একটি সত্য ঘটনা

ঘটনাটা বেশ কিছুদিন আগের। ঢাকার ভেতরে একটা রেলস্টেশন ধরে হাঁটছিলাম। প্রচণ্ড গরমের এক রাত। মন বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে আনমনে হাঁটছিলাম। মাথায় নানাবিধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে। ঢাকা শহরের জন্য খুব বেশি গভীর রাত নয়।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় খুব ক্লান্তি অনুভব করলাম। যেখানে রেললাইন বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা বাজার দেখলাম। ঢাকায় সাধারণত রেললাইনের পাশে বাজার হয়, তবে এখানে পুরো রেললাইন জুড়েই বাজার। বলা চলে, লাইনের দুপাশ ঘিরেই দোকানপাট বসেছে। প্রচুর মানুষ, বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। প্রায় সবগুলোতেই মানুষের ভিড় ঠাসা। নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার জন্য মোটামুটি ফাঁকা একটা দোকানে বসলাম।

দোকানিকে চা দিতে বললাম এবং আশপাশে তাকালাম। নানা ধরনের মানুষ কথা বলছে, ঝগড়া করছে—সাধারণত যা হয়ে থাকে। দোকানি চা দিল। উঠে গিয়ে চা হাতে নিয়ে বসলাম। চা খাচ্ছি, মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি যে দোকানটাতে বসে আছি, সেখানে একটু একটু করে মানুষের ভিড় বাড়ছে। অন্য দোকানের সামনে যারা বসে ছিল, প্রায় অনেকেই উঠে এসে আমার আশপাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে লাগল। খেয়াল করলাম, প্রায় সকলের পরনেই লুঙ্গি। যদিও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়, তবুও মনে হল সবাই ইচ্ছে করেই একই ধরনের পোশাক পরেছে।

ফালতু চিন্তা করছি ভেবে উঠে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কত হলো বিল?’’ মনে হলো, এ কথায় সবাই আমার দিকে তাকাল—সরাসরি নয়, আড়চোখে। অস্বস্তি বোধ করছিলাম। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করতে গেলাম। আবারও দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘‘বিল লাগবে না।’’

আমি রেগে গেলাম। বললাম, ‘‘লাগবে না কেন? আমি তো বিশেষ কেউ নই যে আমার বিল লাগবে না!’’

মানিব্যাগ বের করতে যাব, লক্ষ্য করলাম, দোকানি আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম যখন বুঝলাম, চেষ্টা করেও আমি মানিব্যাগ বের করতে পারছি না! ভয় লাগা শুরু হলো। দোকানি বিদ্রুপের হাসি হাসল। আমি মানিব্যাগ বের করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম। ভাবলাম, কোনো কারণে আমি নিজের ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছি।

এক সময় মানিব্যাগ বের হল। বিশ টাকার একটা নোট বিস্কুটের টিনের ওপর রাখলাম এবং দ্রুত দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম। রেললাইন পার হয়ে অল্প কিছু দূর এগিয়েছি। হঠাৎ কী মনে হতে ফেলে আসা বাজারের দিকে পিছন ফিরে তাকালাম। দোকানটিতে আগের মতোই ভিড়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, দোকানের সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে—বিশেষ করে দোকানি। সে দোকান থেকে নেমে আমার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে করছিল ছুট লাগাই, কিন্তু কেন জানি দৌড় দিলাম না। জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম।

অল্প কিছু দূর এগিয়ে সামনেই একটা রিকশা পেলাম। মনে হল, আমি যেন জীবন ফিরে পেলাম। হুড়মুড় করে রিকশায় উঠে পড়লাম। গন্তব্যস্থলের নাম বলতেই রিকশা যেন হাওয়ার গতিতে ছুটতে লাগল। ইচ্ছে হল রিকশাওয়ালাকে ধমক দিই এত জোরে চালানোর জন্য। তবে ভালোই লাগছিল, তাই কিছু বললাম না। মনে হচ্ছিল, আমার পেছনে অশুভ কিছু ধাওয়া করছে, আর পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে রিকশা।

বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা শান্তি অনুভব করলাম। ঘুম ঘুম লাগছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটার বেশি বাজে। আমি যেখানে নামব, সেখানে পৌঁছানোর জন্য সাধারণত রিকশাওয়ালাকে পথ বলে দিতে হয়। কিন্তু সে যেন সব চেনে! আমাকে ঠিক দোরগোড়ায় নামিয়ে দিল।

আমার কাছে রিকশাভাড়া কিছু কম ছিল। তাছাড়া এত রাতে রিকশা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার মনে করে রিকশাওয়ালাকে কিছু বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হল। রিকশা থেকে নেমে বললাম, ‘‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি টাকা নিয়ে আসছি।’’

এই প্রথম আমি রিকশাওয়ালার চেহারা দেখলাম। মনে হল, আগেও কোথাও দেখেছি। কোথায় দেখেছি চিন্তা করতে করতে টাকা নিয়ে বের হলাম। দরজা খুলে বেরোবার সময় হঠাৎ মনে পড়ল—বাজারের দোকানি, এই লোকটিই!

সাথে সাথে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বের হলাম। কিন্তু বাইরে কেউ নেই! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।

পরদিন দুপুরে আমি আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই লাইনে গেলাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও ওই মোড় বা বাজার কিছুই খুঁজে পেলাম না!

পাখাওয়ালা পিঁপড়া

মূল্যবোধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *