন্য হঠৎ প্রাণ বিসর্জন করা যে আশু আবশ্যক , এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল না । কিন্তু, কী করিয়া উক্ত দুঃসাধ্য কাজ করা যাইতে পারে আমি জানিতাম না , এবং কেহ দৃষ্টান্তও দেখাইত না ।
কিন্তু তাহা বলিয়া উৎসাহের কোনো ত্রুটি ছিল না । আমরা পাড়াগেঁয়ে ছেলে , কলিকাতার ইঁচড়ে-পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করিতে শিখি নাই, সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল । আমাদের সভার কর্তৃপক্ষীয়েরা বক্তৃতা দিতেন , আর আমরা চাঁদার খাতা লইয়া না-খাইয়া দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করিয়া বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতাম , রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিতাম , সভাস্থলে গিয়া বেঞ্চি চৌকি সাজাইতাম , দলপতির নামে কেহ একটা কথা বলিলে কোমর বাঁধিয়া মারামারি করিতে উদ্যত হইতাম । শহরের ছেলেরা এইসব লক্ষণ দেখিয়া আমাদিগকে বাঙাল বলিত ।
নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম , কিন্তু মাট্সীনি গারিবাল্ডি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম ।
এমন সময়ে আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হইলেন ।
আমি পনেরো বৎসর বয়সের সময় কলিকাতায় পালাইয়া আসি , তখন সুরবালার বয়স আট ; এখন আমি আঠারো । পিতার মতে আমার বিবাহের বয়স ক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে । কিন্তু, এ দিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি , আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব — বাপকে বলিলাম , বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না ।
দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম , উকিল রামলোচনবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে । পতিত ভারতের চাঁদা-আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম , এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল ।
এন্ট্রেন্স্ পাস করিয়াছি , ফার্স্ট্ আর্ট্স দিব , এমন সময় পিতার মৃত্যু হইল । সংসারে কেবল আমি একা নই, মাতা এবং দুটি ভগিনী আছেন । সুতরাং কালেজ ছাড়িয়া কাজের সন্ধানে ফিরিতে হইল । বহু চেষ্টায় নওয়াখালি বিভাগের একটি ছোটো শহরে এন্ট্রেন্স্ স্কুলের সেকেন্ড্ মাস্টারি পদ প্রাপ্ত হইলাম ।
মনে করিলাম , আমার উপযুক্ত কাজ পাইয়াছি । উপদেশ এবং উৎসাহ দিয়া এক-একটি ছাত্রকে ভাবী ভারতের এক-একটি সেনাপতি করিয়া তুলিব ।
কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম । দেখিলাম , ভাবী ভারতবর্ষ অপেক্ষা আসন্ন এগ্জামিনের তাড়া ঢের বেশি । ছাত্রদিগকে গ্রামার অ্যাল্জেব্রার বহির্ভূত কোনো কথা বলিলে হেড্মাস্টার রাগ করে । মাস-দুয়েকের মধ্যে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হইয় আসিল ।
আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারূপ কল্পনা করে , অবশেষে কার্যক্ষেত্রে নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে ল্যাজমলা খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্রাত্যহিক মাটি-ভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জাবনা খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে ; লম্ফে ঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না ।
অগ্নিদাহের আশঙ্কায় একজন করিয়া মাস্টার স্কুলের ঘরেতেই বাস করিত । আমি একা মানুষ , আমার উপরেই সেই ভার পড়িয়াছিল । স্কুলের বড়ো আটচালার সংলগ্ন একটি চালায় আমি বাস করিতাম ।
স্কুলঘরটি লোকালয় হইতে কিছু দূরে। একটি বড়ো পুষ্করিণীর ধারে । চারি দিকে সুপারি নারিকেল এবং মাদারের গাছ , এবং স্কুলগৃহের প্রায় গায়েই দুটা প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হইয়া ছায়া দান করিতেছে ।
একটা কথা এতদিন উল্লেখ করি নাই এবং এতদিন উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে হয় নাই । এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা আমাদের স্কুলঘরের অনতিদূরে । এবং তাঁহার সঙ্গে তাঁহার স্ত্রী — আমার বাল্যসখী সুরবালা — ছিল , তাহা আমার জানা ছিল ।
রামলোচনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হইল । সুরবালার সহিত বাল্যকালে আমার জানাশোনা ছিল তাহা রামলোচনবাবু জানিতেন কি না জানি না , আমিও নূতন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলা সংগত বোধ করিলাম না । এবং সুরবালা যে কোনোকাল আমার জীবনের সঙ্গে কোনোরূপ জড়িত ছিল , সে কথা আমার ভালো করিয়া মনে উদয় হইল না ।
একদিন ছুটির দিনে রামলোচনবাবুর বাসায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছি । মনে নাই কী বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল , বোধ করি বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা সম্বন্ধে । তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মাণ ছিলেন তাহা নহে , কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক-দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে ।
এমন সময়ে পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু একটু চুড়ির টুংটাং , কাপড়ের একটুখানি খস্খস্ এবং পায়েরও একটুখানি শব্দ শুনিতে পাইলাম ; বেশ বুঝিতে পারিলাম, জানালার ফাঁক দিয়া কোনো কৌতূহলপূর্ণ নেত্র আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।